ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আসাদ কি জিতে যাচ্ছেন- প্রশ্ন বিশ্লেষকদের

অবশেষে সমাপ্তির পথে সিরিয়া যুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

অবশেষে সমাপ্তির পথে সিরিয়া যুদ্ধ

ব্যাপক রক্তক্ষয় ও ধ্বংসের পর অবশেষে ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে সিরিয়ার যুদ্ধ। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রায় ছয় বছর ধরে চলা এ যুদ্ধের এ মুহূর্তে আসলে তীব্রতা কমেছে। আর আসাদ সরকার পুরো দেশে তার শাসন সুসংহত করতে শুরু করলে তাকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন স্থানে নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। তবে এ অঞ্চলে যুদ্ধের দামামা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে শান্তির বাতাস বইতে আরও অনেক সময় বাকি। জেরুজালেম পোস্ট। মঙ্গলবার সিরিয়ার খান শেইখুন এলাকায় রাসায়নিক হামলার তদন্তে জাতিসংঘ গঠিত কমিটির সময় বাড়াতে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত একটি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে রাশিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ওই প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়। এ নিয়ে রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়াবিরোধী নয়টি প্রস্তাব আটকে দিল। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল খান শেইখুনে চালানো রাসায়নিক হামলায় অন্তত ৮৬ ব্যক্তি নিহত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন কোন প্রমাণ উপস্থাপন ছাড়াই ওই হামলার জন্য সিরিয়া সরকারকে দায়ী করে। তবে দামেস্ক শুরু থেকেই ওই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। রাশিয়া ও সিরিয়ার দাবি, সিরীয় সেনাবাহিনী খান শেইখুনে উগ্র সন্ত্রাসীদের এমন একটি ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে যেখানে জঙ্গিরা রাসায়নিক অস্ত্র মজুদ করেছিল। মঙ্গলবার রাতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটির আগে রাশিয়া বলেছিল, খান শেইখুনের ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটি এ পর্যন্ত কী তথ্য হাতে পেয়েছে সে সম্পর্কে শুনানি অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু মার্কিন সরকার ওই কমিটির তদন্ত কাজের মেয়াদ আগে বাড়িয়ে নিয়ে তারপর শুনানির জন্য চাপ দিচ্ছিল। জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেছেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আগে প্রকাশ করতে হবে। তারপর ভেবে দেখা যাবে তাদের তদন্তে আরও সময় প্রয়োজন আছে কি-না। রাশিয়ার ভেটোর প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিক্কি হেলি মস্কোর নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, রাসায়নিক হামলার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা দিয়ে রাশিয়া আবার প্রমাণ করল বর্বর আসাদ সরকারকে রক্ষায় যা করার দরকার তারা তাই করবে। রাশিয়ার সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি সিরিয়ার নিজস্ব সেনাবাহিনী, ইরানী সহায়তাপুষ্ট লেবাননের হিজবুল্লাহ বাহিনী এবং শিয়া মিলিশিয়াদের সমর্থন নিয়ে ধীরে ধীরে সিরিয়ার চলমান যুদ্ধে নিজের অবস্থান ও শক্তিকে সুসংহত করেছেন বাশার আল আসাদ। অন্যদিকে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) ইসলামিক স্টেট (আইএস) সন্ত্রাসীদের পরাজিত করে রাক্কাসহ বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত করায় বিশাল এলাকায় একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, যেসব এলাকায় এ ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে তার বেশিরভাগই স্বাভাবিক শাসনতন্ত্রের নিয়মে এক সময় মূল প্রশাসনিক যন্ত্রের সঙ্গে মিশে যাবে। এ পরিস্থিতিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আসাদ ও তার মিত্ররা দেশটিতে তাদের আধিপত্যকে আরও দৃঢ় করবে। এ মুহূর্তে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহলে আসাদ সরকার কি সিরিয়ায় কার্যকরভাবে যুদ্ধে জয়ী হয়েছে? সেক্ষেত্রে উত্তর হলো, যদি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের লক্ষ্য হয়ে থাকে আসাদের শাসন থেকে দেশটিকে মুক্ত করা, তাহলে বলতে হবে তারা হেরে গেছে। কারণ, বাশার আল আসাদ ঝড় সামাল দিয়ে নিশ্চিতভাবেই সিরিয়ার শাসন ক্ষমতায় তার অবস্থান নিশ্চিত করেছেন এবং এভাবেই তিনি জয়ী হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ইসরাইলের রুবিন সেন্টারের ডিরেক্টর ড. জনাথন স্পিয়ার এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মিডলইস্ট ফোরামে তার এক সহকর্মী মিডিয়া লাইনকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, সিরীয় সরকার পুরো দেশের সব অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করে না। এটা নির্ভর করছে রাশিয়া ও ইরান কোন্ অঞ্চলে কতটা প্রভাব বিস্তার করে তার ওপর। সিরিয়া সঙ্কটের বিশেষজ্ঞ চ্যাথাম হাউসের একজন সহযোগী ফেলো ড. ক্রিস্টোফার ফিলিপস স্বীকার করেন যে, আসাদ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন এই অর্থে যে, তিনি দেশটিতে বিক্ষোভের প্রাথমিক অবস্থায় ভেঙ্গে পড়েননি এবং পরবর্তীতে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও পরাজিত হননি। তবে তিনি চাপে রয়েছেন এবং সম্পূর্ণ দেশটির সব অঞ্চলে সার্বভৌম ক্ষমতার চর্চা করতে পারেন না। এর মধ্যে রয়েছে চারটি ‘ডি-এসক্লেশন’ পকেট যেখানে যুদ্ধবিরতির সম্মতি দেয়া হয়েছে। তবে ড. ফিলিপস মনে করেন, প্রচলিত অর্থে ধীরে ধীরে সিরিয়ায় যুদ্ধের তীব্রতা কমে আসবে। বিচ্ছিন্নভাবে উগ্রপন্থী সিরীয় বাহিনী ও সশস্ত্র বিরোধীদের মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় হয়ত সংঘর্ষ দীর্ঘস্থায়ী হবে। একই ভাবে ড. জনাথন স্পিয়ার বলেছেন, যুদ্ধে জিতলেও সিরিয়ার ২০১১ সালের পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার কোন বাস্তব সুযোগ নেই। একই সঙ্গে উভয় বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সিরিয়ায় রাশিয়া এবং ইরানের রাজনৈতিক ও সামরিক জোট অব্যাহত থাকবে। সিরিয়ায় রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা নীতি ভবিষ্যতে কেমন হবে তা নির্ভর করছে ইসলামিক জোট আইএস ওই অঞ্চলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর মার্কিন অবস্থান কী হবে তার ওপর। যদি কুর্দীদের জন্য মার্কিনীরা তাদের সমর্থন দৃঢ় করে এবং সহায়তা আরও বাড়িয়ে দেয় তবে রাশিয়া সিরিয়াকে সহায়তা করে যাবে। মার্কিনীরা যদি এ অঞ্চলে যুদ্ধ বা লড়াই দীর্ঘায়িত করার পাশাপাশি কুর্দীদের জন্য স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা গঠন করতে চায় তবে ভবিষ্যতে হয়ত পরিস্থিতি আবার ভিন্নদিকে মোড় নিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে সিরিয়া, ইরাক, ইরান, এবং তুরস্ক সম্মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে লড়াই করবে। সেখানে মার্কিনী অবস্থান জোরালো করা তাদের জন্য একপ্রকার দুরূহ-ই হবে বলে ধরে নিতে হবে।
×