ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

দরিদ্রতম অঞ্চল থেকেই শ্রমজীবীরা ঢাকায় আসে

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ২৭ অক্টোবর ২০১৭

দরিদ্রতম অঞ্চল থেকেই শ্রমজীবীরা ঢাকায় আসে

কারও নজরে পড়েছে কিনা জানি না, আমার কাছে মনে হচ্ছে ঢাকা শহরে বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীর রিক্সাওয়ালার সংখ্যা ক্রমেই বিলীয়মান। এমন কি ফরিদপুরের রিক্সাওয়ালাও তাই। সাধারণভাবে এখন এসব অঞ্চলের রিক্সাওয়ালার সংখ্যা ঢাকা শহরে কম। অথচ এক সময় এই অবস্থা ছিল না। পাকিস্তান আমলে (১৯৪৭-৭১), এমন কি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথমদিকেও কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফরিদপুর অঞ্চলের রিক্সাওয়ালাদের আধিক্যই ছিল ঢাকা শহরে। চট্টগ্রাম, সিলেট, বৃহত্তর ময়মনসিংহের রিক্সাওয়ালা তখন চোখেই পড়ত না। এমন কি কর্মজীবী নারী-পুরুষও। উত্তরাঞ্চলের রিক্সাওয়ালা বা কর্মজীবী মানুষ তো দূরের কথা দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ইত্যাদি অঞ্চলের অথবা পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের রিক্সাওয়ালাও পাকিস্তান আমলে চোখে পড়ত না। এমন কি হলো যে, এখন বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফরিদপুরের রিক্সাওয়ালা ঢাকা শহরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঘর থেকে বেরোলেই যে রিক্সাওয়ালার সঙ্গে শান্তিনগর, সিদ্ধেশ্বরী, পুরানা পল্টন, মতিঝিল ইত্যাদি অঞ্চলে দেখা হয়, তাদের দেশের বাড়ি উত্তরবঙ্গের রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ অথবা পাবনা। আরও আছে জামালপুর, শেরপুরের রিক্সাওয়ালা। এমন কি যে কিশোরগঞ্জের লোক খুঁজেও ঢাকায় পাওয়া যেত না তাদের অনেকেই এখন ঢাকায় রিক্সা চালায়। এই যে পরিবর্তন এর অর্থ কি? এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ব্যবসায়িক উন্নতি, চলাচলের অগ্রগতি, দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকা- ইত্যাদির কোন সম্পর্ক আছে? এমন কি রেমিটেন্সের কথাও তোলা যায়। যে রেমিটেন্স আমাদের অর্থনীতির প্রাণবায়ু সেই রেমিটেন্সের কি এর সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে? ভিন্নভাবে বললে বলা যায় কুমিল্লা, বরিশাল, নোয়াখালী ও ফরিদপুরের রিক্সাওয়ালারা কোথায় যাচ্ছে? এরা কি ঢাকা শহর ছেড়ে দিচ্ছে? এরা কি সব বিদেশে চলে যাচ্ছে? এরা কি দোকানপাটের মালিক হয়ে ‘ভদ্রস্থ’ হয়েছে অথবা এরা হয়েছে রাস্তার হকার? নাকি বয়স্ক ফরিদপুরী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর এবং বরিশালের রিক্সাওয়ালা ও শ্রমজীবী মানুষ চলে গেছে দেশে। তাদের ছেলেমেয়েরা ঢুকেছে অফিসে-পিয়ন হিসেবে, কেরানি হিসেবে? মুশকিল হচ্ছে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য কোন জরিপের খোঁজ পাওয়া যায় না। কেন ঢাকা শহরের কাঁচাবাজারের অনেকটাতেই একেকটা জেলার আধিপত্য? কেন কিশোরগঞ্জ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় কেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও বাজিতপুরের লোকেরাই শুধু বাদাম বিক্রি করে অথবা প্লাস্টিকের জুতা? এরা কেন পেশা পরিবর্তন করছে না। কোথায় যাব এসবের তথ্যের জন্য। কার কাছে পাব এই সমাজ পরিবর্তনের কারণগুলো। শুধু ঢাকা নয়, ঢাকা শহরের আশপাশ অঞ্চল যেমন বিক্রমপুর, নবাবগঞ্জ, সাভার, কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলেও উত্তরাঞ্চলের প্রচুর লোক দৈনন্দিন কাজ করে। কেউ রিক্সা চালায়, কেউ মাল টানে, কেউ কৃষি কাজ করে। অভ্যন্তরীণ অভিবাসন ঘটছে সর্বত্র। দুই-তিন-চার বছর আগে গিয়েছিলাম নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে। সেখানেও দেখলাম রিক্সাওয়ালাসহ নানা শ্রেণীর শ্রমজীবী মানুষ যারা গেছে দেশের উত্তরাঞ্চল, এমন কি কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা থেকে। কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা থেকে এমনিতেই প্রতিবছর শ্রমজীবীরা যায় বৃহত্তর সিলেটে ধান তোলার মৌসুমে। আগে এরা যেত অবিভক্ত ভারতের অসমে। এখন সেই রাস্তা যেমন বন্ধ, তেমনি বন্ধ মিয়ানমার যাওয়ার পথও। আমার প্রশ্ন, এসব যে ঘটছে, প্রতিনিয়ত যে পরিবর্তন হচ্ছে, কেউ ওপরে উঠছে, কেউ নিচে নামছে, কেউ যেই জায়গায় ছিল সেই জায়গাতেই আছে তার কি হিসাব আছে? এর কারণ যেমন জানা দরকার, তেমনি দরকার এই পরিবর্তনের ফল কি তাও। মজার ঘটনা হচ্ছে, সবাই আসছে ঢাকা এবং তার আশপাশ অঞ্চলে। কেউ এসব অঞ্চল থেকে কাজ করার জন্য উত্তরাঞ্চলে যাচ্ছে। অথচ এক সময় ময়মনসিংহ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে উত্তরবঙ্গে অনেক লোক যেত কৃষিতে সাহায্য করার জন্য। বিক্রমপুরের বহু লোক দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আগে গেছে। তারা নানা ধরনের ব্যবসায় জড়িত। এমন কি চাঁদপুরের লোকেরাও বেশ মোবাইল। তারা আছে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, আছে নেত্রকোনায়, কোথায় নেই? ঢাকা ও আশপাশ অঞ্চলে, নোয়াখালী, কুমিল্লা, বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলের লোক কেন আসছে তার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলেও একটা ব্যাখ্যা এবারের খানা জরিপ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬’এর তথ্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় ঢাকা, বিক্রমপুর, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ঢাকার নিকটস্থ গাজীপুর ইত্যাদি অঞ্চলে দারিদ্র্য সর্বনিম্ন। আর যেসব অঞ্চল থেকে ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে লোক আসছে, সেসব অঞ্চলে দারিদ্র্যের প্রকোপ বেশি। দারিদ্র্য সর্বনিম্ন স্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বৃহত্তর কুমিল্লায়। চট্টগ্রামের অবস্থাও তাই। সিলেটের কয়েকটি অঞ্চলও তাই। বোঝা যায় দেশের যেসব অঞ্চলে আয় বেশি, দারিদ্র্য কম সেখানেই দরিদ্র অঞ্চল থেকে লোক আসছে। চালাচ্ছে রিক্সা, জড়িত হচ্ছে নির্মাণ শিল্পে অথবা করছে নানা ধরনের কাজ। বলাবাহুল্য ঢাকাতেই দেশের ‘ক্যাশের’ ৪০ শতাংশ চালু। এখানেই যত ‘মধু’। ‘মধুময়’ ঢাকাতে তাই সবাই আসছে। আসছে দুটো ভাতের সংস্থানের জন্য। এর সঙ্গে আরেকটা বিষয় জড়িত বলে মনে হয়। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ অঞ্চল ঢাকা এবং তার আশপাশ অঞ্চল, এ কথা যেমন সত্য তেমনি আরেকটি সত্যও আছে। একটু নজর দিলেই বোঝা যায়। রেমিটেন্স অঞ্চল সারাদেশ নয়। বাংলাদেশের কিছু কিছু জেলা, সেই জেলার কিছু কিছু এলাকার লোকেরা বিদেশে থাকে। সেই অঞ্চলগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ অঞ্চল সাধারণভাবে নেই। যারা রাজধানী ঢাকার সুবিধা নিতে পারছে তারাই যেতে পারছে বিদেশে চাকরি করতে। এখানে ব্যতিক্রম কিছুটা মহামান্য রাষ্ট্রপতির ‘দেশ’ কিশোরগঞ্জ, এত কাছে থেকেও এই অঞ্চল থেকে সেভাবে বিদেশে যেতে পারেনি। ঢাকার নৈকট্য একটা বিশাল বিষয়। ঢাকা থেকে যারা যত বেশি দূরে, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম বা খুলনা শহর থেকে যে অঞ্চল যত বেশি দূরে, সেসব অঞ্চল তত বেশি দরিদ্র। তাদের আয় তত কম। কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তার হিসাব বের করা দরকার। সারাবছর যেমন দরিদ্র অঞ্চল থেকে ঢাকামুখী হয় লোকজন, হয় ঢাকার আশাপাশ অঞ্চলমুখী তেমনি ঘটে আরেকটি ঘটনা। দরিদ্র অঞ্চলে বছরের কয়েকটা মাস ‘দোজখের’ মাস। তখন কাজ-কাম থাকে না। মানুষের খাওয়া পরার জন্য বড় বিপদ হয়। উপোসের উপক্রম হয়। এই সময়টা বছরের কতদিন তার কি কোন হিসাব আছে। সবাই শুধু বলে গ্রামাঞ্চলে কাজের লোক পাওয়া যায় না, কর্মজীবী পাওয়া যায় না। কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না। কিন্তু সেটা বছরের কতদিন? ফসল লাগানো এবং ফসল তোলার সময় শ্রমজীবীর অভাব হয়- এ কথা সত্য। কিন্তু বাকি সময় গ্রামাঞ্চলে কোন কাজ থাকে না। এই যেমন কার্তিক মাস। আজ কার্তিক মাসের ১২ তারিখ। সারাদেশের কৃষিতে কোন কাজ নেই। এ সময়টা গ্রামবাসীদের জন্য খুবই দুর্ভোগের। এক সময় একে বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। মানুষ না খেয়েও মারা যেত। দুর্ভিক্ষ হতো। সেই অবস্থা এখন নেই। কারণ, মানুষ আগের চেয়ে বেশি ‘গতিশীল’। বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ায় সহজেই মানুষ চলাচল করতে পারছে। এই মুহূর্তে উত্তরাঞ্চল থেকে প্রচুর লোক ঢাকায় এসেছে। কার্তিক মাসে কোন কাজ নেই। আর মাস খানেক পর এদের অনেকেই কিছু ‘ক্যাশ’ নিয়ে দেশে ফিরে যাবে। কেউ নিজের জমিতে কাজ করবে, তুলবে অগ্রহায়ণী ফসল যা আমন বলে পরিচিত। কেউ কাজ করবে অন্যের। তখন পাবে অনেক টাকা। এখন নাকি সবই চুক্তিতে হয়। চুক্তিতে বিঘাপ্রতি ধানকাটা। ধান বাড়িতে নেয়া। ধান থেকে চাল করা, অনেক রোজগার তখন। দেখা যাচ্ছে এই শ্রমজীবীরা যখন যেখানে মজুরি বেশি পায় সেখানেই যায়। এটাই স্বাভাবিক কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সারাবছর তাদের কাজ নেই। রোজগার বাড়ে, কমে, রোজগার শূন্য অনেকদিন। একবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে, আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে নামে। এ যেন তেলমাখা বাঁশের ওপরে উঠা এবং আবার নিচে নামা। দারিদ্র্য বিমোচনের এই সমস্যা সম্পর্কেও খানা জরিপে উল্লেখ আছে। মরা কার্তিকে এখন একটা ভাল খবর আছে। এক জাতের ধান বেরিয়েছে যার ফলে কার্তিক মাসের কষ্ট কিছুটা হ্রাস পাবে। কারণ ওই জাতের ধান পাকে এক-দুই সপ্তাহ আগে। যেমন এই মুহূর্তে উত্তরবঙ্গসহ দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে আমন ফসল উঠতে শুরু করেছে। অবশ্য বেশিরভাগ আমন উঠবে এক মাস পরে। তবু মন্দের ভাল কার্তিকের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে। লেখক : সাবেক অধ্যাপক, ঢাবি
×