ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নড়াইলে দিশেহারা কৃষক

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২২ অক্টোবর ২০১৭

নড়াইলে দিশেহারা কৃষক

রিফাত-বিন-ত্বহা, নড়াইল ॥ রোপা ইরি ও আমন ধানে বাদামি গাছ ফড়িং (বিপিএইচ) কারেন্ট পোকার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন কৃষক। পোকার আক্রমণে ধানগাছ প্রথমে হলুদ ও পরে শুকিয়ে বাদামি রং ধারণ করছে। কীটনাশক ছিটিয়েও কোন ফল পাচ্ছে না কৃষকরা। ফসলের মাঠজুড়ে শুধু পোকা আর পোকা। এদিকে পোকা দমনে বাজারে প্রয়োজনীয় কীটনাশক না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছেনে কৃষকরা। তাদের আশঙ্কা, সময় মতো পোকা দমন করতে না পারলে এবার রোপা ইরি ও আমন উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। সরেজমিন ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, জেলায় এবার ৩৫ হাজার ২৮৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমন ধানের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে লোহাগড়া উপজেলায় রোপা আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রায় ৭ হাজার ৪ শত ২০ হেক্টর জমিতে। এর বিপরীতে ধান চাষ হয়েছে ৯ হাজার ৭শত ৮০ হেক্টরে। সদর উপজেলায় দেড় হেক্টর এবং লোহাগড়া উপজেলায় ২ হেক্টর জমিতে মোট সাড়ে ৩ হেক্টর জমিতে বাদামি গাছ ফড়িং পোকার আক্রমণ হয়েছে। সদর উপজেলার চ-িববরপুর, হবখালী ও লোহাগড়া উপজেলার নলদী, লাহুড়িয়া, শালনগর ও নোয়াগ্রাম ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকার অন্তত ২শ’ হেক্টর জমির রোপা আমন ধানে বাদামি গাছফড়িং পোকার আক্রমণ হয়েছে। তবে কৃষকের কাছে এটি কারেন্ট পোকা নামে পরিচিত। সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, লোহাগড়া উপজেলার মল্লিকপুর, ইতনা, কোলা-দীঘলিয়া, কালনা, চরকালনা, বাঁকা, সিঙ্গা, পাচুড়িয়া, মোচড়া, শালবরাত, জয়পুর, নারানদিয়া, মানিকগঞ্জ, রামকান্তপুর, চর শালনগর, মিঠাপুর, লাহুড়িয়া এলাকার ধানক্ষেত মাঠে যেখানে থাকবে সবুজের সমারোহ, সেখানে মাঠের পর মাঠ ফসল বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে পড়েছে। কৃষকরা বিষ প্রয়োগ করেও ধানের ক্ষেত বাঁচাতে পারছেন না। এ পোকার আক্রমণ এতটাই ভয়াবহ যে, পোকা এক মাঠ থেকে অপর মাঠে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। নোয়াগ্রামের কৃষক সৈয়দ মাসুম জানান, কারেন্ট পোকার আক্রমণে ক্ষেতের মাঝে মাঝে ধান মরে খড়ে পরিণত হচ্ছে। বাজারের কীটনাশক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে পাইরাজিন, স্ক্রজারসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু একটি জমিতে কীটনাশক দিলে পোকাগুলো উড়ে পাশের জমিতে আক্রমণ করছে। এই পোকা দমন করতে হলে একসঙ্গে পুরো বিলে ছিটাতে হবে। আমাদা-ঝিকড়া গ্রামের কৃষক তরিকুল ইসলাম জানান, কৃষকের মুখে হাসি নেই। তারা পাগলের মতো জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ করছে। তাতেও কাজ হচ্ছে না। নড়াইলের নলদী, মানিকগঞ্জ ও লোহাগড়া বাজারের কীটনাশক ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিনই শত শত কৃষক কারেন্ট পোকা দমনের জন্য কীটনাশক কিনতে আসছেন। কিন্তু বাজারে কীটনাশকের সরবরাহ কম থাকার কারণে প্রয়োজনীয় কীটনাশক না পেয়ে অনেক কৃষকই হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। উপজলো কৃষি র্কমর্কতা সমরেন বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, এই পোকার নাম বাদামি গাছফড়িং (বিপিএইচ)। স্থানীয়ভাবে এই পোকাকে কৃষকরা কারেন্ট পোকা বলছেন। কৃষকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এরই মধ্যে এ সম্পর্কিত প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়েছে। পৌরসভাসহ উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা পোকা দমনে তৎপর রয়েছে। দিনাজপুর স্টাফ রিপোর্টার দিনাজপুর থেকে জানান, দিনাজপুরে আমনের ক্ষেতে ব্যাপকহারে পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে দিনাজপুরের কৃষকরা বাড়তি খরচ করে আমন ধানের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু সেই ধানে পোকার আক্রমণ দেখা দেয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। এই বিপদের দিনে কৃষি কর্মকর্তারাও মাঠে নেই বলে অভিযোগ করেছেন কৃষকরা। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সেই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর দিনাজপুর অঞ্চলের তথ্যমতে, চলতি বছরে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলা নিয়ে গঠিত দিনাজপুর কৃষি অঞ্চলে ৪ লাখ ৯১ হাজার ১শ’ ৮৫ হেক্টর জমিতে আমন চারা রোপণ করা হয়েছে। তিন জেলায় আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৬২ হাজার ৫শ’ ৮ মেট্রিক টন চাল। কৃষকরা বলছেন, আগস্টের বন্যায় তাদের বেশিরভাগ চারা নষ্ট হয়ে যায়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি খরচ করে ফের চারা রোপণ করতে হয়েছে। এতে করে প্রতি হেক্টরে খরচ বেড়ে যায় প্রায় ১০ হাজার টাকা। তাদের মতে, এবারে বন্যায় মাটিতে পলি জমায় জমি উর্বর হয়েছে। তাই বাড়তি খরচ করেও তাদের মনে একটা আশা ছিল, ভাল ফলন হওয়ার। কিন্তু হঠাৎ করে আমন ক্ষেতে পোকা আক্রমণ করেছে। কীটনাশক স্প্রে করার পরও কোন লাভ হচ্ছে না। তাই আমনের ফলন নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার ব্যাঙেরকাদো গ্রামের কৃষক আবুল কাসেম জানান, তার প্রায় সোয়া এক বিঘা জমিতে পোকা আক্রমণ করেছে। কীটনাশক স্প্রে করেও এই পোকা দমন করা যাচ্ছে না। কৃষি কর্মকর্তাদেরও মাঠে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তিনি শঙ্কায় আছেন যদি ফলন ভাল না হয়, তাহলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে তাকে। একই গ্রামের কৃষক আবু ইসলাম জানান, বন্যার পর আবারও ধান চাষ করেছিলেন। ধান বের হওয়ার আগেই দেখা দিয়েছে পোকা। এই পোকা গাছের পাতা খেয়ে বিবর্ণ করে ফেলছে। মাঠে পাওয়া যাচ্ছে না কৃষি অফিসের কোন পরামর্শদাতাকে। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই সার বিক্রেতার পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক স্প্রে করছেন। কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। ধান না হলে কিভাবে সংসার চালাবেন আর বাচ্চাদের পড়ালেখার খরচ যোগাবেন সেই চিন্তায় আছেন তিনি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, কিছু কিছু আমন ক্ষেতে পাতা মোড়ানো পোকা এবং ব্লাইট ও ব্লাস্টসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। দিনাজপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন জেলায় পোকার আক্রমণ দেখা দিলেও দিনাজপুরে পোকার আক্রমণ অনেক কম। পোকা কিংবা রোগ-বালাই আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্য বিভিন্ন স্থানে আলোক ফাঁদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া পোকা বা রোগ-বালাই আক্রমণ হলে কী ধরনের কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে, তাও বলে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কৃষি ও কৃষকদের নিয়ে ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দিনাজপুর অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিচালক ড. মাহবুবুর রহমান জানান, কিছু এলাকায় আমন ক্ষেতে ব্যাকটেরিয়া লিড ব্লাইড, বাদামি গাছফড়িং, পাতা মোড়ানো রোগ-বালাই দেখা দিয়েছে। আগাম জাতের ও হাইব্রিড ফসলে এসব রোগ-বালাই দেখা দিচ্ছে। তবে এসব রোগ-বালাইয়ে আক্রমণের পরিমাণ খুবই কম। তার পরও এসব রোগ-বালাই নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা কাজ করছেন ও পরামর্শ প্রদান করছেন। এ ছাড়াও প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যূনতম দুটি স্থানে কৃষকদের পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে সভা ও সমাবেশ করা হচ্ছে।
×