আকাশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল কড়ই গাছটাকে কেউ ঠিক গাছ মনে করত না কখনও।
হাত বাড়ানো বুক চিতানো ঝাঁকড়া মাথার শতবর্ষী এক মানবের ছায়া পড়ত গাছটার শাখা-প্রশাখা আর পত্র-পল্লবে; এর অন্তরাত্মা থেকে বিচ্ছুরিত হতো সবুজাভ রশ্মি ; দীনহীন নগণ্য মানুষ দেহে ও অন্তরে সেই রশ্মি মেখে বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় তাকিয়ে থাকত শূন্যে, পেখম মেলে থাকা আতসবাজির আলোর মতো গাছটার দিকে। প্রাণে থাকত ভালবাসা ও প্রশান্তি।
যে সময়ের কথা হচ্ছে তখনও গাছটা সে রকমই ছিল; সেটা ঘিরে মানুষ, পোকামাকড়, সাপ-ব্যাঙ, পশু-পাখি যে একটা ঐকতান তৈরি করে নিয়েছিল নিজেদের ভেতর, সেটা পুরো বজায় ছিল তখনও।
ওরকমই এক সময় শহরময় চাউর হয়ে গেল এক খবর।
মফস্বল শহর। ছোট একটা পটকার আওয়াজ পেলেও চটজলদি সবাই জেগে ওঠে। নিঃসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকভরা ভয়-আতঙ্ক নিয়ে ভাবে, ‘হায় খোদা, এইডা কি অইল?’
সেই শহরের বিখ্যাত চিনুভাই হঠাৎ পাগল হয়ে গেছেনÑ সেটা অজানা থাকবে কারও?
চিনুভাইর পুরো নাম সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমান চিনু। তাঁর দাদা ছিলেন সুফী ঘরানার এক কামেল পুরুষ। বিপদে পড়লে লোকজন তাঁর কাছেই ছুটে আসত। কবচ-তাবিজ-পানিপড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাদের নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতাও করতেন। সেজন্য বহু পরিবার তাঁকে সাচ্চা পীর মেনে মুরিদ হয়েছিল তখন। ওদের বাড়ির উঠোনে নিম-করবীর ডালের তলায় লাল-নীল নিশান উড়ানো যে একখানা মাজার রয়েছে তা তাঁরই নামে।
প্রতিবছর সেখানে ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটে। ডেকচি-ডেকচি গরুর মাংসের খিচুড়ি-শিন্নি বিতরণ করা হয় মুরিদ-অশিকানদের ভেতর। রাতভর মাহফিল ও জিকির চলে খোদার নামে। বড় বড় সব মুফতি-মাওলানাগণকেও দাওয়াত দিয়ে আনা হয়। ইসলামের বিধি-বিধান আর তরিকা নিয়ে তাঁরাও দু-কথা বলেন সেখানে।
ওরস চলে মোট তিনদিন। একে ঘিরে মুড়ি-মুড়কি-কটকটি-দই-চিড়া-বেলুন-চরকি-পুতুলনাচ-কবিগানের একটা জমজমাট মেলাও বসে যায় আশপাশের খোলা মাঠে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শহরের অনেকেই বেড়াতে আসে তখন।
অথচ এরকম পীর-ফকিরের বংশে জন্ম নিয়েও চিনুভাই সেদিকে এগোলেন না। বরং বাম ঘরানার এক কলেজ শিক্ষকের কাছে হাতেখড়ি পেয়ে তিনি হয়ে উঠলেন এ শহরের বিপ্লবী জননেতা। বাহাত্তরে যারা চিনুভাইর বক্তৃতা শুনেছেন তাদের অনেকেই এখনও তাঁর প্রতি মোহমুগ্ধ।
রাত নেই, দিন নেই তিনি তখন কলেজ মাঠে পড়ে থাকেন। তাঁর চারপাশে শতশত ছাত্র-জনতা। সবাইকে বিপ্লবের কথা শোনান। মার্কস-এঙ্গেলস কোট-আনকোট করে সবার ভেতর নতুন সমাজ গড়ার দৃঢ় অঙ্গীকারের এক ছবি এঁকে দেন।
ওই সময়টায় কে মুক্তিযোদ্ধা ছিল আর কে রাজাকার তা নিয়েও সরগরম ছিল শহরের প্রতিটি রাজনৈতিক আড্ডা। চিনুভাই আদৌ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে অনেকেই কমবেশ সন্দিহান। শহরের মুক্তিযোদ্ধা-কমান্ডারের কাছ থেকেও তিনি স্বীকৃতি পাননি। তবু তিনি স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপন শিস্যদের ভেতর সুপরিচিত।
এ ব্যাপারে তিনটি কাহিনী এলাকায় চালু রয়েছে। একবার আখাউড়ার শিঙ্গারবিলের কাছে একটা তালগাছের ডগায় চড়ে চিনুভাই নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের পথ দেখিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার তিতাসপাড়ের কালভৈরব মন্দিরটি শেল মেরে ধ্বংস করে দেবার পর চিনুভাই তাঁর দলবল নিয়ে মন্দিরচত্বর পরিষ্কার করেছিলের পরম মমতায়। শেষবার এক পাক মেজরের জিপকে দেখতে পেয়ে তিনি এতই ভয় পেয়েছিলেন যে একটা পুকুরে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি যদি সেদিন পুকুরে আশ্রয় না নিতেন তাহলে পুরো পাড়াটাই নাকি ধ্বংস হয়ে যেত Ñমফস্বলবাসী তাঁর চ্যালা-চামুন্ডারা এভাবেই চিনুভাইর এই অধঃপতনের ব্যাখ্যা দিয়ে তৃপ্তি লাভ করত তখন।
এ নিয়ে সুবলও কম যায় না। যারা চিনুভাইকে চীনাপন্থী ও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সমর্থক হিসেবে মূল্যায়ন করত তাদের ধরে ধরে নগেনের চায়ের স্টলে বসিয়ে বিনা পয়সার সিংগাড়া খাইয়ে তুমুল বাকযুদ্ধে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ত আর সেটা ছিল দলের কল্যাণের জন্যে ওর অন্যতম কাজ।
চিনুভাই চুয়াত্তর-পঁচাত্তর সালে সুবলকে পরিচয় করিয়ে দিতেন আপন ছোটোভাই হিসেবে। সুবল তখন তাঁর প্রটোকল অফিসার। তিনি কোথায় কোন গ্রামে কবে ভাষণ দেবেন তা নির্ধারণের ভার ছিল ওর উপর। লালপুর, চুনটা, রামরাইলÑ আবার কখনও নবীনগরের কোন পাড়াগাঁর বাজার-হাট ছিল এসব সমাবেশের আদর্শ স্থান। তিনি বক্তৃতার ভেতর দিয়ে বিপ্লবের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসতেন। কৌতূহলী আম-জনতা তাঁর বক্তৃতার পরতে পরতে কায়েমী স্বার্থের আগুন আর সামন্ততান্ত্রিক অন্ধকার দেখতে পেত।
চিনুভাইর মতো সুবলও তখন শহরের জনপ্রিয় মুখ। নেতার ঘনিষ্ঠ হিসাবে সবাই ওর ভেতর এক অগ্নিগর্ভ বিপ্লবীর ছায়া দেখতে পাচ্ছে। ওর ঢ্যাঙ্গা স্বাস্থ্য আর ঢুলু-ঢুলু চোখের তারায় বিপ্লব জোনাক পোকা হয়ে জ্বলছে। আলোর সেই ইশারায় অনেকেই মুগ্ধ হয়ে মন্তব্য করেছে, ‘সুবল একটা বেডাই।’
সেই সুবল, বিপ্লবমুখর রাজনীতি নিয়ে যে সকাল-সন্ধ্যা-রাত অবধি মত্ত, হঠাৎ করেই ছায়া নামের এক কিশোরীর প্রেমে পড়ে কাহিল হয়ে পড়ল। সুযোগ পেলেই মাইছপাড়ার ভাওয়ালবাড়ির ধারে-কাছে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ক্লাস টেন পড়–য়া ছায়ারানি বসাক যখন স্কুলে যায় তখন যাত্রাপথে কথাবার্তা চালাচালি হয় দুজনার। তাও যৎসামান্য।
‘আমি একডা চিডি দিছি, পাইছনি?’ সর্বশেষ জিজ্ঞাসা সুবলের।
‘না।’ ব্যস এটুকুই। তাতেই সুবলের মাথাগরম। যে পত্রবাহক চিঠিটি দিতে গিয়েছিল সে ওদের দলের বিশ্বাসভাজন এক কর্মী।
সুবল ছুটে এল রতনের কাছে , ‘তরে বিশ্বাসও করণ যাইত না?’
‘কিতা অইছে?’
‘ছায়ারে দলের একটা জরুরী চিডি দিতে কইলাম। তুই দেছ নাই? বেশি টেন্ডল অইছস?’ রাগে ফেটে পড়ে সে।
‘ওমা, দিতাম না কেরে? ছায়ারে পাইছি না। তাইর বাপারে দিয়া আইছি। দলের কুন কাম আমি ফালাইয়া রাকছি কন?’ রতন উত্তর দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে সুবলের চোখ দুটো পাকা গাব হয়ে উঠল। বুক ধড়াস-ধড়াস করতে লাগল। রাগে-দুঃখে সে রতনের গলা চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘চুদানির ফুত, তরে কি কইছলাম চিডিডা ছায়ার বাফরে দিতে?’
‘কিতা অইছে সবুলদা? মিরকি ব্যরামের রুগির মতন কিড়িমিড়ি খাইতাছো কেরে?’
‘আমার ফুটকি মাইরা অহন কছ কিতা অইছে? হালা আচোদার বাইচ্চা, ভাগ আমার সামনে থেইক্যা, ভাগ।’
রতন থ। সুবলের মতো ভদ্র-অমায়িক স্বভাব-চরিত্রের যুবকের মুখ থেকে এসব কীরকম বিপ্লব-স্ফুলিঙ্গ বেরোচ্ছে তা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। সে কাঁদ কাঁদ গলায় আর্তনাদ করে উঠল, ‘আমি কিতা করলাম দাদা?’
‘কিছু না।’ বলে ছুটে চলে গেল সুবল।
এর কদিন বাদে চিনুভাই ওকে দল থেকে বহিষ্কার করে এক বিচারপর্বের আয়োজন করলেন ট্যাঙ্কের পাড়ের কড়ই গাছটার তলায়। সুবল মাথা নিচু করে বসে রইল। ওর বুকের ভেতরটা খাঁ-খাঁ করছে। চোখের সামনে সাজানো বাগান ধ্বংস হয়ে গেলে যে রকম তীব্র ব্যথায় শরীর-মন সব অবশ হয়ে পড়ে, ওর অবস্থাও সে রকম। বার বার দুটি পাতা একটি কুঁড়ির মতো ছায়ার পবিত্র চেহারাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বার বার মনে হচ্ছে, কেউ পেরেক ঠুকে চলেছে অন্তরে। তবু সে বসে রইল চুপচাপ। এক সময় ছায়ার বাবার হাত ধরে ওকে বলতে হলো, ‘আমার ভুল অইয়া গেছে। আমারে মাফ কইরা দ্যান কাকা। ’
সেদিন চিনুভাই একটিও কথা বলেননি ওর সঙ্গে। একপর্যায়ে এসে শুধু মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি কুনু জন্তু-জানোয়াররে দলে রাহুম না। সে যতই করিৎকর্মা হোক না কেরে, আমার দলে হের জাগা নেই। আমি সব সইতে পারি কিন্তু কুন নারীর অসম্মান সহ্য অয় না। কতা শেষ।’
একসময় বিচারপর্ব শেষ হলে পরাস্ত সুবল চলে এল নিজের বাড়ি। পেছনে পড়ে রইল মুরব্বিদের ভ্রুকুটি আর তরুণদের তরল হাস্যরস।
কদিন লজ্জায় কোথাও বের হয়নি সে। ঘরবন্দী থেকেছে দিনের পর দিন। শেষদিকে এমন হয়েছে যে, গাছের মগডালে একটা কাক দেখতে পেলেও সে চোখ সরিয়ে নিত। মনে হতো, কাকের কালো চোখ দুটি বুঝি ওকে নিয়ে মশকরা করছে।
কাকটা মাথা দুলিয়ে বলছে, ‘কিও, খুব পিরিত মারাইতে গেছলা, না? অহন মজা বুজতাছনি?’
সুবল জানালাটা বন্ধ করে দেয়। ওর মনে হতে থাকে, পুরো শহরটার কাছে সে এখন একজন কু-চরিত্রের যুবক ছাড়া কেউ নয়; সবাই ওকে ঠিসি-ঠাট্টার বস্তুতে পরিণত করে ফেলেছে।
এ রকম মানসিক অবস্থা বেশ কমাস স্থায়ী হলো। কলেজে যাওয়া-আসা বন্ধ; কোনকিছুই আর ভাল লাগে না। কিছুতেই মন থেকে বিষাদ কাটতে চায় না।
এ সময় ওর দাপুটে ব্যবসায়ী বাপ রসময় পাল ওকে ধমকে-ধামকে বসিয়ে দিলে জগতবাজারের হলুদ-মরিচ-তেলের গদিতে। প্রথমে কোনকিছু ভাল লাগে না; বার্মাটিকের তৈরি বাপ-দাদার আদি ক্যাশবাক্সটার উপর চোখ পড়লেই কেন যেন নীরব হতাশায় ককিয়ে ওঠে ভেতরটা। জীবনে সুবল কী হতে চেয়েছিল আর কী হতে চলেছে তা ভাবতে গিয়ে খালি দীর্ঘশ্বাস আর হেঁচকি উঠে আসে।
কিন্তু কদিন বাদে সে টের পেতে থাকে ক্যাশবাক্সের অপার মহিমা। টাকার গন্ধ যে রূপের মোহ থেকেও গভীর তা একটু একটু করে সে বুঝতে শুরু করে। এক সময় পুরো ডুবে যায় সেই চোরাবালিতে।
একদিন হন্তদন্ত হয়ে রতন ছুটে এল ওর কাছে। চোখেমুখে উত্তজনা ও বিস্ময়। সুবল সেদিন দোকানদারি নিয়ে মশগুল। দোকানের পাইকারি খদ্দেররা ভিড় জমাচ্ছে তখন। রামরাইল, ভাদুঘর, নবীনগর, সুহিলপুর, লালপুর, মজলিশপুর, কালিকচ্চ থেকে ওরা মালামাল নেয়ার জন্য ওর কাছে ছুটে আসছেÑ ওর নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই। বাপের ব্যবসাটাকে বড় করে তুলতে সে তখন মরিয়া। কে এসে দোকানে বসে রইল সেদিকে কোন খেয়াল নেই। তাছাড়া, রাজনীতি সংশ্লিষ্ট লোকজনদেরও এড়িয়ে চলতে চায় সে।
তবু কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে রতন বলে উঠল, ‘দাদা, চিনুভাই ত একটা আকাম কইরা ফেলাইছে। ছায়ারে ভাগাইয়া নিয়া বিয়া কইরা লাইছে। অহন বাপে বাড়িত তুলতাছে না দেইক্যা ট্যাঙ্কের পাড়ে ছায়ারে লইয়া দাঁড়ায়া রইছে।’
‘কিতা কছ তুই? গানজা খাইছস?’ চেঁচিয়ে ওঠে সুবল। স্থির হয় চোখের মণি।
‘তুমি অক্কন চল ট্যাঙ্কের পাড় কড়ই গাছের তলায়। হাজার হাজার লোক চিনুভাই আর ছায়ারে দেহনের লাইগ্গা ভাইঙ্গা পড়তাছে। ছায়ার বাফে আইছিল তাইরে বাড়িত ফিরাইয়া নিতে। তাই বাফেরে চিনে নাই। কইছে, আমার কুন বাফ নেই। আমি অনাথ। খোদা আর স্বামী ছাড়া আর কেউ নাই। কইয়াই কলমা হুনাইয়া দিছে বাফেরে। লাইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মদুর রাসূল উল্লাহ। ট্যাঙ্কের পাড় যাইবা?’ রতন তাগদা দেয়। মুখেচোখে প্রচ- উত্তেজনা।
সুবল মাথা নুইয়ে ফেলে এ সময়। তারপর মিনমিন করে উত্তর দেয়, ‘তুই যা। আমার কাম আছে।’
রতন সেদিন চলে গেলেও চিনু-ছায়ার সদ্য বিয়ের খবরগুলো সুবল ওরই মাধ্যমে পেতে থাকে। বাইরে রতনকে এড়িয়ে চলার ভান করলেও মনে মনে সুস্বাদু সেসব খবরাখবর পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকত সে। কোন কারণে একদিন রতন না এলে খুব রাগ হত। প্রথমদিকে পুরনো কারণে ওর জন্য মনে রাগ জমা হলেও এখন আর তা নেই। ছোটোভাইর মতোই ওকে দেখে সে।
একদিন রতন এসে জানাল,‘ চিনুভাইর বাফ তো ছায়ারে মাইন্যা লইছে।’
‘মাইন্যা লইছে? কেমনে?’ লেবারদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হলুদের বস্তা ওজন মাপার তক্তায় রেখে ওর দিকে ফিরে তাকায়।
‘যে সুন্দর কইরা বলে কলমা কয়Ñ হুইন্যা তো বাফে এক্কেরে টাশকি মাইরা গেছে।’ বলে সে হেসে ওঠে। সুুবল ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্য কাজে। ওর চোখের সামনে ছায়ার ঝাপসা একটা ছবি ভাসে। এখনও চিনচিনে একটা ব্যথা জাগে চেহারাটা মনে হলেই। মাত্র দু-চারদিনের হালকা ঘনিষ্ঠতা যে এখনও ওকে দগ্ধ করবে তা সে বুঝতে পারে না। একি ভালবাসা নাকি অপমানের গ্লানি?
আরেকদিন রতন ছুটে এসে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল, ‘দাদা, ছায়ার বাফে বাড়ি বেইচ্যা পগাড় পাড়?’
‘মানে?’
‘পৈরতলার ছুলেমানের কাছে বাড়ি বেইচ্চা দুই মাইয়া লইয়া আগরতলা গেছে গো। ছুলেমানই বর্ডার পর্যন্ত আগাইয়া দিছে। জলের দরে বাড়ি পাইছে হালার পুত ছুলেমান।’ রতন রাগ ঝরায়।
সুুবল কথা বলে না। মাথা নুইয়ে কাজ করে। সহসা রতন ওর দুটো হাত ধরে বলে ওঠে, ‘দাদা, তুমি কি অহনও রাগ পুইষা রাখছ আমার প্রতি? আমি কৈলাম ওইদিন বুঝতে পারি নাই তুমি ছায়ারে ভালবাসতা। আমার লাইগাই তুমার যত অপমান। আমারে মাফ কর দাদা।’ কচি ছেলেটার চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে এ সময়।
‘আরে দূর। পুরান কতা মনে কইরা কুন লাভ আছেনি অহন? বাদ দে। ’ সব ঝেড়ে ফেলে দিতে চায় সুবল।
‘তবু। ’
‘বাড়িত যা তো। আমার ত পড়ালেহা আর অইল না। তুই বিএডা পাস কইরা একটা বালা চাকরি নি যুগাড় করতাছ দ্যাখ। লেহাপড়া করগা। অহন যা ভাই। অনেক কাম পইড়া রইছে আমার।’ এ সময় ওর চোখের সামনে ছায়ার পাশাপাশি চিনুভাইর চেহারাটাও ভাসে। একদিন চিনুভাই ওর দোকানে এসেছিলেন ওর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু সে পালিয়ে যায়। ওর কময়সের হিরো চিনুভাই। ছায়ার মতো তাকেও সে ভুলতে পারে না।
সেই চিনুভাই পাগল হয়ে গেছেনÑ সেটা কি সে না দেখে থাকতে পারে?
সুবল ছুটে গেল বর্ডারবাজারের শেষ মাথায়। পরিচিত সেই বাড়ি। সামনে মাজার। মাজারের গেট পেরোলে শাক-সবজি আর ফুলের বাগান। তারপর চিনুভাইদের থাকার ঘর। ওরা তিন ভাই। সবাই আলাদা থাকেন।
বাড়িতে পা দিয়ে সুবল দেখতে পেল, অজ¯্র লোক গিজগিজ করছে এখানে- সেখানে। চিনুভাই যে শহরের একজন জনপ্রিয় বামপন্থী সংখ্যালঘু নেতা তা লোকজনের উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ দেখে ঠিক টের পায় সে।
সে বাইরে না দাঁড়িয়ে আপনজনের মতো সোজা চিনুভাইর অতিচেনা ঘরে ঢুকে পড়ে। সেখানে সবার আগে ছায়ার মুখোমুখি হলো সে। বোরখায় ঢাকা মুখ। তবু চোখ দুটো দেখেই সে বুঝতে পারে এ ছায়া ছাড়া আর কেউ নয়।
সুবল সরাসরি চিনুভাইর সামনে এসে দাঁড়াল। তিনি পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে রয়েছেন। পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। চোখে চশমা। দুহাত দিয়ে ধরে রয়েছেন পত্রিকা। মনে হচ্ছে গভীর ধ্যানে মগ্ন তিনি।
তাঁর পায়ের কাছে একটি কাঠের চেয়ার। সেখানে কালো পিঁপড়ে ভরা একটা নারিকেলের খোল। কিছু অস্থির পিঁপড়ে নারিকেলের শাঁস ছেড়ে চিনুভাইর শরীরেও বেয়ে উঠছে। সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই । তিনি পত্রিকা পড়ায় মগ্ন।
চোখের সামনে তুখোড় নেতার এ রকম অসহায় অবস্থা দেখে সুবল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না; চিনুভাইর পা জড়িয়ে সহসা ভেঁউ ভেঁউ করে কাঁদতে শুরু করে দেয় সুবল। আচমকা বানের মতো এমন হৃদয়বিদারী কান্নার গমক যে কিছুতেই থামতে চাইছে না।
তবু নেতার ধ্যান ভাঙে না। তিনি যেভাবে পত্রিকা পড়ছিলেন ঠিক সেভাবেই রয়েছেন। কেউ যে তাঁর পা জড়িয়ে কাঁদছে তা যেন কানেই ঢুকছে না!
এ সময় বোরখার ভেতর থেকে ছায়া কথা বলে ওঠে, ‘দেহ কেডা আইছে। তুমার পুরানা শিষ্য সুবলদা।’
এবার কাজ হলো; তিনি ফিরে তাকালেন সুবলের দিকে। তারপর ঘোলা চোখে হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। এ যে পাগলের হাসি তাতে কোন সন্দেহ নেই সুবলের।
এ রকম হাসি শুনে ওর উপচানো অফুরান কান্না নিমিষে বন্ধ হয়ে গেল। চিনুভাইর কাছ থেকে চট করে সরে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়।
হাসি থামার পর তিনি নারিকেলের খোলটাকে নাড়া দিয়ে কালো পিঁপড়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, ‘এরা আমার শিষ্য। হেরা হগ্গলে চিল্লাইতাছে। হাঃ হাঃ হাঃ। আমারে কি কয় জানছ ?
‘কিতা?’ বোকার মতো পাল্টা প্রশ্ন সুবলের।
‘আমি বলে কুষক পার্টি করতাম। আরে বেডারা, তরা জানছ না, কৃষক পার্টি করতে অইলে গোয়ালঘরের গু-মুতের ভেতরে থাইক্যা এক মাস গরুর লগে সহবাস করণ লাগে? জানছ না হালার পুতেরা?’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। তার হাত থেকে পুরনো পত্রিকাটি মাটিতে পড়ে যায়।
‘চিনুভাই। আপনে স্থির হন। আবার সব ঠিক অইব।’ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রবোধ জানায় সুবল।
‘খেতা পুড়ি আমি তর। এক মান্দাইলে (পিঁপড়া) ছয় পাকসেনারে খাইয়া হজম কইরা ফেলাইছে আর আমারে কছ চুপ কইরা বইয়া থাকতে? যাঃ , ভাগ আকামলার দল। ভাগ।’ বলে ফ্লোর থেকে পত্রিকাটা উঠিয়ে উল্টো করে পড়তে থাকেন তিনি।
ঘর ভরতি ম্যালা লোক। চিনুভাইর মতো নগরনেতার এ রকম করুণ পরিণতি দেখে সবাই যে দুঃখ পাচ্ছে তা নয়; বরং সুবলের মনে হলো এরা বেশিরভাগই পাগলের রং দেখতে জমায়েত হয়েছে এখানে। কষ্টের চেয়ে মজা পাচ্ছে তারা।
কিছুক্ষণ বাদে আবারও ঘরভরতি লোকজনের দিকে ফিরে তাকালেন চিনুভাই। চোখ গেল সুবলের উপর। ইশারায় ওকে কাছে ঘেঁষার ইঙ্গিত করেন; পরক্ষণে ডিমের মতো বড় বড় চোখ করে বলে ওঠেন, ‘ট্যাঙ্কের পাড়ের বড় রেইনট্রি-টা দ্যাখছস? ওইডা কৈলাম শেষ। কুনখানে আর বিষ্টি অইত নারে, আর বিষ্টি অইত না। গাছটার লগে আমিও শেষ।’ এ কথা বলার সময় কেমন ন্যাতানো মনে হয় মানুষটার কণ্ঠস্বর। ভয়-ভীতিহীন চিরচেনা বলিষ্ঠ গমগমে সেই কণ্ঠস্বর নয় চিনুভাইর। এ একেবারেই মেরুদণ্ঠহীন পরাজিত এক মানুষের মিউ মিউ।
সুবল সহ্য করতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নেয় মানুষটার চেহারা থেকে।
ফেরার সময় ছায়া সুবলের সামনে এসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘সুবলদা, আমার সব শেষ অয়া গেল। সব শেষ।’
সুবল এ কথার কোন উত্তর না দিয়ে বের হয়ে এলো রাস্তায়। ফেরার পথে সে দেখতে পেল, ট্যাঙ্কের পাড়ের কড়ই গাছটা সত্যি সত্যি করাত দিয়ে কাটা হচ্ছে। পাখিরা ভয়ে আকাশে ওড়াওড়ি করছে। হয়তো গাছটাকে নিশ্চিহ্ন করে সেখানে খোদার ঘর স্থাপন করার খায়েস ঠাঁই পেয়েছে এলাকার সব ধার্মিকদের অন্তরে!
গাছটার পাশেই ইটের গাঁথুনি শুরু হয়েছে; হয়তো কদিন পর খোদার ঘর নির্মাণের কাজটা পুরোপুরি শেষ হবে!
শীর্ষ সংবাদ: