ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধিনায়ক মাশরাফির মাইলফলকের ম্যাচ

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২২ অক্টোবর ২০১৭

অধিনায়ক মাশরাফির মাইলফলকের ম্যাচ

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নিজের অপরিহার্যতা প্রমাণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে সবার সঙ্গে সহমর্মিতা আর ভাল সম্পর্কের কারণে মন জয় করে নিয়েছিলেন। তাই ২০১০ সালেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে নেতৃত্বে চলে আসেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। কিন্তু বিধাতা চেয়েছেন অন্যরকম। দীর্ঘ ইনজুরির কারণে দল থেকেই ছিটকে যান। যে কারণে টেস্ট ক্রিকেট থেকেই অঘোষিত বিদায় নিতে হয়েছে। ইনজুরির কারণে ৮টি অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। শৈল্যবিদরা ক্রিকেট ছেড়ে দিতে বলেছেন ঝুঁকিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে। কিন্তু আবার ফিরেছেন অদম্য মানসিক শক্তিতে। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর দেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বাজে বছর যাচ্ছিল ২০১৪। টানা হারের বৃত্তে থাকা দলের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফায় আসার পর থেকেই সাফল্য এনে দিয়েছেন। সেই অধিনায়ক মাশরাফি এখন একটি মাইলফলকের সামনে। অধিনায়ক হিসেবে ৫০তম ওয়ানডে ম্যাচ তার। ক্যারিয়ারের ১৮২তম ম্যাচে তিনি বাংলাদেশের তৃতীয় ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে এই কৃতিত্বের অধিকারী হবেন। ইস্ট লন্ডনে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে টস করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এই মাইলফলক স্পর্শ করবেন। ২০০১ সালে ওয়ানডে ক্যারিয়ার শুরুর পর থেকেই ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ নাম পেয়ে গিয়েছিলেন মাশরাফি। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে সে বছর নবেম্বরে দেশের মাটিতে টেস্ট অভিষেক দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়েছিল মাশরাফির। কিন্তু মাত্র ৮ বছর ও ৩৬ টেস্ট লম্বা হয়েছে তার দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটের যাত্রা। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সব ফরমেটের অধিনায়ক হিসেবে গিয়েছিলেন মাশরাফি। সিরিজের শুরুটা হয়েছিল টেস্ট ম্যাচ দিয়ে। প্রথম টেস্টেই ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে যান তিনি। ফলে টেস্ট নেতা হিসেবে অভিষেক ঘটলেও ওয়ানডে কিংবা টি২০ ম্যাচের নেতৃত্বটা দেয়াই হয়নি। অবশেষে ২০১০ সালে ফিরে ওয়ানডের অধিনায়কত্ব আবার ফিরে পান। ইংল্যান্ড সফরে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে হারলেও মাশরাফির দল তাদের হারিয়ে দেয় দ্বিতীয় ম্যাচে ৫ রানে। তবে আবার ইনজুরিতে ছিটকে পড়ায় সাকিব আল হাসান হয়ে যান স্থায়ী অধিনায়ক। ওই ইনজুরি সমস্যায় ফিটনেসের ঘাটতি থাকায় ২০১১ বিশ্বকাপ খেলা হয়নি মাশরাফির। সেই আক্ষেপে কেঁদে ফেলা মাশরাফি ২০১৫ বিশ্বকাপে শুধু অতীত ব্যথাই ভোলেননি, দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা সাফল্যও এনে দিয়েছেন। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলে বাংলাদেশ দল। এর ঠিক আগের বছরই নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় কাটিয়েছে মুশফিকুর রহীমের নেতৃত্বে থাকা দলটি। টানা হারের বৃত্তে বন্দী হয়ে যায় বাংলাদেশ দল। এমনকি সে বছর বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের দ্বিতীয় সারির দলকে মাত্র ১০৫ রানে অলআউট করে দেয়ার পরও নিজেরা ৫৮ রানে গুটিয়ে গিয়ে লজ্জাজনক পরাজয়বরণ করেছিল। পুরো বছরটাই সেভাবে যাচ্ছিল। কিন্তু মাশরাফি যেন পরশ পাথর, এক বিস্ময়কর জাদুকর। ভোজবাজির মতো সব দৃশ্যপট উল্টো হয়ে যায় তিনি নবেম্বরে দীর্ঘ চার বছর পর আবার নেতৃত্বে ফেরার পর। তারপর থেকে শুধু সাফল্য আর সাফল্য। বিশ্বকাপ সাফল্যের পর একেবারে দুর্বার হয়ে ওঠা বাংলাদেশ একে একে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পরাশক্তিদের কুপোকাত করে। ২০১৪ সবচেয়ে খারাপ বছর যেমন ছিল, মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৫ ছিল দেশের ক্রিকেটে তেমনি সফলতম বছর। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে মাশরাফির নেতৃত্বে। ক্রিকেটাররাও বাড়তি উজ্জীবনী শক্তি পান মাশরাফি দলে থাকলে, যে কোন মুহূর্তে আবার হয়ে ওঠেন চাঙ্গা। ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা- আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আহ্বান জানিয়েছিলেন সেই নবীন হয়ে যেন মাশরাফিই ফিরে আসেন ৩২ বছর বয়সে। দুর্দশাগ্রস্ত, বিপর্যস্ত একটি দলকে এবং হতাশায় নিমজ্জিত ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণা ও পথ প্রদর্শক হয়ে আলোর দিশা এনে দেন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর বেশ বাজে যাচ্ছে মাশরাফি ও তার দলের। টানা দুই ওয়ানডেতেই লজ্জাজনক হারের তিক্ততা সঙ্গী হয়েছে। সিরিজ হেরে গেছে বাংলাদেশ একেবারে বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। আজ ৩৪ বছর বয়সী মাশরাফির জন্য বিশেষ এক ম্যাচ। অনেক ধরনের বাধা ডিঙ্গিয়ে ১৮১ ওয়ানডে খেললেও অবশেষে তিনি দলকে নেতৃত্ব দেবেন ৫০তম ম্যাচে। অধিনায়ক হিসেবে ওয়ানডেতে সর্বাধিক ৬৯ ম্যাচ বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন হাবিবুল বাশার সুমন। আর ৫০ ম্যাচ নেতৃত্ব দিয়েছেন সাকিব। সাফল্য লাভের দিক থেকে এ দু’জনকে অনেক পেছনে ফেলেছেন মাশরাফি। এখন পর্যন্ত ৪৯ ম্যাচে অধিনায়কত্ব করে জয় দেখেছেন ২৭ ম্যাচে, হেরেছেন ২০ ম্যাচে। বাকি দুটি ম্যাচ হয়েছে পরিত্যক্ত। মাশরাফির নেতৃত্বে জয়ের হার শতকরা ৫৭.৪৪, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা। সেদিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে সাকিব ৪৬.৯৩ ভাগ জয় এনে দিয়ে (২৩ জয়, ২৬ হার)। সর্বাধিক নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতেন মাশরাফি। কিন্তু ইনজুরির ফাঁড়ায় পড়ে সেটা হয়নি। আজ মাশরাফির জন্য চ্যালেঞ্জ একটি হোয়াইটওয়াশ ঠেকানোর। ইস্ট লন্ডনের তৃতীয় ওয়ানডে হারলেই ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হতে হবে বাংলাদেশকে। নিজের মাইলফলক ছোঁয়ার দিনে আবারও দুর্দশামুক্ত করতে পারবেন তিনি টাইগারদের?
×