ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফোর্বস ম্যাগাজিন অনূর্ধ ৩০ ‘আন্ডার থার্টি ইম্প্যাক্ট চ্যালেঞ্জ’

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

ফোর্বস ম্যাগাজিন অনূর্ধ ৩০ ‘আন্ডার থার্টি ইম্প্যাক্ট চ্যালেঞ্জ’

তরুণদের অন্তরে সদা জাগ্রত থাকে দুর্বার স্পৃহা। তারুণ্য একটি প্রবল প্রাণশক্তি, যা অফুরন্ত সম্ভাবনা ও বর্ণিল স্বপ্ন দ্বারা উজ্জীবিত থাকে সব সময়। একটি স্ফুলিঙ্গ তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত শিখায় পরিণত করতে পারে, যা হয়ে ওঠতে পারে নক্ষত্রের মতো সমুজ্জ্বল। এজন্য প্রয়োজন একটি স্বপ্নের, যে স্বপ্ন তরুণ সমাজকে একটি সুন্দর সফল জীবনের পথ দেখাবে। প্রতিটি তরুণেরই এরূপ একটি স্বপ্ন থাকা চাই তেমনি এক স্বপ্নবাজ তরুণ আমাদের মিনহাজ চৌধুরী। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মিনহাজ চৌধুরীর শেকড় বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। মিনহাজের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডালাসে। মিনহাজের বাবা চৌধুরী আহমেদের আদি নিবাস ছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। মিনহাজের মা নাজনীন আহমেদ ও বাবা চৌধুরী আহমেদ দুজনে তরুণ বয়সে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তার বাবা যন্ত্রকৌশল বিষয়ে পড়েছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে। বছর দুয়েক আগে, ২০১৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সী যে বাছাই ৩০ জনের নাম প্রকাশ করেছিল, সে তালিকায় ছিল মিনহাজের নাম। এবার সেই ধারাবাহিকতায় মিনহাজ জায়গা করে নিয়েছেন ‘আন্ডার থার্টি ইম্পেক্ট চ্যালেঞ্জ’ পুরস্কার বিজয়ীদের তালিকায়ও। উল্লেখ্য, মিনহাজই প্রথম কোন বাংলাদেশী তরুণ উদ্যোক্তা যিনি ফোর্বসের মতো এতবড় একটি প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে নিজের কাজের স্বীকৃতি অর্জন করে নিতে সমর্থ হলেন। মিনহাজ ‘ড্রিংকওয়েল’ নামের সামাজিক উদ্যোগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ জ্যাকপট প্রতিযোগিতায় মিনহাজ ও তার ড্রিংকওয়েল প্রকল্প প্রথম স্থান অধিকার করে। ওই বছরই সাউথওয়েস্ট ইকো এ্যাওয়ার্ডসের প্রফিট সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত দ্য টেক মিউজিয়াম অব ইনোভেশনের টেক এ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইন্টেল কর্পোরেশন ড্রিংকওয়েল সিস্টেমসকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ২০১২ সাল থেকেই ড্রিংকওয়েলের কাজ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ছুটে বেড়াচ্ছেন মিনহাজ। ইতোমধ্যে তার এ প্রকল্প সাফল্য পেয়েছে ভারত, নেপাল, লাওস ও কম্বোডিয়ায়। পশ্চিমবঙ্গের ১৫০ জায়গায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কাজ করছে ড্রিংকওয়েল। এছাড়া নেপাল, লাওস, কম্বোডিয়ার ২০০ গ্রামে প্রায় ২০ লাখ মানুষ সরাসরি ড্রিংকওয়েলের কাছ থেকে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা পাচ্ছে। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে ব্যবসার মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন মিনহাজ ও তাঁর দল। মিনহাজের স্বপ্নের সহযোদ্ধা হিসেবে আছেন অরূপ সেনগুপ্ত, মাইক জার্মান ও সঞ্জয় ভার্মা। মিনহাজ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশে আসেন তিনি। সে সময় তার সঙ্গে আসেন তারই বন্ধু পল ববলিত্জ। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের গোলাইডাঙা গ্রামের নলকূপের আর্সেনিক দূষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। গ্রামের মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ১০০ সনোফিল্টার স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান তিনি এবং পল ববলিত্জ। এর দুই বছর পর ২০১১ সালে স্নাতক সম্পন্ন করে আবারও বাংলাদেশে আসেন মিনহাজ। এবার তিনি ব্র্যাকের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। মানিকগঞ্জের সেই গ্রামে ফিরে এসে দেখেন মাত্র তিনটা সনোফিল্টার কাজ করছিল। বিনা পয়সায় পাওয়া সনোফিল্টারগুলো গ্রামের মানুষের অবহেলায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এখন প্রশ্ন আসতে পারে ড্রিংকওয়েল কী? ভারতে ফুলব্রাইট স্কলারদের এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ২০১২ সালে। সেখানেই প্রথম মিনহাজ তার ধারণা তুলে ধরেন। গ্রামের মানুষের পানির জন্য অর্থ ব্যয় করার উপায় সৃষ্টি করলেই এমন সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে মিনহাজ ধারণা দেন। সেই সম্মেলনে কলকাতার গবেষক অরূপ সেনগুপ্তের একই বিষয়ে এক অভূতপূর্ব কাজের কথা জানতে পারেন মিনহাজ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আর্সেনিক সমস্যা বেশ ভয়াবহ। গবেষক সেনগুপ্ত ২০০৪ সাল থেকে ‘উত্তর চব্বিশ পরগনা’ জেলার অশোকনগর গ্রামে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশেষ এক কর্মসূচী পরিচালনা করছিলেন। মিনহাজের চিন্তার সঙ্গে সেনগুপ্তের চিন্তা মিলে যায়।’ এরপরই মিনহাজ যৌথভাবে ড্রিংকওয়েল প্রতিষ্ঠা করেন অরূপ সেনগুপ্ত, মাইক জার্মান ও সঞ্জয় ভার্মাকে নিয়ে। ড্রিংকওয়েল সিস্টেম অরূপ সেনগুপ্ত উদ্ভাবিত পানি শোধনের বিশেষ এক পদ্ধতির নাম। এই পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধকরণের প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর চেয়ে ৬০ গুণ বেশি পানি উৎপাদন সম্ভব হয়। এ ছাড়া ১৭ গুণ বেশি জ্বালানি সাশ্রয়ী উপায়ে এই পানি সরবরাহ করে ড্রিংকওয়েল। প্রধানত, কারিগরি সহায়তা দেয় ড্রিংকওয়েল। গ্রামবাসী যে টাকা দিয়ে পানি কেনে তা প্লান্ট রক্ষণাবেক্ষণেই ব্যয় হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ফোর্বস আন্ডার থার্টি সম্মেলনে গত সোমবার (২ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিকভাবে মিনহাজের এ স্বীকৃতি অর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়। আর সেই সুবাদে পুরস্কার হিসেবে মিনহাজের প্রতিষ্ঠান ‘ড্রিংকওয়েল’কে প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ লাখ ডলার প্রদানও করা হয়। ফোর্বসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরস্কার হিসেবে পাওয়া পাঁচ লাখ ডলারের মধ্যে আড়াই লাখ ডলার খরচ করা হবে বিনিয়োগ খাতে এবং বাকি অর্থ ফোর্বসের মিডিয়া গ্রান্ট হিসেবে দেয়া হবে।
×