ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুমানা ইসলাম

ব্যক্তি জীবনে অভ্যাসের প্রভাব

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৩ অক্টোবর ২০১৭

ব্যক্তি জীবনে অভ্যাসের প্রভাব

আমাদের মস্তিষ্ক প্রতিনিয়ত শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, এই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য মস্তিষ্ক ক্রিয়াকলাপকে অভ্যাসে রূপান্তরিত করে। এমনকি একটি জটিল কাজ, যেটি সবচাইতে বেশি একাগ্রতার দাবি রাখে, সেটিও এক সময় নিরুদ্যম অভ্যাসে পরিণত হয়। যেমন, এক দক্ষ এবং নিয়মিত সাইক্লিস্ট সাইকেল চালানোর সময় অন্য কোন যানবাহনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ব্রেক কষে কিংবা অন্য কোন উপায়ে সেটি থামিয়ে দেয় কোন প্রকার একাগ্রতা ছাড়াই। এটি সম্ভব হয়েছে অনেক সময় ধরে সাইকেল চালানোর জন্যই। অর্থাৎ সাইকেল চালানোটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে কোন নতুন, শিক্ষানবিস সাইক্লিস্টের বেলায় কিন্তু এমনটা ঘটবে না। তারা সবসময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করবে এবং প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র দুর্ঘটনা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রস্তুত থাকবে। গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রায় চল্লিশ শতাংশ কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা অসচেতন অবস্থায় অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে থাকি। অভ্যাসগুলোকে ভাগ করা যায় তিন ভাগে- প্রথমত, বাহ্যিক সূত্র নির্ভর অভ্যাস, অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই আশপাশের দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্যমান, কিন্তু অনুভব করা যায় এমন কাজের ব্যাপারে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়া। যেমন ধরুন, যখন আপনার এ্যালার্ম ঘড়িটি বাজতে থাকে, তখন আপনার মস্তিষ্কে পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে এমন কিছু ঘটে, যা ওই অবস্থায় আপনাকে জুতসই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, রুটিননির্ভর অভ্যাস, অর্থাৎ নির্দিষ্ট অবস্থায় অথবা নির্দিষ্ট সময়ে যে সকল নির্দিষ্ট কাজ আপনি নিয়মিত করে থাকেন, সেগুলোই রুটিন নির্ভর অভ্যাসের আওতাধীন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করা রুটিন নির্ভর অভ্যাসের একটি উদাহরণ হতে পারে। এবং তৃতীয়ত, কোন কিছুর পাওয়ার আকাক্সক্ষায় তেরি হওয়া অভ্যাস। অতিরিক্ত ঝাল খাওয়ার পর তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে পানি কিংবা মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়ার আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। কেননা আমরা বেশ ছোটকাল থেকেই প্রমাণ পেয়ে আসছি মিষ্টি অথবা পানিই ঝাল থেকে আমাদের পরিত্রাণ দিবে। আর মজার বিষয় হচ্ছে এখানে বাহ্যিক সূত্র এবং রুটিন নির্ভর দুটি অভ্যাসেরই প্রভাব রয়েছে। অভ্যাসগুলো বেশ স্থিতিস্থাপক কিছু কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রচণ্ড ক্ষতি হওয়ার ফলে মানুষ নিজের নাম, বাসস্থান, এমনকি আত্মীয়-স্বজনের কথাও ভুলে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের পুরনো অভ্যাসগুলো মেনে চলে, নতুন সব অভ্যাসের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। কারণ কোন কিছু শেখার পর সেটিকে অভ্যাস হিসেবে বজায় রাখার পুরো ব্যাপারটি ঘটে মস্তিষ্কের বাসাল গ্যাংলিয়া (ইধংধষ মধহমষরধ) নামক অংশে। দুর্ভাগ্যবশত, এই স্থিতিস্থাপকতার মানে হচ্ছে, এমনকি আপনি যদি সিগারেট খাওয়ার মতো কোন অভ্যাস ছেড়েও দেন, যেকোন সময় তার পুনঃপাতিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। খারাপ অভ্যাসগুলো সৃষ্টি করে আকাক্সক্ষার কল্পনা করুন, দীর্ঘ এক বছর ধরে কাজের জায়গার কাছে অবস্থিত ক্যাফেটেরিয়া থেকে প্রত্যেকদিন বিকেলে আপনি চকলেটে ভরপুর, মজাদার একটি কাপ কেক খেয়ে আসছেন। এটাকে সাধারণভাবে নিজেকে নিজের কাজের জন্য দেয়া উপহার ধরতে পারেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আপনার সহকর্মীরা বলল আপনি দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছেন। তাই আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কাপ কেক খাওয়ার অভ্যাস থেকে দূরে থাকবেন। কিন্তু ভাবুন একবার, সিদ্ধান্ত নেয়ার পর প্রথম দিন ক্যাফেটেরিয়ার সামনে দিয়ে বিকেলে যাওয়ার সময় আপনার অনুভূতি কেমন হবে? হয়ত আপনি শেষবারের মতো আরেকটি কেক খেয়ে যাবেন, নয়ত গোমড়া মুখ করে বাড়ি চলে যাবেন। পশু-পাখিদের ওপর করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, তারা যখন কোন একটি অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন তাদের মস্তিষ্ক ওই নির্দিষ্ট অভ্যাসটির জন্য প্রতিদান প্রত্যাশা শুরু করে। কিন্তু যদি প্রতিদান দেয়ার ব্যাপারে অস্বীকার করে দেয়া হয়, তাহলে তারা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, নিজেদের কাজের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়ে। প্রতিদানের প্রত্যাশা ভাল অভ্যাসের ব্যাপারেও সমানভাবে কাজ করে যারা অভ্যাসগতভাবে ব্যায়াম করে, তারা প্রত্যেকে ব্যায়াম থেকে নির্দিষ্ট কিছু চায়। কেউ হয়ত অতিরিক্ত ওজন কমানোর ব্যাপারে আগ্রহী, কারো আগ্রহ হয়তো শরীরকে আরও বেশি শক্তিশালী করার ব্যাপারে, কেউ কেউ শুধু সার্বিক সুস্থতার জন্যই ব্যায়াম করে থাকে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, ব্যায়ামের ব্যাপারটি যখনই আসে, তখন তাদের মস্তিষ্কে এন্ডরফিন (ঊহফড়ৎঢ়যরহ) প্রবাহিত হতে থাকে। যেটি মস্তিষ্কে কাজটি সম্পাদন করার চেতনা যোগায়। অভ্যাস বাতিল নয়, কেবল বদলই সম্ভব অর্থাৎ আপনি চাইলেই আপনার মাঝে গড়ে ওঠা অভ্যাসগুলোকে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। শুধু সেগুলো পরিবর্তন করতে পারবেন। যদিও এতে আকাক্সক্ষা, কোন কিছুর জন্য প্রতিদান প্রত্যাশার ব্যাপারগুলো একই থাকবে। গবেষকরা দেখিয়েছেন, এ পদ্ধতিটি বেশ প্রভাবের সঙ্গেই কোন অভ্যাস পরিবর্তনে সাহায্য করে। এটি অবলম্বন করে এ্যালকোহলিক এ্যানোনিমাস (অষপড়যড়ষরপ অহড়হুসড়ঁং) নামের একটি সংস্থা প্রায় দশ মিলিয়ন মদ্যপ ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। সংস্থাটি মদ্যপ ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রথমে জানতে চায়, কেন তারা অতিরিক্ত মদ পানের ব্যাপারে আগ্রহী। কারণগুলো চিহ্নিত করার পর তারা ওই ব্যক্তির জন্য নতুন রুটিন তৈরি করেন। যেমন- ধরুন, কোন মদ্যপ ব্যক্তি চিত্তবিনোদনের জন্য মদ পান করে। তাদের জন্য সংস্থাটি এমন একটি রুটিন করে যা পুরোপুরি মদ্যপানের বিপরীত, কিন্তু আসক্ত ব্যক্তিকে তার কাক্সিক্ষত বিনোদন দিয়ে থাকে।
×