ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এই সিদ্ধান্ত আনন্দের

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

এই সিদ্ধান্ত আনন্দের

তামাকজাত পণ্যের ওপর কর সারচার্জ থেকে প্রতিবছর সরকারী কোষাগারে আমরা পাই ৩০০ কোটি টাকা। গত ১৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় এ ৩০০ কোটি টাকা তামাক নিয়ন্ত্রণেই ব্যবহারের একটি নীতির খসড়া অনুমোদন করেছে। এ টাকা এখন তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৪টি খাতে নীতির আওতায় ব্যবহার করা হবে। এই সিদ্ধান্ত আমাদের সকলের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। উল্লেখ্য, ২০১৪ সাল থেকে ১ শতাংশ হারে এ সারচার্জ নেয়া হয়। এ অর্থ আগেও ব্যয় হতো। তবে এখন এই অর্থ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। চার পৃষ্ঠার এ নীতিমালায় আদায়কৃত সারচার্জ ব্যয়ে ১৪টি খাত নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিবছর এ খাতগুলোতে ওই টাকা ব্যয় করা হবে। এর মধ্যে তামাক চাষীদের ভর্তুকি প্রদান ও অন্য ফসল চাষে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন, তামাকজনিত সংক্রমক রোগ প্রতিরোধসহ নানা কারণে এ নীতিমালা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সাল থেকে তামাকজাত পণ্যের ওপর এক শতাংশ হারে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করে সরকার। এরপর ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ এই তিন অর্থবছরে সারচার্জ বাবদ আদায় হয়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। তবে নীতিমালার অভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এ অর্থ তিন বছর ধরে অলস পড়ে আছে। স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতিতে এ তহবিলের অর্থ ব্যবহার করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী পরিচালনাসহ জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল- এনসিটিসির কার্যক্রম পরিচালনা, গণমাধ্যমে প্রচারণা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে টোব্যাকো ট্যাক্স সেলের (টিটিসি) কার্যক্রম পরিচালনা, গবেষণা, কুইট লাইন স্থাপন, তামাকজনিত অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান, তামাক চাষীদের বিকল্প ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করা ও স্টেকহোল্ডারদের দক্ষতা উন্নয়নে ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ঞড়নধপপড় করষষং অর্থাৎ তামাক মৃত্যু ঘটায়। বেশ ক’বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ ধরনের সেøাগান দিয়ে সারা বিশ্ববাসীকে জানাতে চেয়েছে পৃথিবীতে তামাকের কারণে যে মৃত্যু হয় তা অন্য যে কোন কারণে মৃত্যুর চাইতে বেশি। গবেষণায় বলা হয়েছে, যক্ষ্মা, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, এইডস, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, প্রসবকালীন মৃত্যু, ক্যান্সার, আত্মহত্যা, নরহত্যা, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ইত্যাদি মৃত্যুকে একত্রিত করলে যত সংখ্যা হয়, তার চেয়েও বেশি মৃত্যু হয় তামাকজনিত কারণে। তামাকের কারণে সারাবিশ্বে প্রতিবছর মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ অর্থাৎ প্রতি ৬ সেকেন্ডে ১ জন। বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ। তাছাড়া ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেন এবং ১২ লাখ মানুষ তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ (৪৩%) প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন। ৫৮% পুরুষ এবং ২৯% নারী ধোঁয়ামুক্ত বা ধোঁয়াহীন তামাক সেবন করেন। ফলে বাংলাদেশে তামাকের কারণে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি । বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত মৃত্যুর ৩০% , ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর ৩৮% , ফুসফুসে যক্ষ্মার কারণে মৃত্যুর ৩৫% এবং শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মুত্যুর ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী ধূমপান (ডঐঙ ২০১৩) । বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২০০৪ সালে ছিল জিডিপির ৩%-এর বেশি, এর মধ্যে ৫,১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ধূমপানজনিত রোগের চিকিৎসায় এবং ধূমপানজনিত অসুস্থতার কারণে জাতীয় উৎপাদনশীলতায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫,৯০০ কোটি টাকা। এদেশে তরুণদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা সম্প্রতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায় ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের প্রায় ৭% কিশোর-কিশোরী তামাক পণ্য ব্যবহার করে (এঅঞঝ ২০১৩) । অন্যদিকে পৃথিবীতে যেসব দেশে সিগারেটের মূল্য অত্যন্ত কম বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। বিড়ি ও তামাক জাতীয় দ্রব্য আরও সস্তা। এদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন দুধ, ডিম ও চালের তুলনায় তামাকপণ্য সস্তা। ২০১৬ সালে জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন” শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পীকার্স সামিটের সমাপনী বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তামাককে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন। গ্লোবাল সার্ভে অনুযায়ী গত ৭ থেকে ১০ বছরে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার ৫ থেকে ৭ শতাংশ কমেছে। এটি আমাদের জন্য স্বস্তিকর। বর্তমানে কর, ধূমপানমুক্ত এলাকা, জরিমানা, চাষ বন্ধ ও সচেতনতা কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করলে তামাকের ব্যবহার হ্রাস পাবে। যার মধ্যে এফসিটিসি (ঋঈঞঈ) বাস্তবায়ন অন্যতম। তামাক কোম্পানির মাধ্যমে যেসব তামাকজাত দ্রব্য মানুষের রোগ সৃষ্টি করে এবং অকালে মানুষ মৃত্যুবরণ করে তা রোধ করতেই এই সারচার্জ ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। তামাকজাত দ্রব্য যতদিন বন্ধ করা না হবে ততদিন তাদের এ সারচার্জ দিয়েই মানুষের জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করা হবে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভাল উদ্যোগ। তবে সচেতনতার বিকল্প নেই। মানুষ যতদিন না বুঝতে শিখবে এ তামাক বস্তুটি মৃত্যুর কারণ বা অন্যের মৃত্যুর কারণ ততদিন হয়ত আমরা এভাবেই মানুষের জীবন বাঁচাতে সচেষ্ট হব। অবশেষে মন্ত্রিসভা বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে ‘স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতি-২০১৭’। জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ নীতিটি চূড়ান্ত করতে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছি। এরই প্রেক্ষিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য বিবেচনায় সব তামাকপণ্যের ওপর ১ শতাংশ হারে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করা হয়। এখন থেকে প্রতিবছর ৩০০ কোটি টাকা তামাক পণ্য ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থে ব্যবহার হবে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। পরিশেষে বলতে চাই, এ সারচার্জের পরিমাণ ১% থেকে বৃদ্ধি করে ২% করা হলে হয়ত প্রতিবছর ১২ লাখ রোগাক্রান্ত ও ১ লাখ মানুষের মৃত্যু রোধের কাজে লাগান যেত। তবে সচেতনতার বিকল্প নেই। এই অর্থের একটি বড় অংশ সচেতনতার কাজে ব্যবহার হলে মানুষ তামাক একদিন ছাড়বেই, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। লেখক : সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স [email protected]
×