ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা, স্থানীয়রাই এখন সংখ্যালঘু

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা, স্থানীয়রাই এখন সংখ্যালঘু

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপে মিয়ানমার সরকার শেষ পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হবে এমনই সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার রাজি হলেও রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি হবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় রোহিঙ্গারা পরিকল্পিতভাবে আবাসন গড়ে তুলছে কি না সেই উৎকণ্ঠা এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। দিন যতই গড়াচ্ছে রোহিঙ্গাদের জীবনাচারে ততই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের চলাফেরায় দু’মাস আগেও যেমন নিরীহভাব ছিল, তা এখন আর নেই। বরং বসবাস করছে অনেকটা স্থায়ী বাসিন্দাদের মতো। পরিবর্তন এসেছে তাদের দৈহিক ভাষায়, চেষ্টা চালাচ্ছে এদেশেই জীবিকা অন্বেষণের। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে স্থানীয়দের সঙ্গে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে একাধিক। এদের রাখাইনে ফিরতে অনীহার পাশাপাশি ওপার থেকে প্রতিদিন রোহিঙ্গা আগমনের ঢলও অব্যাহত রয়েছে। সব মিলিয়ে সমূহ বিপদের আশঙ্কার মধ্যে সেখানকার বাংলাদেশী নাগরিকরা। জনসংখ্যার অনুপাত এমনই দাঁড়িয়েছে যে, কক্সবাজারের এ দুটি এলাকায় এখন রোহিঙ্গারাই শক্তিশালী অবস্থানে। জীবিকা না থাকায় তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ে। মারামারি প্রথমে নিজেদের মধ্যে কিছু হলেও এখন আক্রান্ত হচ্ছে স্থানীয় অধিবাসীরা। সহিংসতার মুখে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি এক মাস আগেও যে সহানুভূতি দেখা গিয়েছিল এখন তা নেই। বরং তাদের আচরণে ক্রমেই অতীষ্ঠ হয়ে উঠছে স্থানীয়রা। রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের ভূমিতে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর। খুলছে ছোটখাটো ব্যবসা। চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগে উল্টো এদেশের মানুষদের হয়রানি করার অভিযোগও উঠেছে। কক্সবাজারের মানুষের আকুতিÑ এই রোহিঙ্গারা তাদের ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করেছে তা অন্য জেলার মানুষ বুঝতে পারছে না। সারাদেশের আবেগ এবং আদর যতœ করে বাংলাদেশের প্রতি তাদের লোভ ধরিয়ে দেয়া আমাদের ভবিষ্যতকে বিপদের মুখে ঢেলে দিচ্ছে। আমরা চাই, যত দ্রুত সম্ভব এরা চলে যাক। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রাজি হলেও এমন আয়েশি ও নিরাপদ জীবন ফেলে তাদের ক’জন ফিরতে রাজি হবে তা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখন যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা বেশ উদ্বেগজনক। সংস্থাগুলোও ধীরে ধীরে আগ্রহ হারাতে শুরু করেছে। কেননা, তাদের মারামারি এখন আর ক্যাম্পে নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা বাঙালীদেরও পেটাচ্ছে, সংস্থার সদস্যদেরও ওপরও চড়াও হচ্ছে। প্রতিদিনই এদের নানা কলহের সালিশ বিচার করতে হচ্ছে। ত্রাণ, পুনর্বাসন, চিকিৎসা ও স্যানিটেশন কার্যক্রমসহ জরুরী কাজগুলোর বাইরে অনেক উটকো ঝামেলা মেটাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। থানাগুলোতেও দায়ের হচ্ছে মাদক এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের অভিযোগে মামলা। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের দেখভাল এবং ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশের সরকারী বিভিন্ন সংস্থার বিপুল পরিমাণ জনশক্তি। শুধু সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশই নয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একটি অংশকে সময় দিতে হচ্ছে উখিয়া এবং টেকনাফে। অনেক চিকিৎসক নিয়োজিত রয়েছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবার কাজে। বাড়তি এ কাজে সরকারী কর্মকর্তাদের নিয়োজিত করায় জনবল স্বল্পতার সৃষ্টি হয়েছে হাসপাতাল, প্রশাসন এবং সরকারী দফতরে। দায়িত্বরতরা নাম উল্লেখ না করার শর্তে বলেন, রাখাইনের বোঝা চেপেছে আমাদের ঘাড়ে। এখন তাদের ব্যবস্থাপনার কাজটিই যেন আমাদের মূল কাজ হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধ ॥ বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে। গত ২৫ আগস্ট তারা নাফ নদী পেরিয়ে এদিকে আসতে শুরু করে। প্রথমে এদের প্রতি সহানুভূতি এবং আবেগ সৃষ্টি হয় সরকার, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে আবেগ কমে আসছে। বরং এক ধরনের বিরক্তভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর জন্য দায়ী রোহিঙ্গারাই। প্রতিদিনই মারামারি লেগে আছে ক্যাম্প অভ্যন্তরে। ইয়াবা ব্যবসা, একজনের জিনিসপত্র নিয়ে আরেকজনের টানাটানি, চুরি, প্রতারণাসহ নানা ধরনের কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এর মধ্যে তারা চুরিকাঘাতে হত্যা করেছে আবু সিদ্দিক নামের এক যুবককেও। পিটিয়ে আহত করেছে পুলিশের এক এসআইকে। অবৈধভাবে মুদি দোকান স্থাপনের বাধা দেয়ায় তার ওপর চড়াও হয় এক রোহিঙ্গা দম্পতি। স্থানীয়রা জানান, দিন দিন হিংস্র এবং অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। ইয়াবা, মানবপাচার, মারধরসহ নানা অপরাধে জড়ানোর হার ক্রমেই বাড়ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকা থেকে বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার, রোহিঙ্গাদের হাতে রোহিঙ্গা খুন, রোহিঙ্গাদের হামলায় স্থানীয়দের হতাহত হওয়ার ঘটনার জন্ম দিয়েছে রোহিঙ্গারা। অথচ এক মাস আগেও তারা এমন ছিল না। ভাবখানা ছিল, তারা শুধুই প্রাণে বাঁচতে সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ইয়াবাসহ বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়ছে অনেক রোহিঙ্গা। সংখ্যায় তারা বেশি হয়ে যাওয়ায় স্থানীয়রা অসহায় হয়ে পড়েছে। টেলিফোন যোগাযোগের মাধ্যমে তারা নিয়ে আসছে ওপারে থাকা রোহিঙ্গাদের। টেকনাফ থানার ওসি বলেন, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় কাজ করতে গিয়ে পুলিশের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পুলিশ তাদের শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করছে। অথচ তাদের হাতে আক্রান্ত ও নিগৃহীত হচ্ছে পুলিশ। এটা তো মেনে নেয়া যায় না। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দীন চৌধুরীও হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে উখিয়া ও টেকনাফ। তাদের জন্য স্থানীয়দের জীবন কঠিন এবং দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তারা নানা অপরাধ কর্মকা- ঘটাচ্ছে। ফলে স্থানীয়রা পড়েছে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুলও রোহিঙ্গাদের কারণে সৃষ্ট অস্বস্তিকর পরিস্থিতির কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে অনেক কষ্ট এবং প্রতিকূল অবস্থা মেনে নিচ্ছে স্থানীয়রা। তারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বিসর্জন দিয়েছেন। এতকিছুর পরও যদি তাদেরই রোহিঙ্গা হামলার শিকার হতে হয়, সেটা খুবই দুঃখজনক। টেকনাফ ও কক্সবাজারে আসা রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ঘটানোর চেষ্টা করছে। অনেক অভিযোগ আসছে তাদের বিরুদ্ধে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তারা যেন কোন অপরাধমূলক কর্মকা- ঘটাতে না পারে, সেজন্য কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মোরশেদ হোসেন তানিম বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মিয়ানমারের সকল রোহিঙ্গাই এখন বাংলাদেশমুখী। রাখাইন প্রদেশে যেসব জায়গাগুলোতে নির্যাতন বা ঘর বাড়ি পোড়ানো হয়নি তারই এখন এদিকে চলে আসছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে যারা বর্তমানে অবস্থান করছে, তারা বেশ ভাল আছে। তাই তারা তাদের স্বজন এবং প্রতিবেশীদেরও বলছে এদিকে আসতে। ফলে অনুপ্রবেশ বন্ধ হচ্ছে না। এককভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ সমর্থনযোগ্য নয় ॥ বাস্তুচ্যুত ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার চাপ এককভাবে পড়েছে বাংলাদেশের ওপর। এই সঙ্কট মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ হলেও মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি অনুধাবন করছে। সে কারণে এই চাপ সকলের ভাগাভাগি করে নেয়ার সুপারিশও উঠেছে। সোমবার জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সভায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান বলেন, আমাদের ওপর বাড়তি জনসংখ্যার এ স্রোত সমর্থনযোগ্য নয়। রোহিঙ্গাদের জন্য মালয়েশিয়ার আরও ত্রাণ ॥ মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য আরও এক দফায় ত্রাণ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। তৃতীয় দফায় মালয়েশিয়া সরকার ৫৬ দশমিক ৬ মেট্রিক টন ত্রাণসামগ্রী প্রেরণ করেছে।
×