ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

শত বছরের ১০ প্রাচীন স্থাপত্য

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

শত বছরের ১০ প্রাচীন স্থাপত্য

গ্রাম বাংলার শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নজরকাড়া প্রাচীন স্থাপত্য দেখতে হলে অবশ্যই আপনাকে আসতে হবে প্রাচ্যের ভেনিস নামে পরিচিত বরিশালে। কীর্তনখোলার তীরে অবস্থিত দক্ষিণাঞ্চলের বরিশালের বিভাগীয় শহরটি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর একটি শহর। দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদনের একটি মূল অংশ আসে বরিশাল থেকে। তাই একে বাংলার ভেনিস বলে ডাকা হয়। এ বিভাগের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শত বছরের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপত্য। এরমধ্যে কিছু স্থাপত্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলেও অধিকাংশ স্থাপত্য রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ বিলীন। মিয়াবাড়ী মসজিদ ॥ বরিশাল সদরের রায়পাশা গ্রামের মিয়াবাড়ীমসজিদ তৈরি হয় সতেরো শতকের শেষের দিকে। দোতলা মসজিদের চারপাশে পিলারের ওপর আটটি বড় মিনার। মিনারগুলোর মধ্যে আবার ছোট ছোট ১২টি মিনার। ছোট মিনারগুলো নক্সার মসজিদের মধ্যখানে তিনটি বড় গম্বুজ। মধ্যেরটি সবচেয়ে বড়। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে, এ মসজিদটি নির্মাণ করেছেন ইংরেজবিদ্রোহী জমিদার হায়াত মাহমুদ। বিদ্রোহের কারণে তার জমিদারি কেড়ে নিয়ে দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়। ১৩ জমিদারের শহর কলসকাঠি ॥ বাকেরগঞ্জের কলসকাঠিতে একসময় ছিল ১৩ জমিদারের বাস। কলসকাঠি অনেকটা পানাম নগরের মতো। এখানে আজও টিকে আছে ১০টি স্থাপনা। মূল ভবনটি দোতলা। সামনে বড় উঠান। উঠান পেরোলেই বিশাল মন্দির। সেটিও জরাজীর্ণ। একসময় এ মন্দিরে মূল্যবান পাথরের অনেক মূর্তি ছিল। মন্দিরের সামনের ছোট বেদিতে পূজার সময় বলি দেয়া হতো। কিছু দূরে আরেকটি মন্দিরে এখনও রয়েছে শিবলিঙ্গ ও সাদা পাথরের ঘোড়া। বিবিচিনি শাহী মসজিদ ॥ বরিশাল থেকে বরগুনা যেতে বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি গ্রাম। সেখানে প্রায় ২০ ফুট টিলার ওপর বিবিচিনি শাহী মসজিদ। সতেরো শতকে নির্মিত মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট ও প্রস্থ ৩৩ ফুট, দেয়াল ছয় ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তরে তিনটি দরজা। মসজিদের ইটগুলোও মোগল ঐতিহ্যের ছাপ বহন করে। ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১০ ইঞ্চি। মসজিদটি ২৫ ফুট উঁচু। মসজিদের পাশে তিনটি কবর। সাধারণ কবরের মতো হলেও লম্বায় ১৪ থেকে ১৫ হাত। এখানে শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতুল্লাহ ও তার দুই কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবি। চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে বিবিচিনি গ্রামের নামকরণ। এ মোগল স্থাপত্য সম্পর্কে ব্রিটেনের জাদুঘরেও তথ্য রয়েছে। শাহ্ সুজার অনুরোধে এই মসজিদটি তৈরি করেছিলেন সাধক নেয়ামতুল্লাহ। ১২ আউলিয়ার দরগা ॥ বাকেরগঞ্জ থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে ১২ আউলিয়ার দরগা। কথিত মতে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় বাকেরগঞ্জের রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের নন্দপাড়া গ্রামে ১২ আউলিয়া আসেন। সম্র্রাট তাদের জন্য টাকা, কাপড় আর ঘোড়া পাঠালেও সেগুলো তারা ফিরিয়ে দেন। পরে তারা রাতের আঁধারে নিরুদ্দেশ হন। এরপর আওরঙ্গজেব সেখানে ১২ আউলিয়ার মাজার করেন। পাশে খনন করেন একটি দীঘি। এখন মাজারটিকে ঘিরে ধরেছে বিশাল গাছের শিকড়। ইট-পাথরে নির্মিত মাজারের পূর্বে তিনটি আর উত্তরে একটি জানালা ছিল। মাজারের উত্তরে একটি সুড়ঙ্গ ছিল। সেখানে ভক্তরা দুধ ঢেলে দিত। সেই দুধ গড়াত পুকুরে। সে কারণে পুকুরটিকে দুধপুকুর বলা হতো। এখন সুড়ঙ্গ পথটি বন্ধ। মসজিদের নাম ‘আল্লাহর মসজিদ’ ॥ গৌরনদী পৌর এলাকার বড় কসবা নামকস্থানে প্রাচীনকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী ‘আল্লাহর মসজিদ।’ এ মসজিদকে ঘিরে ওই এলাকার আদিবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, অতিপ্রাচীন বড় কসবা গ্রামের ওই এলাকাটি একসময় গভীর জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। সম্র্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মাদারীপুরের রাজৈর বাজিতপুর (সমদ্দার ব্রিজ) এলাকার বাসিন্দা আব্দুর জব্বার ওরফে বাবর আলী খন্দকার নামের এক পাগল ওই জঙ্গলে ধ্যানে মগ্ন হয়ে বলেছিলেন, একরাতের মধ্যে জঙ্গলের মধ্যে গায়েবানাভাবে একটি মসজিদ উঠবে আর তার নাম হবে “আল্লাহর মসজিদ”। পরবর্তীতে পাগল বাবর আলী খন্দকারের গায়েব হয়ে যাওয়ার পরের রাতেই ওই গভীর জঙ্গলে নয়টি গম্বুজ, পাঁচটি দরজা ও বহু মূল্যবান শ্বেত পাথরের মসজিদটি গায়েবানাভাবে নির্মিত হয়। স্থানীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, প্রায় দেড় শ’ বছর পূর্বে এক অন্ধকার রাতে মসজিদটি পূর্ব পাশের দীঘি থেকে অলৌকিকভাবে ঐশ্বরিক মণি-মুক্তা ও শ্বেত পাথরের আটটি খাম্বা ওঠে। তার মধ্যে চারটি ওই মসজিদের মধ্যে অবস্থান নেয়। যা মসজিদের গম্বুজের সঙ্গে মিশে যায়। অন্য চারটি খাম্বা ওই বিশাল দীঘি থেকে উঠতে থাকা অবস্থায় সুবহে সাদেকের সময়ে ওই এলাকায় এক নববধূ গোসল করতে দীঘির পারে গিয়ে ঐশ্বরিক ওই চারটি খাম্বার ওপর উঠলে খাম্বা চারটি দীঘির পানির নিচে চলে যায়। সেই থেকে মসজিদের মধ্যে থাকা খাম্বা চারটি থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহর কুদরতি তেল (জাতীয় পদার্থ) বের হচ্ছে। ওই তেলকে এলাকার মানুষ রহমতের তেল বলে মনে করে। ওই তেল ব্যবহার করে অনেকে কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলেও এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে। স্থাপত্যিক এ নিদর্শনটি প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। নসরত গাজী জামে মসজিদ ॥ বাকেরগঞ্জ উপজেলার শিয়ালঘুনি গ্রামের পিয়ারপুর বাজার-ডিসি ঘাট সংলগ্ন ব্রিজ থেকে খালের পশ্চিম পাশ ধরে প্রায় ২০০ মিটার উত্তর দিকে এগুলেই চৌধুরী বাড়ি। ওই বাড়ির প্রবেশপথের উত্তর দিকে এ প্রাচীন মসজিদটির অবস্থান। নসরত গাজী এ মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। মসজিদের গায়ে একটি শিলালিপি ছিল তা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মুসলিম স্থাপত্যটি নির্মাণে চুন-সুরকি ও পাতলা বর্গাকারের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। বর্গাকার ভূমি-পরিকল্পনায় নির্মিত এ মসজিদের অভ্যন্তরের দৈর্ঘ্য ৪.৫০ মিটার এবং দেয়ালগুলো ১.৪৩ মিটার পুরু। মসজিদের চারকোণায় চারটি অষ্টভুজাকার স্তম্ভ রয়েছে। পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর দিকে গোথিক খিলান বিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথের খিলান নক্সার সঙ্গে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রবেশপথের খিলান নক্সার যথেষ্ট মিল রয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ ও উত্তর দিকের প্রবেশপথ দুটি লোহার গ্রিল দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মসজিদটিতে প্রবেশের জন্য কেবল পূর্বদিকের প্রবেশপথটি ব্যবহৃত হয়। মসজিদটির অভ্যন্তরের পশ্চিম দেয়ালে একটি মিহরাব রয়েছে। মসজিদের দেয়াল, কার্ণিস ও স্তম্ভে ফুল ও লতাপাতার বেশ কিছু অলঙ্করণ রয়েছে। মুসলিম স্থাপত্যিক এ নিদর্শনটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের তালিকাভুক্ত এবং তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তিন গম্বুজবিশিষ্ট কমলাপুর মসজিদ ॥ গৌরনদীর কমলাপুর গ্রামে মুসলিম স্থাপত্যকীর্তি এ মসজিদটির অবস্থান। জনশ্রুতি রয়েছে, এ মসজিদটি মাসুম খান নামের এক ব্যক্তির নির্মিত স্থাপত্যকীর্তি। নির্মাণশিল্প দেখে অনুমান করা হয় যে, এ মসজিদটি খ্রিস্টীয় ১৭ শতকের কোন একসময়ে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে মসজিদের নির্মাণকাল বা ইতিহাসযুক্ত কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি। ১৯৭৫ সালে এটিকে বাংলাদেশ সরকার সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করেন। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদটি আয়তাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়। ইট ও চুন-সুরকি দিয়ে নির্মিত এ মসজিদটির দেয়ালসহ দৈর্ঘ্য ১৭.২২ মিটার ও প্রস্থ ৮.০৮ মিটার। মসজিদের দেয়ালগুলো ১.৯০ মিটার চওড়া। মসজিদটির পূর্ব দিকের দেয়ালে তিনটি প্রবেশপথ রয়েছে। প্রবেশপথগুলোর প্রত্যেকটিতে দুটি করে খিলান রয়েছে। বাইরের খিলানটি বহু পত্রাকার এবং ভিতরের খিলানটি শিখড়বিশিষ্ট। উলানিয়া জমিদার বাড়ি ও মসজিদ ॥ মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে রয়েছে ভগ্নপ্রায় চৌধুরীবাড়ি যা জমিদারবাড়ি হিসেবে পরিচিত। উলানিয়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুবেদার মোহাম্মদ হানিফ খান। যিনি ভারতীয় মুসলমান ছিলেন না। তার উর্ধতন পঞ্চম পুরুষ শেখ মোহাম্মদ আসাদ আলী খান ভাগ্যান্বেষণে সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তিনি প্রথমে অযোধ্যায় ও পরে মুর্শিদাবাদে বসতি স্থাপন করেন। মোহাম্মদ হানিফ খান সৈনিক বিভাগে চাকরি করতেন। পঞ্চদশ সালের গোড়ার দিকে এতদাঞ্চলের মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের দমনের উদ্দেশ্যে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব সুবেদার শায়েস্তা খানকে পাঠিয়েছিলেন। শায়েস্তা খান ও তার পুত্র উমেদ খান রণতরী সৈন্য গোলাবারুদ নিয়ে জলদস্যুদের প্রতিহত করতে মেহেন্দিগঞ্জের গোবিন্দপুরে সংগ্রাম কেল্লা তৈরি করেন। পঞ্চরতœখ্যাত বড়দাকান্ত মিত্র মঠ ॥ হিজলা উপজেলার গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের পূর্ব কোড়ালিয়া গ্রামের কাউরিয়া বাজার থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উত্তর দিকে কাউরিয়া-হরিনাথপুর সড়কের পশ্চিম পাশে বাবুর বাড়িতে বড়দাকান্ত মিত্র মঠের অবস্থান। বড়দাকান্ত মিত্র মঠটিকে স্থানীয়ভাবে পঞ্চরতœও বলা হয়ে থাকে। মঠটির দোতলার সামনের দেয়ালে বাংলা ১৩০৬ সন লেখা রয়েছে। তৎকালীন জমিদার বড়দাকান্ত মিত্র এ মঠটি নির্মাণ করেছেন। মঠটির আয়তাকার ভূমি পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়। মঠটির পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য ১৩.২ মিটার ও উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থ ১২.১৫ মিটার। দোতলাবিশিষ্ট এ মঠটির দেয়ালগুলো ৬০ সে.মি. চওড়া। মঠটির নিচতলার পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে প্রবেশপথ। উত্তর দেয়ালে পাঁচটি জানালা এবং পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালে দুটি করে জানালা রয়েছে। নিচতলার প্রবেশপথ ও জানালাগুলো সমতল খিলানবিশিষ্ট। মাহিলাড়ার সরকার মঠ ॥ গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া গ্রামে এ মঠটি অবস্থিত। মঠটির দক্ষিণ পাশে একটি দীঘি, পূর্বপাশে একটি পুকুর এবং পশ্চিম ও উত্তর পাশে পাকা সড়ক রয়েছে। সরকারের মঠ নামে পরিচিত এ শংকর মঠটি শিখরী মন্দির শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন। মঠটিতে কোন খোদিত লিপি পাওয়া যায়নি। তবে এর স্থাপত্যিক গঠনশৈলী দেখে অনুমান করা হয় খ্রিস্টীয় ১৮ শতকে নবাব আলীবর্দীর আমলে সরকার রূপরাম দাশগুপ্ত এ মঠটি নির্মাণ করেছেন। মঠটি প্রায় ২০.২১ মিটার উঁচু। অষ্টভুজাকারে নির্মিত এ মঠের নিচের দিকের প্রতিটি ভুজ বা বাহুর দৈর্ঘ্য ১.৯১ মিটার। এ বাহুগুলো নিচ থেকে প্রায় ৬.২ মিটার পর্যন্ত ওউপরের দিকে উঠে গেছে। এরপর মঠটি ক্রমশ সরু হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে। Ñখোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে
×