ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকও মোবাইল ফোন রাখতে পারবেন না

প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ৩০ মিনিট আগেই কেন্দ্রে ঢুকতে হবে ছাত্রদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ৩০ মিনিট আগেই কেন্দ্রে ঢুকতে হবে ছাত্রদের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে এখন থেকে পাবলিক পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগেই পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢোকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আগামী ১ নবেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা থেকেই এ নিয়ম কার্যকর হবে। সকল শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে প্রবেশের পরই প্রশ্নপত্র খোলা হবে। এছাড়া পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা কোন ব্যক্তি কোন মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখতে পারবেন না। কেবল কেন্দ্র সচিব যোগাযোগের জন্য একটি সাধারণ ফোন রাখতে পারবেন। মঙ্গলবার সচিবালয়ে পাবলিক পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় মনিটরিং ও আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরীক্ষা সুষ্ঠু, নকলমুক্ত এবং ইতিবাচক পরিবেশে সম্পন্নের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ সোহরাব হোসাইন, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মোঃ আলমগীর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমদ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান, বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম, সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেছুর রহমান, র‌্যাবের প্রতিনিধি মেজর রাহাত, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের যুগ্ম-পরিচালক শিরিন আক্তার উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র, তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আামরা স্ট্রংলি বলছি আধ ঘণ্টা আগে পৌঁছাতে হবে, না হলে ঢুকতে দেয়া হবে না। এটা যদি বলে ফেলি তবে আমরা আর ফিরতে পারব না। যেহেতু প্রথমবার, যদি ছয় মাস আগে বলতে পারতাম। তাই আমরা বলছি এবারের জেএসসি-জেডিসিতে ঢুকতে দেয়া হবে কি না সেটা বিবেচনা করা হবে। আমার বলি অবশ্যই ঢুকতে হবে, না হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কি ব্যবস্থা নেয়া হবে পরে বোঝা যাবে। আগামী বছর থেকে আমরা ছয় মাস বা তিন মাস আগে থেকে প্রচার শুরু করব। আধ ঘণ্টা আগে না ঢুকলে ঢুকতে পারবে না কেউ। আগামী বছরের ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি পরীক্ষা হবে। আমরা আগেই বলে দেব আধ ঘণ্টা আগেই পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে হবে। এছাড়া পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা কোন ব্যক্তি কোন মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখতে পারবেন না। শুধু পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব যোগাযোগের জন্য একটি সাধারণ ফোন সঙ্গে রাখতে পারবেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে জড়িত বিজি প্রেস থেকে শুরু করে সকল কর্মকর্তা এবং তাদের আত্মীয়রাও মনিটরিংয়ে রয়েছেন মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, এ পরীক্ষায় যাতে কোন অনিয়ম, নকল বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা না ঘটে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলকে তীক্ষè নজর রাখতে হবে। পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কোচিং সেন্টারের একটি বড় বাণিজ্যের কারণ হলো যেখান থেকে প্রশ্ন আউট হলে সঠিক প্রমাণিত হয় সেখানে ব্যবসাটা পরের বছর তাদের ভাল হয়। ভবিষ্যতে আমাদের যে আইন হচ্ছে তাতে কোচিং সেন্টারই থাকবে না। সচিব বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে এবার পরীক্ষা শুরু হওয়ার ৩০ মিনিট আগেই পরীক্ষার হলে ঢোকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সে অনুযায়ী সকাল সাড়ে নয়টার পর কোন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা হলে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। প্রথমবারের মতো এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাই পরীক্ষা হলে ৩০ মিনিট আগে না এলে প্রবেশ করতে দেয়া হলেও অন্য কোন ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে আগামী পাবলিক পরীক্ষার ৩ মাস আগেই এই নির্দেশনা জানিয়ে দেয়া হবে এবং পরীক্ষা শুরুর আগে ৩০ মিনিটের মধ্যে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। পরীক্ষার্থীরা হলে প্রবেশের পরই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র খোলা হবে। সভায় গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম জানান, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গত এক বছরে নয়টি মামলায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের ৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে এইচএসসিতে ১৮ জন, এসএসসিতে ৩৫ জন এবং অন্যরা মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার সময় গ্রেফতার হয়। এসব মামলার কোনটারই অভিযোগপত্র হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, শীঘ্রই চার্জশীট দেয়া হবে। কেন্দ্র সচিবরা ক্যামেরাবিহীন মোবাইল ফোন ব্যবহারের বিষয়টি যথাযথভাবে মানছেন না অভিযোগ করে তিনি বলেন, এটা যাতে কড়াকড়িভাবে মানা হয় তা দেখতে হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। বলেন, এমসিকিউ প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে শিক্ষকরা জড়িত, আশা করব ভবিষ্যতে তারা এই কাজে জড়াবেন না। তিনি আরও জানান, এবারের মেডিক্যালের প্রশ্ন কিনতে আসা কয়েক পরীক্ষার্থী ও তাদের বাবা-মাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে পরীক্ষার্থী ও তাদের মায়েদের ছেড়ে দিলেও বাবাদের নামে মামলা করা হয়। মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে রাতে প্রশ্ন নিতে না গেলে রক্ষা পেতে পারতের বলেই ইঙ্গিত দিলেন এ কর্মকর্তা। সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মোখলেছুর রহমান বলেন, পরীক্ষার দিন সকালে কেন্দ্র সচিব ছাড়া কারও কাছেই মোবাইল থাকবে না- এটা নিশ্চিত করতে পারলেই প্রশ্ন ফাঁস হবে না। কারণ ফোনে ছবি তুলে তারা বাইরে প্রশ্ন পাঠিয়ে দেন। সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হলে তার এক ঘণ্টা আগে প্রশ্ন বাইরে চলে আসে জানিয়ে মোখলেছুর রহমান পরীক্ষার্থীদের আগেই পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকিয়ে তারপর প্রশ্নের প্যাকেট খোলার পরামর্শ দেন। র‌্যাবের প্রতিনিধি মেজর রাহাত জানান, পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে হাতে হাতে প্রশ্ন দেখা যায়। বৃষ্টি না হলেও হাতে হাতে ছাতা নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক প্রশ্নের সমাধান দেখেন। সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। নইলে এত জায়গা, এত মানুষ তাই সম্ভব হবে না। পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করে তিনি বলেন, ওরা হচ্ছে প্রশ্ন ফাঁসের ওয়ান অব দ্য মিডিয়া। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআইয়ের যুগ্ম-পরিচালক শিরীন আক্তার পরীক্ষাকেন্দ্রে আরও নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেন। শিরীন আখতার পরীক্ষা কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো এবং ফেসবুকে প্রশ্ন ছড়ানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন। সকলের বক্তব্য শোনার পর সচিব সোহরাব হোসাইন বলেন, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের যতই ধরছেন শেষ হচ্ছে না। যত কিছুই করি এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না এটাই হলো বাস্তবতা। পরীক্ষা কেন্দ্র বা উপজেলা পর্যায়ে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা চলছে জানিয়ে সচিব বলেন, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন, শতভাগ নিরাপদ হলেই এটা বাস্তবায়ন করা হবে। কারণ এর সঙ্গে লাখ লাখ পরিবারের ইনভল্বমেন্ট, কোন ভুল হওয়া যাবে না। পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন ছাপিয়ে পরীক্ষা নিতে পারলে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না। এমসিকিউ পদ্ধতি সম্পূর্ণ তুলে দেয়ার পক্ষে নিজের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষকদের ব্যবহার করে হলের সব পরীক্ষার্থীকে এমসিকিউর পুরো নম্বর পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রশ্ন পদ্ধতি রাখার কোন মানে নেই। এদিকে আগামী ১ নভেম্বর শুরু হবে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। ১৮ নবেম্বর পর্যন্ত চলবে এই কার্যক্রম। সকাল ১০টা থেকে এই পরীক্ষা শুরু হবে। এবার থেকে জেএসসির পরীক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা এবং চারু ও কারু“কলা বিষয়ের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। তবে এ বিষয়গুলোর ওপর শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের নম্বর পাঠাবে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে। এরপর সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র পরীক্ষা চলাকালীন বোর্ডের ওয়েবসাইটে অনলাইনের মাধ্যমে ধারাবাহিক মূল্যায়নের প্রাপ্ত নম্বর এন্ট্রি করে পাঠাবে। তবে অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের এই তিন বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে।
×