ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা নূর

রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযানের প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা বিতাড়ন অভিযানের প্রেক্ষাপট

সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ও নির্মম-নৃশংস অভিযানে লিপ্ত হয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। মিয়ানমারে দীর্ঘকাল ধরে নিষ্পেষিত মুসলিম ধর্মাবলম্বী এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে স্বদেশভূমি থেকে বিতাড়নের বা উৎখাতের এই নৃশংস পন্থা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অবৈধভাবে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের যাবতীয় নাগরিক অধিকার সেই ১৯৮২ সাল থেকেই সেখানকার সেনা শাসকেরা হরণ করে বসে আছে। এই নির্মম সেনা অভিযানের দরুন লাখো লাখো রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যত্র আশ্রয় লাভের জন্য ছুটে চলেছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক। অবশ্য এবারই প্রথম নয়, বেশ কয়েক বছর আগেও অনুরূপ অভিযানে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এদের উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্য উভয় সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে বৈকি! একদিকে ঘটনার মানবিক দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে, অন্যদিকে এই রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যত্র জঙ্গী তৎপরতার আশঙ্কায় শঙ্কাবোধ করছে। এই শঙ্কা যে শুধু বাংলাদেশের একার তা কিন্তু নয়, প্রতিবেশী ভারতও অনুরূপ আশঙ্কায় শঙ্কিত। আর এর পেছনে যুক্তিসিদ্ধ ও প্রমাণসম্পন্ন কারণও আছে নিশ্চয়ই। রোহিঙ্গা ¯্রােত বাংলাদেশের দিকে যেভাবে ধাবমান তাতে সঙ্গত কারণেই এমনটা মনে করা যায় যে, এই সমস্যা অধিক জনসংখ্যা ভারাক্রান্ত এবং নানা সমস্যার আবর্তে নিপতিত বাংলাদেশের জন্য সঙ্কট ঘনীভূত করতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করায় বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এবং তারা ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য-সহযোগিতার হাত মেলেও ধরেছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সেনা শাসকদের এই জঘন্য ও পৈশাচিক অভিযানের নিন্দাও করে চলেছে। এত গেল ঘটনার এক দিক। মুদ্রার অপর পিঠটি কিন্তু এক্ষেত্রে যেন আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ফলে মিয়ানমারের ঘটমান পরিস্থিতির প্রকৃত স্বরূপটি কেউই তলিয়ে দেখছে না। সামগ্রিক অবস্থাটির বিচার-বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হবে যে, মিয়ানমারে বিশেষত রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা উগ্রবাদীরা সেখানকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কিছুকাল ধরে জিহাদ চালিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত নৃশংসতার বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সেখানকার সেনাবাহিনী বা শাসকরা কতখানি সহনশীলতার সঙ্গে দেখবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে সেখানকার এই সন্ত্রাস ও হিংসা-হানাহানি থামানোর প্রয়াস-প্রচেষ্টা কতখানি সফল হবে তা বলা দুষ্কর। রাখাইন রাজ্যেই মিয়ানমারের অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বাস। কিন্তু এই অঞ্চলটি বেশ কিছুকাল ধরেই দেশী-বিদেশী জিহাদীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। স্থানীয় রোহিঙ্গা জিহাদীদের সঙ্গে আইসিস, আল কায়দা ও অন্য বেশ কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের গভীর সম্পর্ক থাকার অভিযোগ রয়েছে। উপরন্তু, তারা সৌদি আরব ও পাকিস্তানের জঙ্গীসম্পৃক্ত সংগঠনসমূহের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য লাভ করে থাকে বলে জানা যায়। আরও জানা যায় যে, রাখাইনের প্রধান জঙ্গী গ্রুপ ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ যা ‘হারাকা আল ইয়াকিন’ নামেও পরিচিত, সৌদি আরবভিত্তিক রোহিঙ্গা অভিবাসীদের একটি কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। আজ রোহিঙ্গাদের ওপর যে দুর্যোগ নেমে এসেছে তার পশ্চাদভূমিতে মিয়ানমারের বাইরে থেকে আসা এসব সাহায্য-সহযোগিতাই মূলত দায়ী। কেননা, এই জাতীয় মদদ লাভ করেই রাখাইনের রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি ও জঙ্গীরা সেনাছাউনি বা ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এরই জেরস্বরূপ সেনাবাহিনী নৃশংসতা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা জঙ্গীদের সঙ্গে এই জাতীয় বাইরের সন্ত্রাসী সংগঠনের, বিশেষ করে আইসিসের সম্পর্কের কারণেই ভারত (সম্প্রতি সেখানে অবৈধভাবে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে) সরকার রোহিঙ্গাদের এই অনুপ্রবেশকে ভারতের জন্য এক মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশও কিন্তু রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাইরের অন্যান্য জঙ্গী বা জিহাদীর সম্পর্ক বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা এবং রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত বেধে যায়। রাখাইনরা নিজ ভূমিতে তখন সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত ছিল। এই সম্প্রদায়গত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে উভয়পক্ষেই নারকীয় হত্যাকা-, লুটতরাজ ও সহায়-সম্পত্তির ব্যাপক ধ্বংসসাধন চলে। প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষ যাদের অধিকাংশই ছিল রোহিঙ্গা- বাস্তুচ্যুত হয়। আর এতে করে রোহিঙ্গাদের মাঝে জঙ্গী মনোবৃত্তি ভীষণভাবে ফিরে আসে। শুরু হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গেরিলা পদ্ধতির হামলা। অতি সাম্প্রতিককালে অনুরূপ হামলার শিকার হয় রাখাইনের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ও কিছু ক্ষেত্রে আবার রাখাইন বেসামরিক নাগরিকরা। গত এক বছরে এই হিংসা-হানাহানি মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পায়। গত ২৫ আগস্ট প্রত্যুষে প্রায় ৩০টি পুলিশী থানার ওপর ও একটি সেনা ঘাঁটিতে সমন্বিত জঙ্গী হামলা চালানো হলে এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভয়াবহ সেনা অভিযান শুরু হয় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। ফলে তারা রাখাইন রাজ্য থেকে আজ সম্পূর্ণভাবে উৎখাত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমতাবস্থায়, মিয়ানমারের এই সন্ত্রাস আর হিংসা-হানাহানি বন্ধ করতে হলে সেখানকার গভীরে প্রোথিত জাতি-বিদ্বেষ দূর করা অপরিহার্য। এই বিষয়টির সুরাহা না করলে সেখানকার দীর্ঘদিনের ভয়ঙ্কর হানাহানি বাড়বে বৈ কমবে না। রোহিঙ্গারা যাতে জিহাদী তৎপরতা থেকে সরে আসে সেই ব্যবস্থা নেয়াটাই তাই এই সঙ্কট সমাধানের জন্য সবচেয়ে জরুরী। মিয়ানমার বিশ্বের অন্যতম প্রধান একটি জাতিগত বৈচিত্র্যময় দেশ। এর ভৌগোলিক অবস্থান একে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এবং চীন ও ভারতের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক সেতু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে মিয়ানমার তার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সেতুবন্ধন রচনায় যারপরনাই ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মীরাই দেশটি শাসন করে আসছে। আর ওই শাসকরা দেশের অন্য সব সংখ্যালঘুর মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ আর গৃহযুদ্ধ বজায় রাখায় বিষয়টিকে চাঙ্গা রাখার মধ্যেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। তাদের এই ব্যবস্থাকে ভৌগোলিক বর্ণবাদ নামে অভিহিত করা চলে নিঃসন্দেহে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারাই সবচেয়ে বেশি নিগ্রহ-নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারে রয়েছে ১৩৫ ধরনের সম্প্রদায়। তার মধ্যে রোহিঙ্গারাই একমাত্র যাদের সেখানকার সরকার, এমনকি অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও বহিরাগত বলে মনে করে। সরকারীভাবেও তারা ওই ১৩৫ সম্প্রদায়ের একটি হিসেবে ঠাঁই পায়নি। বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটেছে এমন অভিযোগ তুলে ১৯৮২ সালে সেখানকার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় এবং এরপর থেকেই প্রকৃত প্রস্তাবে রোহিঙ্গারা ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে পড়েছে। অতঃপর মিয়ানমারে যত সরকারই এসেছে তারা সবাই রোহিঙ্গাদের প্রতি ওই একই বিদ্বেষপরায়ণ মানসিকতা পোষণ করে চলেছে। তাদের অভিযোগ এই যে, অতীতে রোহিঙ্গাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এটাই প্রমাণ করে, তারা কখনোই নিজেদের মিয়ানমারের অংশ বলে মনে করে না। রোহিঙ্গারা ‘রাষ্ট্রহীন বাঙালী’ হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৭১-এ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হাজার হাজার রোহিঙ্গা তাদের স্বপ্নের পাকিস্তানে আশ্রয় লাভ করেছিল আর সেখানেও আজ তারা ‘রাষ্ট্রহীন’ হিসেবে বসবাসরত। সে যাই হোক, সত্য এই যে, একটি সর্বগ্রাহ্য জাতীয় পরিচিতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার দরুনই আজ সেখানে এই জাতিগত বিদ্বেষ ও সংঘাত অব্যাহত রয়েছে এবং তা সন্ত্রাসবাদের অগ্নিতে নিত্য ঘৃত সংযোগ করছে মাত্র। ফলে এই বিপুল সম্ভাবনাময় এবং বিপুল সম্পদশালী দেশটির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় মিয়ানমারে প্রয়োজন সেখানকার সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করে সমতাভিত্তিক একটি ফেডারেল পদ্ধতি প্রবর্তন করা। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে যত ধরনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে সাকুল্যে তাদের সংখ্যা দাঁড়াবে মোট জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ। তবে দেশের মোট আয়তনের অর্ধেক এলাকাজুড়েই রয়েছে এদের বসবাস। রাখাইনে সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন অবিলম্বে বন্ধ করা জরুরী। একই সঙ্গে বেসামরিক লোকদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন বন্ধ করা না হলে জঙ্গীবাদী তৎপরতা ঠেকানো তো যাবেই না, আরও দ্রুত তা বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। তবে মিয়ানমারের সেনা অভিযান বন্ধ করার ও রোহিঙ্গাদের রক্ষার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করছে তা যেমন জরুরী, একই সঙ্গে সেখানকার দীর্ঘমেয়াদী তথাকথিত ইসলামী জঙ্গী তৎপরতার বিষয়টিকেও এক্ষেত্রে তাদের সবিশেষ আমলে নেয়াটাও জরুরী। কেননা, একথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, ওই জিহাদী তৎপরতা অব্যাহত থাকার কারণেই আজ রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার যোগাড়! লেখক : সাংবাদিক
×