ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ার পদক্ষেপ

ভুটানকে নিয়ে বিবিআইএন মোটর ভেহিকল চুক্তি

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

ভুটানকে নিয়ে বিবিআইএন মোটর ভেহিকল চুক্তি

এম শাহজাহান ॥ ভুটানকে সঙ্গে রেখেই ‘বিবিআইএন মোটর ভেহিকল চুক্তি’ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। ভুটানের পার্লামেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে এখনই এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হচ্ছে না। তবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের স্বার্থে চুক্তি করার বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে দেশটির। আগামী ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-ভুটানের মধ্যে বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠক হবে ঢাকায়। ওই বৈঠক সামনে রেখে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালকে (বিবিআইএন) নিয়ে যে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়নে পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে। ভুটানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিবিআইএন মোটরযান চলাচল চুক্তি করার বিষয়ে তাদের পরবর্তী সংসদ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। সূত্রমতে, এই চুক্তির আওতায় কোনরকম বাধা ছাড়াই এই চার দেশে পণ্যবাহী গাড়ি (ট্রাক, ট্রেইলার), যাত্রীবাহী বাস বা ব্যক্তিগত মোটরযান প্রবেশ করতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি গাড়ির জন্য পৃথক ট্রানজিট ফি দিতে হবে। পাশাপাশি পণ্যবাহী গাড়ির জন্য পৃথক কর ও শুল্ক দিতে হবে। এছাড়া প্রতিটি পণ্যবাহী গাড়ির ট্রানজিটের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আর্থিক গ্যারান্টি দিতে হবে। প্রতিটি দেশে গাড়ি প্রবেশের ক্ষেত্রে নিজ নিজ কাস্টমস নীতিমালা অনুসরণ করবে। এসব শর্ত রেখে বিবিআইএন মোটর ভেহিকল চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। জানা গেছে, সার্কভুক্ত এসব দেশের পাশাপাশি এই চার দেশ বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল একে অপরের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্যিক চাহিদা রয়েছে। রয়েছে ভ্রমণের বিষয়ও। কিন্তু দেশ চারটির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রানজিট সুবিধা না থাকায় বাণিজ্য সম্পাদনে অতিরিক্ত সময় ও অর্থদ- লাগছে। বিষয়টি মাথায় রেখে চার দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও বাণিজ্য সম্পর্ক আরও উন্নয়নে চার দেশের সরকার প্রধানরা ট্রানজিট চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর শুরু হয় চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। ভারতসহ প্রতিবেশী দেশ ভুটান ও নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট কার্যকর এবং আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগের বিবিআইএন চুক্তি করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের স্থলবন্দরগুলোর মাধ্যমে বাণিজ্য অনেক বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ চুক্তিটি করার বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। তাই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থলবন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি সিলেট ও দুই পার্বত্য জেলায় চারটিসহ নতুন ১২ স্থলবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বেনাপোল, নেপাল ও ভুটানের নিকটবর্তী বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি নতুন ঘোষিত স্থলবন্দরগুলো নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব এএইচএম আহসান জনকণ্ঠকে বলেন, বিবিআইএন চুক্তি করার বিষয়ে সরকারের আগ্রহের কোন ঘাটতি নেই। আমরা চাই চুক্তিটি দ্রুত হোক এবং তা ভুটানকে রেখেই। শুধুমাত্র ভুটানের স্থানীয় রাজনীতি বা বিরোধীদলের বিরোধিতা করার কারণে দেশটির বর্তমান সরকার চুক্তিটি করতে পারছে না। এখানে ওই দেশটির ক্ষমতাসীন দলের ভোটের হিসেব জড়িত রয়েছে। বিবিআইএন-এমভিএ ২০১৫ সালের ১৫ জুন সই হওয়ার পর গতবছর জুলাইতে ভুটানের সংসদের নিম্নকক্ষ এতে অনুমোদনও দেয়। কিন্তু ওই বছরের নবেম্বরে চুক্তিটি উচ্চকক্ষে তোলা হলে তা প্রত্যাখ্যান করেন আইনপ্রণেতারা। তিনি বলেন, তবে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের পরই বিবিআইএন চুক্তি সম্পন্ন করার ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে ভুটান। তিনি বলেন, আগামী ডিসেম্বরে ঢাকায় সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বিবিআইএন চুক্তিটি করার পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা হবে। ভুটানের বর্তমান সরকার চুক্তিটি করার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ শুরু করেছে। আশা করা হচ্ছে, বিবিআইএন চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত ভালভাবে সম্পন্ন হবে। জানা গেছে, ভুটানের কারণে চুক্তিটি বাধার মুখে পড়ায় দেশটিকে পাশকাটিয়ে শুধু বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে মোটর ভেহিকল চুক্তি করার বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এতে এই চুক্তিটির গুরুত্ব অনেক কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব কারণে ভুটানকে সঙ্গে রেখেই বিবিআইএন চুক্তি করার বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। ভুটান জানিয়ে দিয়েছে, দেশটির পার্লামেন্টে বিরোধিতার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে সরকার চুক্তিটি অনুমোদন করাতে পারেনি। এছাড়া দেশটির সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে এই মুহূর্তে এ ধরনের চুক্তি পাস করাতে গিয়ে কোন রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে চায় না ভুটান। তবে নির্বাচনের পর চুক্তিটির ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে দেশটির পক্ষ থেকে দৃঢ়ভাবে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বিবিআইএন কেন দরকার ॥ বিবিআইএন বা ‘বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল সংযুক্তি’ হলো সার্কভুক্ত চারটি দেশ নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি পরিকাঠামো। এই পরিকাঠামোর মূল উদ্দেশ্য হলো, পানির উৎসের সঠিক ব্যবহার এবং বিদ্যুত, সড়কের পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বিবিআইএন ভূমি বেষ্টিত (ল্যান্ড ব্লক) দেশ নেপাল ও ভুটান ভারতের কলকাতা, হলদিয়া বন্দর এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মংলা বন্দর ব্যবহারের বিশেষ সুবিধা পাবে। লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিবিআইএন ১৯৯৭ সালের ১৪ মে গড়ে ওঠে। এছাড়া ৮ জুন ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার বিবিআইএন মোটর ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্টের খসড়া তৈরি করে ও ১৫ জুন (২০১৫) ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে এই খসড়ার অনুমোদন দেয়া হয়। এই চুক্তি দ্বারা চারটি দেশের যাত্রীবাহী, পণ্যবাহী ও ব্যক্তিগত যানবাহন নির্দিষ্ট রুটে চলাচল করতে পারবে এবং সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। তবে ভুটানের সরকারবিরোধী আইন প্রণেতাদের আশঙ্কা, বিবিআইএন চুক্তি তাদের পরিবেশ ও নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এছাড়া অন্য তিন দেশের যানবাহনকে অবাধ চলাচলের সুযোগ দেয়া হলে, তা ভুটানে বেকারত্ব সৃষ্টি করতে পারে বলেও তাদের আশঙ্কা রয়েছে। তবে কূটনৈতিক চ্যানেলে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তোবগে সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চুক্তিটি পাসের বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ এগিয়ে নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। বিবিআইএন চুক্তি পাস করাতে পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যের ভোট পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে ভুটান সরকার আপাতত এ চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশটির পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ইতোমধ্যে বিবিআইএন অনুমোদন না করে ফিরিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে নিম্নকক্ষে বিরোধী দলের বিপক্ষে ভোট দেয়। এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৮-২০ এপ্রিল ভুটান সফর করেন। সে সময় ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনা বিবিআইএনের বিষয়ে আলোচনাও করেন। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিক যোগাযোগের জন্য বিবিআইএন মোটর ভেহিকল এগ্রিমেন্টের গুরুত্ব অনুধাবন করেন। আর এ কারণে দ্রুত এই চুক্তি বাস্তবায়নে তাদের আগ্রহেরও কথা জানিয়েছিলেন। তবে ভুটান বিবিআইএন প্রস্তাবে এখনই রাজি না হলেও আঞ্চলিক কাঠামোয় নীতিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে জলবিদ্যুত খাতে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে প্রস্তাবিত ত্রি-পক্ষীয় সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। এছাড়া ভুটানকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আনা নেয়ার জন্য সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতাও সই হয়েছে। বিবিআইএন কার্যকর হলে বাণিজ্য বাড়বে ॥ বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) কাঠামো কার্যকর হলে এই চার দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মোটর ভেহিকল (যাত্রী ও কার্গো) চুক্তি হলেও প্রতিটি দেশকেই অন্য তিন দেশের সঙ্গে আলাদাভাবে দ্বিপক্ষীয় প্রটোকল বা চুক্তি করতে হবে। ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রটোকল সই হলেও ভুটানের সঙ্গে এখনও বাকি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিবিআইএনের সই হওয়া মোটর-ভেহিকল (যাত্রী ও কার্গো) চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর হলে চার দেশের মানুষ উপকৃত হবে। এ অঞ্চলে বাণিজ্যও বাড়বে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে হলে বিবিআইএন চুক্তি এবং তা বাস্তবায়ন করা জরুরী হয়ে পড়ছে।
×