ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক;###;মেয়াদ ও ব্যয়- দুটোই বেড়েছে

চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যেভাবে শেষ হলো

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যেভাবে শেষ হলো

রাজন ভট্টাচার্য ॥ কথা ছিল তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দ্বার খুলবে মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের। হয়নি। এরপর চার দফা সময় বাড়ানো হয়েছে। তিন দফা বেড়েছে নির্মাণ ব্যয়। নক্সায় ভুল। তাই ফের নক্সা বদল। ভুলের খেসারত হিসেবে ৬০ পিলার ভাঙতে হয়েছে। সময়ক্ষেপণ হয়েছে বারবার। উড়াল সড়কে দিতে হয়েছে ট্রাফিক সিগন্যাল! বছরের পর বছর হয়েছে জনভোগান্তি। নগরবাসী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন উন্নয়ন বিড়ম্বনা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিন ভাগে উদ্বোধন করতে হয়েছে প্রায় ৯ কিলোমিটারের ফ্লাইওভারটি, যার শেষ হলো বৃহস্পতিবার। সব মিলিয়ে তিন বছরের প্রকল্প শেষ হলো প্রায় সাত বছরে। এত গেল কষ্টের কথা। এবার আশার কথা হলো, উদ্বোধন শেষে যানজট আর ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলবে এ আশায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন সবাই। সব বাধা পেরিয়ে উড়াল সড়কটির দ্বার উন্মুক্ত হওয়ায় অন্তত এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট। অর্থাৎ রাজারবাগ থেকে মহাখালীর সাতরাস্তায় যেতে যানজটের ভোগান্তি ছিল অনেক বেশি। এখন তা পোহাতে হবে না। পুরো উড়াল সড়ক এলাকায় যানজট কমে আসবে। বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এ ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেন। তিনি বলেন, এ ফ্লাইওভার যানজট কমিয়ে মানুষের সময় বাঁচাবে; কর্মচাঞ্চল্যও বাড়বে। আর স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দৈনিক ৫০ হাজার যানবাহন এ ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে পারবে। নিচের সড়ক ব্যবহার করা যাবে আগের মতোই। তবে উদ্বোধনের পরপরই উড়াল সড়কের সবকটি লুপ দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। দুপুরের পর বাংলামোটর সিগন্যাল দীর্ঘ হয়। উড়াল সড়কের ওপরে নিচে ব্যাপক যানজট দেখা যায়। সন্ধ্যার পর পর্যন্ত এ অবস্থা দেখা যায়। ট্রাফিক পুলিশ বলছে, উড়াল সড়ক উদ্বোধনের পর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ি ইস্কাটন প্রান্তে চলে আসছে। কিন্তু বাংলামোটর-ফার্মগেট সড়কটি ভিআইপি হওয়ায় ইস্কাটন প্রান্তের সিগন্যাল অল্প সময়ের জন্য ছাড়া হয়। এ কারণে গাড়ির চাপ বাড়তি দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া উদ্বোধনের পর মৌচাক ও মালিবাগ পয়েন্টে সিগন্যাল জটও লক্ষ্য করা গেছে। সেখানে মোতায়েন করা হয় ট্রাফিক। বর্ণাঢ্য আয়োজন ॥ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী যখন ফ্লাইওভারের উদ্বোধন ঘোষণা করেন মৌচাক এলাকায় বানানো অনুষ্ঠান মঞ্চে তখন উল্লাসে মেতে উঠেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, স্থানীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র মোঃ ওসমান গণি, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ছিলেন সেখানে। গণভবনে অতিথিদের বক্তব্যের পর রাশেদ খান মেনন, সাঈদ খোকনসহ অন্য অতিথিরা মঞ্চে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তারা প্রত্যেকেই বলেন, প্রকল্পের যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে যানজটের বিষফোঁড়া অপসারণ করা হলো। এখন থেকে মৌচাক-মগবাজার এলাকায় যানজটের বদনাম হবে না। আশাকরি সবাই স্বস্তি নিয়ে চলাচল করতে পারবেন। অনুষ্ঠানের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে সকাল থেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা খ- খ- মিছিল নিয়ে মৌচাকের দিকে আসতে থাকেন। ব্যান্ড পার্টি আর নানা রকম বাদ্য বাজনার তালে তালে একের পর এক মিছিল এসে জড়ো হয়। দূরের মিছিলগুলো আসে খোলা ট্রাক ও পিকআপে। কারও গায়ে ছিল দক্ষিণ সিটি মেয়রের দেয়া কমলা রঙের গেঞ্জি ও টুপি। মৌচাক মোড়ে স্থাপন করা মঞ্চটি ছিল মালিবাগ রেলগেটমুখী। বেলা ১১টার দিকে প্যান্ডেল কানায় কানায় পূর্ণ। ১২টার আগে মালিবাগ মোড়- রেলগেটসহ আশপাশের এলাকাজুড়ে মানুষ আর মানুষ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে রাস্তার বিভিন্ন পয়েন্টে ডিজিটাল স্ক্রিন স্থাপন করা হয়। পুরো উড়াল সড়ক সাজানো হয় রং-বেরঙের পতাকা আর লাল সবুজের কাপড় দিয়ে। রঙিন বেলুনও শোভা পায়। আগের দু’রাতে পুরো উড়াল সড়কে দেয়া হয়েছিল মরিচ বাতি। নিচের অংশেও একটি সিমেন্ট কোম্পানির পক্ষ থেকে সাজাতে দেখা গেছে। সকাল থেকে শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, মালিবাগ রেলগেটসহ আশপাশের এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময় বিকল্প সড়ক ব্যবহার করে যানবাহন চলতে দেখা গেছে। ফলে কিছুটা জনভোগান্তিও পোহাতে হয়েছে যাত্রীসহ সাধারণ পথচারীদের। উদ্বোধন ঘোষণার কিছুক্ষণ পর বেলা ১টার দিকে নানা রঙের পতাকা আর লাল-সবুজ কাপড়ে সাজানো ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দ্বার উন্মুক্ত হয় উড়াল সড়কটির। এর মধ্য দিয়ে স্বস্তি আসে স্থানীয় বাসিন্দা, পথচারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। ছয় বছরের বেশি সময়ের ভোগান্তির অবসান হয়। অনেকেই ভোগান্তির কথা বলতে গিয়ে বারবার চোখ বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, দুর্ভোগের কারণে এক সময় মৌচাক মার্কেটে ক্রেতা সঙ্কট হয়। আশপাশের সবকটি দোকানে প্রায় ক্রেতা শূন্য হয়ে যায়। পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যবসায়ীদের ব্যানার নিয়ে রাস্তার কাদা পানিতে নামতে হয়েছিল। আয়োজন করা হয়েছিল সংবাদ সম্মেলনের। প্রতিদিন চলাচলের দুর্ভোগে পড়ে অনেকেই ওই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় বাসা নেয়ায় স্থানীয় ভবন মালিকদেরও বিপাকে পড়তে হয়। ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলার মধ্যেই মালিবাগ রেলগেট এলাকায় ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে একজনের মৃত্যু হয়; আহত হন আরও দুইজন। আরও একাধিক দুর্ঘটনায় আরও তিনজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন কয়েকজন। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ চলছিল। এ নিয়ে কয়েকদিন হইচই হয়। ধাপে ধাপে ব্যয় বাড়ে ॥ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১১ সালে যখন এ ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল, তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এরপর কয়েক ধাপে তা বেড়ে ১ হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ ৬৯ লাখ টাকায় পৌঁছায়। সব মিলিয়ে তিনবার ব্যয় বাড়ানো হয়। নির্মাণ কাজ প্রায় ৪০ ভাগ হওয়ার পরপরই এ ফ্লাইওভারের নক্সার ত্রুটি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন আসে সংবাদমাধ্যমে। যার সুরাহা আর হয়নি। বাঁ দিকে স্টিয়ারিংয়ের কথা মাথায় রেখে বিদেশী প্রকৌশলীর করা নক্সায় নির্মিত এ উড়াল সড়কে ডানে যাওয়া বা রাইট টার্নেও ব্যবস্থা না রাখা, ওঠা-নামার র‌্যাম্প জটিলতাসহ বেশকিছু ত্রুটির কথা সে সময় বলেছিলেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। অথচ আমাদের দেশে ডান পাশে স্টিয়ারিং তাকে। আমেরিকায় নক্সা করায় সে দেশের নিয়মানুযায়ী প্রকৌশলীরা তা চূড়ান্ত করে। ফলে অনেক ধকলের পর এ ফ্লাইওভার বাস্তবে কতটা সুবিধা দেবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৬০টির বেশি পিলার ভাঙতে হয়েছে। এছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে নক্সা পরিবর্তন করলেও আনুষ্ঠানিকবাবে তা স্বীকার করেনি ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষ। নক্সায় ত্রুটি ও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণেই তিন বছরের প্রকল্প শেষ হয়েছে সাত বছরে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার অর্থায়ন করেছে ৪৪২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ৭৭৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা দিয়েছে সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি)। তিন ধাপে নির্মাণ কাজ ॥ সময়মতো নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় জনভোগান্তি বেড়ে যাওয়ায় ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ করা হয়েছে তিন ভাগে। উদ্বোধনও হলো তিন ধাপে। এর মধ্যে একটি অংশে রয়েছে সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত, আরেকটি অংশে শান্তিনগর-মালিবাগ-রাজারবাগ পর্যন্ত এবং শেষ অংশটি বাংলামোটর-মগবাজার-মৌচাক পর্যন্ত। এর মধ্যে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত অংশটি প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর এ ফ্লাইওভারের ইস্কাটন-মৌচাক অংশের যান চলাচল উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আর ফ্লাইওভার থেকে সোনারগাঁও হোটেলের দিকে নামার র‌্যাম্পটি গতবছর ১৭ মে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। ভারতের সিমপেক্স ইনফাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও নাভানার যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান ‘সিমপেক্স নাভানা জেভি’ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান দ্য নাম্বার ফোর মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি (এমসিসিসি) ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের নির্মাণ কাজ করে। সিগন্যালযুক্ত ফ্লাইওভার ॥ দেশে প্রথমবারের মতো নির্মাণ হলো ট্রাফিক সিগন্যালযুক্ত ফ্লাইওভার! বহুল আলোচিত মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়কের দুটি পয়েন্টে সিগন্যাল রাখা হয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌচাক-মালিবাগ এলাকার যানজটের মহাভোগান্তি নিরসনে উড়াল সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ফ্লাইওভারে সিগন্যাল থাকায় যানজটের ভোগান্তি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ নতুন এই উড়াল সড়কে এখন নিত্য যানজটের চিত্র দেখার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষ বলছে, জায়গা সঙ্কটের কারণে লুপ বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তাই সিগ্যানাল পড়েছে। যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উড়াল সড়কে রয়েছে। কারও কারও মত নক্সায় ভুল হওয়ার কারণে উড়াল সড়কে সিগন্যাল দেয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। প্রকল্পের পরিচালক ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উড়াল সড়কে সিগন্যাল রয়েছে। জায়গা স্বল্পতার কারণে এ ফ্লাইওভারে সিগন্যাল থাকার কথাও জানান তিনি। বলেন, নিয়ম মেনে চললে সিগন্যালে যানজট হওয়ার কারণ নেই।
×