ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

রিপোর্টারের ডায়েরি

রিক্সাচালকের কষ্ট ২০ অক্টোবর শুক্রবার, সকাল থেকেই অবিরাম বৃষ্টি। কখনও মাঝারি কখনও ভারি বৃষ্টি। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে জানতে পারলাম রাস্তা-ঘাট পানি জমে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে বেলা দুটায় অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু বাসার বাইরে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টি না বরং বইছে হাল্কা বাতাস। ভাবলাম আজ অফিসে যাব না। কিন্তু অফিসে না গেলে তো কিছুতেই চলবে না। তাই বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে বৃষ্টি কিছুটা কমলে বাসার গেটে দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। সামনে দিয়ে বেশ ক’টি রিক্সা যেতে দেখলেও কোন চালকই যাত্রী পরিবহনে রাজি হচ্ছে না। কারণ, জিজ্ঞেস করলে এক রিক্সাচালক বললেন, কিভাবে যাব বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে রাজধানীর সমগ্র এলাকা। আর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা যেভাবে তলিয়েছে তাতে এখান থেকে বের হয়ে মেইন রোডে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। এক পর্যায়ে অনেক বলে-কয়ে একজন রিক্সাচালককে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ৩ গুণ ভাড়ায় কুড়িল বিশ্বরোড ফ্লাইওভারের নিচে যেতে রাজি করালাম। তবে রিক্সায় উঠে বসার পর আবার বৃষ্টি বেড়ে যায়। এরই মধ্যে একটু দূরে গিয়েই রিক্সাচালক হাঁপিয়ে যান। আর চালাতে পারছিলেন না রিকশা। এ্যাপোলো হাসপাতালের সামনে থেকে যে রাস্তাটি ৩০০ ফুট রাস্তা পর্যন্ত গেছে সেপথ ধরে টেনে টেনে রিক্সাটি নিয়ে যাচ্ছেন চালক। কিন্তু প্যাডেল চালাতে ব্যর্থ হয়ে কোমড় সমান পানি ঠেলে রিক্সা এগিয়ে নিতে তাকে চরম কষ্ট করতে হচ্ছে। তার এ কষ্ট দেখে একবার মনে হয়েছিল বাসায় ফিরে যাই। কিন্তু অফিসে না গেলে যে চলবেই না। রিক্সা সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়ে চালক কিছুক্ষণ পর পর থেমে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে যেন আমাকে বলতে চান আর পারছি না। এদিকে এ রাস্তায় যেতে যেতে বেশ কটি যানবাহনকে পানিতে ডুবে বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। এর মধ্যে কোন কোন যানবাহন বেশ কজন মিলে ঠেলে ঠেলে উঁচু রাস্তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ১০ মিনিটের রাস্তা প্রায় ১ ঘণ্টায় অতিক্রম করে রিকশাচালক আমাকে কুড়িল বিশ্বরোডে নামালেন। ভারি বৃষ্টির কারণে তার সমস্ত শরীর ভিজে যায়। তবুও অনেক কষ্ট স্বীকার করে আমাকে সেখানে পৌঁছে দেয়ার জন্য রিক্সাচালকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসি নিকটস্থ বাস স্টেশনে। এই জায়গাটি অপেক্ষাকৃত উঁচু বিধায় সহজেই বাসে উঠতে পারলাম। কিন্তু বাস একটু সামনে যেতেই সাহারা স্টেশনে দেখলাম হাঁটু পানি। মানুষ হাঁটু পানি অতিক্রম করে বাসে উঠছে। মগবাজার পর্যন্ত আসতে আসতে অধিকাংশ এলাকাই পানির নিচে তলিয়ে থাকতে দেখলাম। কিন্তু মগবাজার এসে বাস থেকে নেমে দেখলাম বৃষ্টিও নেই রাস্তায় তেমন পানিও নেই। মগবাজার মোড় থেকে আবার রিক্সায় চড়ে অফিসে আসতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অফিসে এসেও সেই রিক্সাচালকের কষ্টের কথা ভাবতে থাকলাম। সেদিন ছিল আমার লেইট নাইট ডিউটি। মধ্যরাত পর্যন্ত অফিসেই ছিলাম। অফিস থেকে যখন বের হই তখনও বৃষ্টি। সিএনজি অটোরিক্সায় চড়ে ভাবছি শেষ পর্যন্ত বাসা পর্যন্ত যেতে পারব তো। আসার সময় রাস্তায় যে পানি দেখে এসেছি, সেরকম পরিস্থিতি হলে তো সিএনজি অটোরিক্সাটি ডুবে যাবে। কিন্তু যত সামনের দিকে যাচ্ছি ততই দেখছি বৃষ্টির মাত্রা কম। আর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করে দেখলাম বিকেলে রাস্তায় যে পানি দেখে গেছি সে পরিস্থিতি নেই। তাই এখন রাস্তা যানবাহন চলাচলের উপযোগী হয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত নির্বিঘেœ বাসায় পৌঁছতে পারি। শরীফুল ইসলাম সত্য লুকানোর চেষ্টা ৬ অক্টোবর শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টা। পুরান ঢাকার কাপ্তান বাজারে যাব। তাই ঘুম থেকে উঠে মুখে কোন রকমে একটু পানি দিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য বাজার করব। সঙ্গে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম নোট বুকে লিখব। শুক্রবার বিকেলে অফিসে এসে আবার আমাকে বাজার পরিস্থিতির ওপর রিপোর্ট করতে হবে। এক সঙ্গে দুই কাজ হচ্ছে বিধায়, বাজার করতে আমার তেমন একটা আলসেমিও লাগেনি। অনেকটা রথ দেখা ও কলা বেচার মতো আর কি! নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে দোকানদারকে সবার আগে চালের দাম জিজ্ঞাসা করা আমার এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এমনও হয়, যে জিনিস কিনব তার চেয়ে বেশি আগ্রহ চাল নিয়ে। এর আগে পেঁয়াজ নিয়ে এ ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। আর এখন চালের সঙ্গে যোগ হয়েছে কাঁচা মরিচ। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে এই তিনটি পণ্যেরই দাম এখন বেশি। গত পাঁচ বছর ধরে বাজারের ওপর রিপোর্ট করার কাজটি নিয়মিতভাবে করছি। এ কারণে কোন জিনিসের দাম বাড়লে বা কমলে সেই পণ্য নিয়ে আগ্রহের যেন শেষ নেই আমার। এ কারণে ওই পণ্যটির ওপর খবর দিয়ে অন্তত একটি দিন পার পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে ভোক্তারাও বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হবেন। যা হোক, বাজার সংক্রান্ত সঠিক খবর পাওয়ার জন্য আমি আবার কয়েকজন আড়তমালিক, আমদানিকারক, পাইকার এবং সর্বশেষ খুচরা ব্যবসায়ীর ফোন নাম্বার ও ঠিকানা সংগ্রহ করে রেখেছি। কাওরান বাজার, কাপ্তান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এবং শ্যামপুর বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রায়ই পণ্যমূল্য নিয়ে কথা হয়ে থাকে। এরকমই একজন চালের ব্যবসায়ী মোঃ নূরু মিয়া। আমি ডাকি নূরু ভাই বলে। যিনি পাইকারি ও খুচরা মূল্যে চাল বিক্রি করে থাকেন। গত কয়েক বছরে অনেকবার কথা হওয়ায় তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন, আমিও তাকে আস্থায় নিয়েছি। কিন্তু সম্প্রতি চালের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে তিনি যেন কিছুটা শঙ্কিত, আতঙ্কিত এবং আমাকেও যেন সত্য লুকানোর চেষ্টা! এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসে চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় একদিন হঠাৎই হাজির হই তার দোকানের সামনে। আমাকে দেখে, কেমন আছি জানতে চেয়ে বললেন, আপনি তো দাম না বাড়লে আর আসেন না। এখন চালের দাম বেড়েছে আপনার দেখা পাচ্ছি। তার কথা শেষ না হতেই আমার জিজ্ঞাসা, নূরু ভাই মোটা চালের দাম কত? ওই সময় মোটা চাল জাত ও মানভেদে ৫৪-৫৮ টাকায় বিক্রি হয়। তিনি বললেন, লিখে দেন, কেজিতে ৩ টাকা কমেছে। আর কয়েকটি চালের দাম নিয়ে তার দোকান থেকে বেরিয়ে আসি। দাম যাচাইয়ে আরেক দোকানে যাই, ওই সময় একজন চাল ক্রেতাও পেয়ে গেলাম। তিনি মোটা চাল কিনছিলেন। নূরু ভাইয়ের দেয়া তথ্যের চেয়ে ৩ টাকা বেশি দামে চাল কিনছেন তিনি। ক্রেতা চাল নিয়ে চলে যাওয়ার পর ওই খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে দাম নিয়ে কথা বলতে থাকি। তিনি জানালেন, আসলে খুচরায় কোন দামই কমেনি। পুলিশ, মনিটরিং টিম এবং সাংবাদিক আসলে সব সময় পণ্যের দাম কমিয়ে বলা হয়। আমি আপনাকে সত্য কথা বললাম। তিনি আরও জানালেন, এই চাল বেশি দাম দিয়ে কেনা হয়েছে, এখন কম দামে বিক্রি হলে আমাদের লোকসান করতে হবে। আমরা ছোট ব্যবসায়ী, লোকসানে বিক্রি করলে আমাদের চলবে কি করে? আমি আর কথা না বাড়িয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে আসি। বিকেলে অফিসে বসে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মূল্য তালিকা বের করি নেট সার্চ দিয়ে। সেখানেও দেখলাম খুচরায় চালের দাম কমেনি। নূরু ভাইয়ের প্রতি মনে মনে রাগ হলো। তার প্রতি দীর্ঘদিনের আস্থাও নষ্ট হয়ে গেল। তিনি বেশি দামে বিক্রি করছেন অথচ সাংবাদিকদের বলছেন, দাম কেজিতে ৩ টাকা কমেছে। অবশ্য এই ঘটনার দু’দিন পর বাজারে খুচরা বাজারে সত্যি সত্যি কেজিতে দাম ৩ টাকা কমে যায়। মুনাফা করা দোষ নয়, কিন্তু অতি মুনাফা! মোটা চাল স্বল্প আয়ের মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান খাবার। সেই খাবার নিয়ে যারা অতিরিক্ত মুনাফা করেন-তারাই মুনাফাখোর। বাজারের প্রতিবেদন করতে এসে একটি অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে- এদেশের ব্যবসায়ীরা কোন নিয়মেরই ধার-ধারে না। সব কিছুতেই থোরাই কেয়ার করার মানসিকতা তাদের। ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় কত আইন হয়েছে এদেশে। নিরাপদ খাদ্য সরবরাহেও আইন হয়েছে। সঠিক দ্রব্যমূল্য নিশ্চিত করতে করা হয়েছে প্রতিযোগিতা কমিশন। আরও কতকিছু! সব কিছু ভোক্তাদের স্বার্থে, কিন্তু সেই ভোক্তারা কতটুকু ভাল আছে এই প্রশ্নও কিন্তু কম নয়। আইন আছে, আইনের বাস্তবায়ন নেই, প্রয়োগ নেই। নিয়মিত বাজার মনিটরিং হওয়ার কথা, কিন্তু সেইখানেও কোন এক অদৃশ্য শক্তির হাতছানিতে তা নিয়মিত হয় না। বাজারে সব পণ্যের মূল্য তালিকা টাঙ্গিয়ে রাখার কথা, অথচ কোন দোকানদার তা মানছে না। আর কতকাল এসব নিয়ে লিখতে হবে সাংবাদিকদের? এম শাহজাহান
×