ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুমুখী তুরাগ

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

মৃত্যুমুখী তুরাগ

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি, জনজীবন, চাষাবাদ মূলত নদীনির্ভর। তাই বলা হয়, নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। অথচ বাংলাদেশ সে পথেই এগিয়ে চলেছে। বহু নদী এর মধ্যেই মরে গেছে। বহু নদী মৃত্যুর পথে। যদিও শুষ্ক মৌসুমে কৃষি কাজের জন্য নদীর পানি বাংলাদেশের প্রধান ভরসা। ধান উৎপাদনে পানির কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের অন্যতম ফসল বোরো এই শুষ্ক মৌসুমের ফসল। শতকরা ৮০ ভাগ ধান চাষ ভূ-উপরিস্থ পানি সেচের ওপর নির্ভরশীল। ভূ-গর্ভস্থ পানি সেচ কাজে ক্রমাগত ব্যবহারে পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতের তারতম্য ও শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানি সময়মতো রিচার্জ হচ্ছে না। সামগ্রিক সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার অভাব, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতিপরায়ণ পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ক্রমাগত সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও জলাবদ্ধতা অবধারিত হয়ে পড়ে। নদীর মৃত্যুর আরেক কারণ দখল এবং দূষণ। অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে নদী হারাচ্ছে তার আকৃতি, আয়তন। নদী হয়ে যাচ্ছে ভরাট। মাটি, বালু, বর্জ্য ফেলে অবৈধভাবে দখল করা হচ্ছে দেশের অধিকাংশ নদ-নদী। ভরাটজনিত এই দখলের ফলে অনেক স্থানে নদ-নদী মৃত হয়ে গেছে। এই দখলদারদের মধ্যে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রয়েছে সরকারী সংস্থাও। যে যেভাবে পারছে দখল বজায় রাখছে। নদ-নদী-জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণে নিষিদ্ধ করার কঠোর আইনও রয়েছে। কিন্তু সে আইন যেন কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ। সেখান থেকে বের করে এনে আইন কার্যকর করার কোন উদ্যোগই দৃশ্যমান হয় না কখনও। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদের ভেতরে-বাইরে এ বিষয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন কয়েক দফা। কিন্তু সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই দখলদারদের। সরকারী দলের নাম ভাঙ্গিয়ে যারা চলে, তারাও রয়েছে এই দখলদারিত্বে। আবার দখলের পাশাপাশি চলছে দূষণ। বর্জ্য পদার্থে নদী দূষিত হচ্ছে। ঢাকার প্রধান নদী বুড়িগঙ্গা দূষণের শিকার এমনভাবে হয়েছে যে, স্বচ্ছ পানি আর মেলে না। হাজারীবাগের ট্যানারির বর্জ্য ছাড়াও নদীটি দূষিত হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ময়লা আবর্জনায়। বুড়িগঙ্গার পর এবার ঢাকার অদূরে তুরাগ নদের অবস্থাও শোচনীয়। দখল ও দূষণ দুই-ই তুরাগ নদকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্ষায় প্রাণে কিছুটা পানি পেয়ে নদটি বেঁচে ওঠার চেষ্টা করলেও শুষ্ক মৌসুমে সে মরা পুঁতিগন্ধময় এক নর্দমায় পরিণত হয়। ঢাকার আশপাশের চার নদীর মামলায় সীমানা জরিপ অনুযায়ী তুরাগ নদ দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরির জন্য গত জানুয়ারিতে হাইকোর্ট বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয়। গত ১৫ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ঢাকা ও গাজীপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদীর গাজীপুর অংশে ব্যাপক স্থান দখল হয়ে গেছে। বিআইডব্লিউটিএ নির্মিত ওয়াকওয়ে নদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানা, ভূমি ও প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বিভিন্ন প্রকার বর্জ্য ফেলে আসছে। নদের চারদিক থেকে ফেলা বর্জ্য ও পানি জমে তলদেশ ভরাট হয়ে নৌযান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তদন্ত কমিটি অবৈধ দখলদারদের তালিকাও করেছে। এই অবস্থা থেকে উদ্ধারে প্রয়োজন অবৈধ স্থাপনাসমূহ অপসারণ, তলদেশ ড্রেজিং করা ও বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা। না হলে নৌযান চলাচলও বন্ধ হয়ে যাবে। তুরাগ নদ ও এর তীরের জনপদকে বাঁচাতে হলে দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করা জরুরী। হাইকোর্টের নির্দেশ কার্যকর করা গেলে বেঁচে যাবে এই নদ। আর তুরাগের পথ ধরে এগিয়ে যাবে অনুরূপ মৃত্যুমুখী দেশের অন্যান্য নদ-নদীও। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে জরুরী ভিত্তিতে এগিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই।
×