ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

শুক্র-শনি পরপর দু’দিন একটানা বৃষ্টি। বঙ্গোপসাগরে লঘু চাপের এই মৌসুমে প্রথম ধাক্কা। ঢাকার মতো অপরিকল্পিত ও নানা ভারে ভারাক্রান্ত নগরীর পক্ষে এই ধাক্কা সামলানো কঠিন। বিদায়ী বর্ষার সর্বোচ্চ দুরবস্থার বাস্তবতাকে ম্লান করে দিল টানা দুদিনের সূর্যালোকবঞ্চিত শ্রাবণধারার মতো অঝোর বৃষ্টি। এবার কোন কোন সড়কে দিব্যি নেমে গেল নৌকা। শুক্রবার অনেকেই ভেবেছেন একদিন না হয় ঘরেই রইলাম। কিন্তু শনিবার না বেরিয়ে উপায় ছিল না কাজের মানুষের। কর্মস্থল দূরে হলে যানবাহনের শরণাপন্ন না হয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু এদিন গণপরিবহনের যেন আকাল পড়ল। সিএনজি অটোরিক্সার কথা আলাদা। ঢাকার চার নদী ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খালগুলো দখল-দূষণের শিকার হওয়ায় বর্তমানে রাজধানীর জলাবদ্ধতা অকল্পনীয়। পুরো এক দিনের বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট যে পরিমাণে জলমগ্ন থাকে ছোট যানের জন্য সেটা বিপজ্জনক। কিন্তু বাস-মিনিবাসের এত আকাল কেন? তার চালকেরাও কি বিপদ আগেভাগে আঁচ করেছিল! অফিসে যাওয়ার জন্য বার বার উবার এ্যাপস অন করে দেখি এখানেও আকাল চলছে। কাছাকাছি কোনো উবার-কার নেই। উবারের গাড়ি চালকরা তো স্বাধীন। তাই তারাও ঘরে বসে বাদলা দিন পার করে দেয়ার মনস্থির করেছেন হয়ত। বেশ অপেক্ষার পর একখানা গাড়ি পেলাম। চালক ফোন করে অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করলেনÑ স্যার কোথায় যাবেন? জনকণ্ঠ ভবনে যাব সেটা লিখেই তারপর গাড়ির চাহিদা জানানো হয়েছে। পরে গাড়িতে উঠে চালকের কথায় বুঝলাম তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাইছিলেন আমি সত্যি সত্যি নিউ ইস্কাটন নাকি আরও দূর কোথাও যাব। কেননা আমাকে নামিয়ে দিয়ে তিনি উত্তরার কোন যাত্রীর ডাকেই সাড়া দেবেন, অন্যথা নয়। তিনিও উত্তরাতেই থাকেন। তাই উত্তরার যাত্রীকে নামিয়ে দিয়ে সোজা বাসায় ফিরে যাবেন, আজ আর গাড়ি চালাবেন না। তার আরেকটি কারণ হলো এই বৃষ্টিমুখর দিনে উবারের ভাড়াও বাড়িয়ে প্রদর্শন করা হয়েছে। চালকদের বেশি ভাড়ার প্রলোভন দেখিয়ে ভাড়ায় যেতে প্রলুব্ধ করার কৌশল। ভাড়ায় গেলেই উবার কর্তৃপক্ষ যাত্রীর প্রদত্ত টাকা থেকে পঁচিশ শতাংশ কেটে রাখতে পারবে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে যাত্রী নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। টানা বর্ষায় ধানমন্ডির পরিস্থিতি ছিল বেশি করুণ। রাস্তার মাঝখানে বিকল প্রাইভেট কার থেকে প্রায় কোমর সমান পানিতে নেমে হতভম্ব এক ভদ্রমহিলা, এমন ছবি ফেসবুকে! সন্ধ্যায় বিটিভিতে কবি শামসুর রাহমান স্মরণে বিশেষ অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং। জনকণ্ঠ ভবন থেকে বেরিয়ে হাতিরঝিল পাড়ি দিয়ে আমি ঠিক চলে যেতে পারবো। ধানমন্ডি থেকে কবি রুবী রহমান ফোনে অপারগতা প্রকাশ করে জানালেন, দু’জন ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাসা থেকে বেরুনো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। মুমূর্ষু বিবেক মাতৃত্ব বিশেষ মর্যাদা পায় সব সমাজেই, আর নবজাতকের জন্য স্নেহ ও শুভকামনা জেগে ওঠা এক স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়। সেই মাতৃত্ব কোথাও ভূলুণ্ঠিত হলে, সদ্য জন্মলাভকারী শিশুটির জীবন বিপন্ন হয়ে উঠলে সমাজে তার প্রতিক্রিয়া হয়। রাজধানীর একটি ঘটনা মানুষকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। গত মঙ্গলবার প্রসব বেদনা নিয়ে ঢাকার তিনটি সরকারী হাসপাতাল ঘোরেন পারভিন নামের এক ভাসমান নারী। তিনটি জায়গার কোনটিতে স্বাস্থ্যসেবা পাননি তিনি। পরে রাস্তার ওপরই তাঁর সন্তান প্রসব হয়। তবে জন্মের পরপরই শিশুসন্তানটি মারা যায়। এরকম একটি খবর সঙ্গত কারণেই মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। ক্ষোভ, বেদনা ও অসহায়ত্বের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে গর্ভবতী অবহেলার শিকার হয়েছেন ছিন্নমূল ও অর্থকড়িহীন হওয়ার কারণেই। প্রসব বেদনার মতো জরুরী পরিস্থিতির ভেতর নারীটিকে হাসপাতাল থেকে কৌশলে ও বলপ্রয়োগে বের করে দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত অমানবিক। এটি পুরো সমাজকেই বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়ার মতো। পুরো ঘটনা দুঃখজনক বলে অভিহিত করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে এসেছে। এটি আমাদের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সভ্যতার ওপর কালিমা লেপন। আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় গরিব জনগোষ্ঠী অত্যন্ত নিগৃহীত। তাঁদের চিকিৎসার অবহেলার এই দৃষ্টান্ত, সম্যক ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের আরও সচেতন হওয়া আবশ্যক বলে মনে করেন আদালত।’ অতি প্রয়োজনীয় বিষয় অতি প্রয়োজনীয় বিষয় অস্বীকার করার কিছু নেই। দেরিতে হলেও ঢাকায় নারীবান্ধব টললেট চালু করা হয়েছে। অবশ্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নবনির্মিত আধুনিক টয়লেটের একটি অংশে নারীর জন্য আলাদা অংশ নির্দিষ্ট রেখেছে আগে থেকেই। এবার গাউছিয়া মার্কেটে শুধুমাত্র নারীদের জন্য স্বতন্ত্র আধুনিক টয়লেট চালু করা হলো। বলাবাহুল্য, রাজধানীতে পর্যাপ্ত সংখ্যক গণশৌচাগার থাকলে রাস্তাঘাটে কুৎসিত দৃশ্য দেখতে হতো না, নাকে রমাল গুঁজেও বড় রাস্তা ও অলিগলি পার হতে হতো না। ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কের ওপরেই শুধু নয়, অলিগলিতে, পাড়া-মহল্লায় ও হোটেল-রেস্টুরেন্টের ছড়াছড়ি। মানুষকে দিনে বেশ ক’বার আহার গ্রহণ করতে হয়। প্রতিটি মানুষের জন্যই এটি অপরিহার্য। ফলে হোটেলের ব্যবসা সব দেশেই রমরমা। ঢাকা অত্যন্ত জনবহুল বলেই এখানে হোটেলের সংখ্যাও বেশি। ঢাকার একটি আবাসিক এলাকার প্রধান একটি সড়কের ওপর দু’তিন কিলোমিটারের ভেতর অভিজাত রেস্টুরেন্টের সংখ্যা কুড়িটিরও বেশি! কিন্তু ওই সড়কে একটিও পাবলিক টয়লেট নেই। সব খাবার তো আর মানুষ হজম বা উধাও করে ফেলতে পারে না, শরীরের বর্জ্য তাকে বের করে দিতে হয়। জল বিয়োগ ও বর্জ্য বিয়োগের জন্য মানুষের কি কোন দুশ্চিন্তা নেই! আমার তো মনে হয়, শুধু পাবলিক সেক্টরেই নয়, প্রাইভেট সেক্টরেও ঢাকায় কিছু গণশৌচাগার নির্মিত হলে ধীরে ধীরে শিক্ষিত মানুষ সে সব ব্যবহারে অভ্যন্ত হয়ে উঠত। এখন মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে ওঠে। রাস্তাঘাটে প্রকৃতির ডাকে সেই সব মানুষ নিশ্চয়ই সুযোগ পেলে গণশৌচাগারের সুবিধা নিত। ফলে পাঁচ-দশ বছরে আমরা আরেকটু উন্নত পরিবেশ আশা করতে পারতাম। ২০১০ সালে সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ ও ওয়াটার এইড যৌথ উদ্যোগে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের গণশৌচাগার ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ভাসমান জনসংখ্যা পাঁচ লাখ। রিক্সাচালক ১০ লাখ। অন্যান্য জীবিকার মানুষ ১০ লাখ। নিয়মিত পথচারী ২০ লাখ। ঢাকার বাইরে থেকে আসা পথচারী ১০ লাখ। ওই সমীক্ষায় মোটামুটি ব্যবহারের উপযোগী গণশৌচাগার পাওয়া গিয়েছিল ৪৭টি। এর মধ্যে ৩৫টিতে নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। গত ছয় বছরে গণশৌচাগারের সংখ্যা আরও কমেছে। অন্যদিকে গণশৌচাগার ব্যবহার করা প্রয়োজন এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ফলে নগরীর যেখানে-সেখানে মল-মূত্র ত্যাগের প্রবণতা বেড়েছে। ঢাকার দক্ষিণ অংশে একের পর এক আধুনিক পাবলিক টয়লেটের উদ্বোধন করা হয়েছে চলতি বছর। স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০১৭ সালের মধ্যে ১০০টি আধুনিক গণশৌচাগার নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর সিকিভাগ গণশৌচাগারের নির্মাণ কাজ কি সম্পন্ন হবে? নতুন গ্যালারি ‘কারিকর’ একে একে কয়েকটি আর্ট গ্যালারি বা চিত্র প্রদর্শনশালা বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকায়। দুয়েকটি স্থানান্তরিত হয়েছে আগের চাইতে কিছুটা মন্দ জায়গায়। এরকম একটি পরিস্থিতিতে ঢাকায় নতুন আরেকটি আর্ট গ্যালারির উদ্বোধন নিঃসন্দেহে সুসংবাদ। কারিকর নামের এই গ্যালারিটি গুলশান এক নম্বর এলাকায় (বাড়ি ৬৯, সড়ক ২৭)। কয়েকজন চিত্রশিল্পী মিলেই এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। উদ্যোক্তা তরুণ দম্পতি জিন্নাতুল করিম ও শাহানা মজুমদার। যুক্ত হয়েছেন দুই শিল্পী রেজাউল হক লিটন ও জামিল আকবর শামীমও। গ্যালারি উদ্বোধন করলন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের সমাবেশ ছিল লক্ষ্য করার মতো। এগারোজন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ও ভাস্করদের শিল্পকর্ম নিয়েই শুভ সূচনা হলো গ্যালারির। উদ্বোধনী সন্ধ্যায় বিক্রিও হয়ে গেল কয়েকটা ছবি। বৃক্ষবেষ্টিত গ্যালারিটি খুব বেশি বড় না হলেও সামনের এক চিলতে খোলা অংশ এবং উপরের তলায় রেস্তোরাঁ থাকায় শিল্পী ও শিল্প রসিকদের সম্মিলন ও আড্ডাস্থল হিসেবে জায়গাটি মন্দ নয়। স্মরণ : নুরুল ইসলাম অনু ‘একে একে নিভিছে দেউটি’। বড় মানুষেরা একে এক প্রস্থান করছেন। মানুষ মরণশীল, মৃত্যু অনিবার্য। তবু কোন কোন মানুষের দীর্ঘ জীবন অতিক্রমের পর স্বাভাবিক জীবনাবসান আমাদের ব্যথিত ও বিস্মিত করে। একদিন তাঁদের মৃত্যু হবেÑ এমনটা আমরা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারি না। বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব নুরুল ইসলাম অনু ছিলেন তেমনই একজন ভাল মনের মানুষ। গত সপ্তাহ তিনি প্রয়াত হন। কয়েক বছর আগে স্ত্রীর মৃত্যুর পর অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন তিনি। কর্মপ্রিয় মানুষটি তরুণদের মতোই উদ্যমী কর্মসমর্থ ছিলেন। অধুনালুপ্ত দৈনিক সকালের খবরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও এমডি-র পদ ছেড়ে যাওয়ার পর ভিন্ন একটি সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে যোগ দেন। দুজায়গাতেই তাঁর দীর্ঘ একান্ত সান্নিধ্য লাভের সুযোগ আমার হয়েছে। দীর্ঘদেহী এই মিষ্টভাষী মানুষটি কখনোই আমার নাম ধরে ডাকেননি, সম্বোধন করতেন কবি বলে। সব পেশার সব শ্রেণীর লোককে সম্মান দিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে আলাপ করতে দেখেছি তাঁকে। তাঁর এক সন্তানতুল্য সহকর্মীর শোকাহত একটি লেখা পেলাম ফেসবুকে। তার শুরুটা এখানে তুলে দিচ্ছি। ‘নুরল ইসলাম অনু: আপনাকে মনে পড়বেই...’ শিরোনামে এনামুর রেজা দীপু লিখেছেন: ‘চাকরির সময়টাতে অনেক আলোকিত এবং অসাধারণ মানুষের সাহচর্য পেয়েছিলাম। অসম্ভব মেধাবী ও ভার্সেটাইল জিনিয়াস এসব মানুষের চোখ মুখে খেলা করতো অন্যরকম আলোর ছটা। এদেরই একজন সদ্যপ্রয়াত নুরুল ইসলাম অনু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র এবং পরবর্তীকালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু হয়েছিল তার পেশাগত জীবন। পরে তিনি সিএসপি অফিসার হিসেবে বাগেরহাট মহকুমার এসডিও পদে যোগ দেন। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর পছন্দে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তার একান্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন। পঁচাত্তরের পর ক্ষোভে অভিমানে তিনি সরকারী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আমেরিকা চলে আসেন। এরশাদ জমানার শেষদিকে তিনি আবার বাংলাদেশে এসে থিতু হন। র‌্যাংগস গ্রুপের চেয়ারম্যান রউফ চৌধুরী সাহেব আমার ইন্টারভিউ নেয়ার সময়ই নুরুল ইসলাম অনু সাহেবকে চিনি কিনা জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম- নব্বই পরবর্তী সময়ে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম অঘোষিত উপদেষ্টা। সেদিনই প্রথম অনু সাহেবের সঙ্গে বিজয় সরণির র‌্যাংগস ভবনে পরিচয় হয়। উভয়ের বাড়িই বিক্রমপুরের সিরাজদিখান থানায় পাশাপাশি গ্রামে। পরে জানলাম স্কুল জীবন থেকেই তারা একে অপরের পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ।...’ ২২ অক্টোবর ২০১৭ [email protected]
×