ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আইনী পরামর্শ

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

আইনী পরামর্শ

প্রশ্ন : কম টাকা খরচে মালয়েশিয়া যাওয়া যাবে শুনে আমি রাজি হই। তাও মাত্র দশ হাজার টাকায়। পৌঁছানোর ছয় মাস পর বাকি ১ লাখ ৫০ হাজার দিলেই চলবে। আমার এক বন্ধু সব ব্যবস্থা করে দেবে বলল। গত ২.১০.২০১৫ তে মালয়েশিয়া। যাওয়ার জন্য ওই বন্ধুর মারফত একজনকে ১০ হাজার টাকা দেই। সে আমাকে টেকনাফে ১০.১০.২০১৫ কচুবনিয়া ঘাটে রাত ৮টায় থাকতে বলে। যথারীতি উপস্থিত থাকি। কচুবনিয়া ঘাটে আরও প্রায় ২০-২৫ জন লোক যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। তারপর আমাদের এক মাছের ট্রলারে উঠতে বলে। আমরা উঠি মোট ২৭ জন। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে রওনা হই। মোটামুটি বেশ অনেকক্ষণ যাওয়ার পর রাত ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে দেখি আরেকটি বড় মাছ ধরার ট্রলার আসে। আমাদের পূর্বের ছোট ট্রলারটি বড় ট্রলারটির সঙ্গে সাগরের মধ্যে ভিড়ানো হয় তারপর আমাদের সবাইকে ওই বড় ট্রলারটিতে উঠতে বলে। আমরাও অনেক ভয়ে ভয়ে বড় ট্রলাটিতে উঠি। তারপর সারারাত ট্রলারটি চলল। আমাদের কোন খাবার দেয়া হয়নি। আমারাও তেমন কোন খাবার সঙ্গে নিয়ে যাইনি। সকালে ক্ষুধায় আমাদের অবস্থা কাহিল। এরপর দিনের আলো যত বাড়তে থাকে, আমাদের ক্লান্তিও তত বাড়তে থাকে। আমরা লাশের মতো পড়ে থাকি। আমাদের কচুবনিয়া ঘাট থেকে যে সাতাশ জন উঠেছিলাম তার ভেতর থেকে দু’একজন পরিচিত ছিল, বাকিরা অপরিচিত এবং বড় ট্রলারে ১৫০ জনের মতো ছিল। তারা কোথা থেকে উঠেছিল, তাও জানা নেই। তবে বড় মাছ ধরার ট্রলারটি কক্সবাজারের এইটুকু জানতাম। মাঝি কক্সবাজারের। মাঝি ছিল দুজন পালা করে চালাত। যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি। কোথাও কোন কূলকিনারা নেই। কখনও কখনও দূরে দু’একটা জাহাজ বা ট্রলার দেখা যেত। এভাবে এক সময় আমাদের নিথর দেহ বুঝতে পারে। সূর্য ডুবে গেছে আমরা আর পারছিলাম না। পরে রাত আরও গভীর হয়। রাজ্যের দুশ্চিন্তা, ভয় এসে ভর করে আমাদের প্রায় সবাইকে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল ঘুমিয়ে, অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আর দুজন বিভিন্নভাবে গল্প বলে আমাদের আশার বাণী শুনাচ্ছিল, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিচ্ছিল হাজারো উদাহরণ টেনে টেনে। এক সময় সবাই চুপ হয়ে যে যার মতো পড়েছিল। আচমকা দেখা গেল ট্রলারের গতি কিছুটা কমে আসছে। মাঝি ট্রলারের তলা চেক করে দুটো ফাটল দেখল। তারপর সবাই দেখলাম ট্রলারের ভেতরে পানি ঢুকছে দ্রুত। ধীরে ধীরে পানি বাড়তে থাকে। আমরা সবাই দিশেহারা। আমার সকল আশা, স্বপ্ন নিমিষেই কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মাথায় কেবল দ্রুত আসছিল, পেছনের জীবনের ভুল পথগুলো আর সামনে দেখতে পাওয়া মাত্র একটি পথ-নিশ্চিত মৃত্যু। আর ট্রলারজুড়ে চিৎকার, চেঁচামেচি আর জোরে জোরে কান্নার রোল আর কাতর স্বরে আল্লাহকে ডাকা। এক সময় ট্রলারটি আমাদের পায়ের নিচ থেকে আস্তে আস্তে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে শুধু থৈ থৈ পানি। দূরে কোথাও কোন ট্রলার বা নৌকা দেখা যাচ্ছে না। শুধু কারও কারও মাথা, বা কারও কারও অর্ধাঙ্গ দেখা যায়। কেবল সমুদ্রে ভাসমান কিছু মানুষ। কে কোথায় গেল, ক’জন মারা গেল, ক’জন বাঁচল এ হিসাব আমার কাছে নেই। পরেরদিন সকালে একটি মাছ ধরার ট্রলার অর্ধ-অবচেতন অবস্থায় আমাদের কয়েকজনকে উদ্ধার করে। মাঝপথে কোস্টগার্ড, বিডিআর পুলিশ ও অন্যান্য ট্রলারের অচেনা অনেক মানুষের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তিন দিন পর বাড়ি ফিরি। শারীরিক অবস্থা কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু মানসিক অবস্থা ঠিক হতে প্রায় দু’বছর চলে যায়। আমাদের যারা এভাবে মৃত্যুর রাজ্যে পাঠিয়ে ব্যবসা করে, তারা একা নয়, বুঝতে পেরেছি। এই অবস্থায় কি করতে পারি? জানাবেন। (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) উত্তর : আপনার দীর্ঘ বর্ণনা খুবই বেদনাদায়ক। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই মানব পাচার সমস্যাটি দেশের অন্যতম সমস্যা। এ অপরাধটি প্রতিরোধ করার জন্য মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ প্রণীত হয়। আপনি এই আইনের অধীনে মামলা দায়ের করতে পারেন, সেক্ষেত্রে আপনার পরিচয় প্রকাশ বাধ্যতামূলক নয়। এই আইনের ১৭ ধারা অনুযায়ী সংবাদদাতার নাম পরিচয় গোপন রাখতে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুতরাং এ আইনের ৭ ধারার অধীনে আপনি মামলা দায়ের করে নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারেন, অত্র অপরাধটি একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচার করার অপরাধ। এ ধরনের বিচার করার জন্য প্রত্যেক জেলায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। আপনি আপনার পরিচয় গোপন করে, আপনার থানায় বা ট্রাইবুন্যালে ওই মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের ২০১২ এর ৭ ধারার মামলা দায়ের করলে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল ১৯ ধারায় তদন্ত পরবর্তীতে ধাপে ধাপে বিচার ও দন্ডের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারেন। যদি কোন সংঘবদ্ধ গোষ্ঠী এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটন করে এবং তা যদি বিচারে প্রমাণিত হয়। তাহলে ওই গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্য ওই সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত হবে এবং অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অন্যুন সাত বছর সশ্রম কারাদন্ডে বা অন্যুন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
×