ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিপণ চক্র

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২৪ অক্টোবর ২০১৭

মুক্তিপণ চক্র

সরকার তথা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নানা পদক্ষেপ এবং হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও বিদেশে মানব পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য থামছে না কিছুতেই। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের সহায়তায় এবার ধরা পড়েছে মানব পাচারসহ মুক্তিপণ আদায়কারীর একটি সংঘবদ্ধ চক্র। দেশে ও বিদেশে দু’জায়গাতেই এদের ঘাঁটি রয়েছে। ভাল বেতন ও উন্নত দেশে বিশেষ করে ইউরোপে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে চক্রটি বাংলাদেশ থেকে বহু তরুণকে ইতোমধ্যে নিয়ে গেছে লিবিয়া, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে। সেখানে তাদের নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রায় জিম্মি করে রাখা হয় নানা স্থানে। পরে সময় সুযোগ মতো উত্তাল ও প্রতিকূল সমুদ্রপথে পাচার করা হয় ইউরোপের কোন দেশে। বিনিময়ে নেয়া হয় লাখ লাখ টাকা। তবে অধিকাংশেরই আর গন্তব্যে পৌঁছানো হয়ে ওঠে না। অতঃপর ঠাঁই হয় বিদেশের কারাগারে অথবা পথে-বিপথে। কিছু তরুণকে আবার জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা চালায় দালালচক্র। জিম্মিকৃত তরুণের বাংলাদেশে অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দাবি করা হয় মুক্তিপণের টাকা। যারা দিতে পারেন তাদের মুক্তি মেলে বন্দীদশা থেকে। অন্যদের শুরু হয় মানবেতন জীবন। পুলিশ সম্প্রতি ওই চক্রের হাতে বন্দী ২২ বাংলাদেশী নাগরিকের মধ্য থেকে ১৪ জনকে মুক্ত করে আনতে সক্ষম হয়েছে ১ কোটি টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে। বাকি ৮ জনের ভাগ্য এখনও অনিশ্চিত। গত ৬ মাসে অন্তত তিন শ’ হতভাগ্য বাংলাদেশী তরুণের লিবিয়ায় পাচারের তথ্য রয়েছে পুলিশের হাতে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, বর্তমানে প্রায় ৯৬ লাখ বাংলাদেশী অভিবাসী হিসেবে বিশ্বের ১৬০টি দেশে কর্মরত আছেন। তবে এই সংখ্যা আরও বেশি, এক কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। কেননা অনেকে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস ও আয়-উপার্জন করছেন। অনেকে নিবন্ধনের বাইরেও দালাল ও মানব পাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। এর বাইরেও বিদেশের বাজারে নিত্য নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় প্রতি বছর চার-পাঁচ লাখ কর্মী যাচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থে দেশের অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হচ্ছে দিন দিন। এক হিসেবে হোম রেমিটেন্সের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি হতে পারে। পোশাক রফতানির পরেই এর অবস্থান। তবে সত্যি বলতে কি, প্রবাসী অভিবাসী শ্রমিক-কর্মচারীদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানসহ সামাজিক সুরক্ষার জন্য তেমন নীতিমালা ও আইন নেই। বিশেষ করে প্রতারক এজেন্সি ও দালালচক্রের খপ্পরে প্রলোভিত হয়ে যেসব পুরুষ-নারী ও শিশু জীবনের সমূহ ঝুঁকি নিয়ে পা-বাড়ান বিদেশের অজানা-অচেনা গন্তব্যে, তাদের দুঃখ-কষ্ট-মানবেতর জীবন এক কথায় অবর্ণনীয়, অসহনীয়। এসব ক্ষেত্রে বিদেশ বিভুঁইয়ে জেলখানা ও বন্দীশিবিরে শেকলবাঁধাসহ অনাহারে-অর্ধাহারে মৃত্যুর খবরও আছে। অতঃপর অভিবাসী শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানসহ যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়ার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিরাপদ অভিবাসন আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এতে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করলে ৫ বছরের জেল-জরিমানাসহ মানবপাচারের ক্ষেত্রে মৃত্যুদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের পর আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হলে প্রবাসীদের দুর্ভোগ কমার পাশাপাশি নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হবে বলে আশা করা যায়। সত্য বটে, মানুষ নিতান্তই বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। অনেকে শেষ সহায়-সম্বল ভিটেমাটি পর্যন্ত বিক্রি করে। বিশেষ করে দালাল ও প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে যেসব পুরুষ, নারী ও শিশু শ্রমিক পাড়ি জমায় বিদেশে তাদের দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা অবর্ণনীয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কর্মসংস্থান হয় অতি নিম্নমানের ও স্বল্প মজুরির। প্রতারক দালালচক্র এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয় ভুক্তভোগীর কাছ থেকে। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় মুক্তিপণের হুমকি তাহলে আর সান্ত¡না থাকে কোথায়? এক্ষেত্রে নারীর অবস্থা হয় আরও শোচনীয়। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মহিলারা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকেন ‘যৌনদাসী’ হিসেবে। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরীর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এমনই আভাস মিলেছে। সে অবস্থায় বিদেশে নারী ও শিশু প্রেরণের ক্ষেত্রে আরও বেশি মাত্রায় সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। অবর্ণনীয় ও অমানবিক দুঃখ-দুর্দশার কথা-বিবেচনায় নিয়ে ইতোমধ্যে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক প্রেরণ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ সরকারেরও বিষয়টি বিবেচনা করার সময় এসেছে। অন্তত গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে কোন নারী শ্রমিক প্রেরণ না করাই বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি বাংলাদেশী তরুণদের ভাগ্যান্বেষণে আপাতত ইউরোপকে পছন্দের তালিকায় রাখা উচিত নয় কোন অবস্থাতেই।
×