ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাঙ্গন হুমকিতে পাবনায় যমুনার বাঁধসহ ১২ গ্রাম

দশ পয়েন্টে বালু লুটের হিড়িক

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২২ অক্টোবর ২০১৭

দশ পয়েন্টে বালু লুটের হিড়িক

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ২১ অক্টোবর ॥ সরকারী নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে বালুদস্যুরা বেড়ার মোহনগঞ্জ থেকে ঢালারচর পর্যন্ত যমুনা নদীর ১০ পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু তুলছে। প্রতিদিন ১৫টি শক্তিশালী ড্রেজারের সাহায্যে নদী থেকে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে লাখ লাখ ঘনফুট বালু। এদিকে বালুমহাল ইজারা না দেয়ায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবৈধ বালু ব্যবসার সঙ্গে এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ থেকে ঢালারচর পর্যন্ত যমুনা নদীর উজান ও ভাটির প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় রয়েছে বালু উত্তোলনকারীদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ওই এলাকার ১০টি পয়েন্টে ১৫টি শক্তিশালী ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে নদীর তলদেশের ১০-৩০ ফুট গভীর থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু উত্তোলনে প্রায় ১৪ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পাইপ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি ড্রেজার মেশিনের ২৪ ঘণ্টায় বালু উত্তোলন ক্ষমতা প্রায় ৬০ হাজার ঘনফুট। উত্তোলিত বালু পরিবহনে ২০টি কার্গো জাহাজ নিয়োজিত রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও নদী থেকে ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে বালু উত্তোলন করে পাইপের মাধ্যমে সরাসরি নদী পাড়ে রাখা হচ্ছে। নদী পাড়ের কাজিরহাট, নটাখোলা, হরিরামপুর, বেড়া ডাকবাংলো ও বৃশালিখায় বালু বেচা-কেনার হাট বসেছে। সেখান থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু জেলার বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। এই বালু বিক্রি করে সংশ্লিষ্টরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জানা যায়, পাবনা জেলা প্রশাসন ২০০১ সালে হুড়াসাগর ও যমুনা নদীর বালুমহাল হিসেবে লিজ প্রদান করে। পরে লিজের দায়িত্ব খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়। খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ওই বালুমহাল ২০০৪ সালে মোঃ রওশন আলীকে ছয় বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়। পরবর্তীতে আন্তঃবিভাগীয় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ওই বালুমহাল জেলা প্রশাসকের অধীন ন্যস্ত করা হয়। সেই থেকে জেলা প্রশাসন লিজ কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন। এরপর রওশন আলী হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্টের রিট পিটিশনের নির্দেশনা মোতাবেক ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ইজারার রয়্যালিটি, ভ্যাট ও আয়কর জেলা প্রশাসক বরাবর জমা দেন। অনেকেই টেন্ডারের মাধ্যমে বালুমহাল ইজারা দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বালুমহাল ইজারার কোন টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। বালুমহাল লিজ না দেয়ায় সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদিকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় একটি চক্র বছরের পর বছর ধরে হুড়াসাগর ও যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বালু তুলে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, যমুনা নদীর মোহনগঞ্জ, চরপেঁচাকোলা, উত্তরসম্ভুপুরা, হরিরামপুর ও চরনারায়ণপুর পয়েন্টে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে কার্গো বোঝাই করে বিভিন্ন পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে ট্রাক বোঝাই করে বালু পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উত্তোলিত বালুর বেশির ভাগই সরবরাহ করা হয় ঈশ্বরদী-ঢালাচর রেলপথ নির্মাণের কাজে। প্রতি ট্রাক বালু বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু বিক্রি হচ্ছে। বালু বিক্রির টাকা রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়ে থাকে। জানা যায়, নগরবাড়ী ঘাট এমনিতেই ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে রয়েছে। বছর পাঁচেক আগে তীব্র ভাঙ্গন দেখা দেয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সেখানে ভাঙ্গনরোধের কাজ করেছে। এতে নদীভাঙ্গন অনেকটাই থেমে গেছে। কিন্তু নগরবাড়ী ঘাটের কাছে যেভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে আবারও ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা গ্রামের বেশির ভাগ অংশ ও চরপেঁচাকো গ্রামের প্রায় অর্ধেক অংশ যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বলে এলাকাবাসী দাবি করেছে। এছাড়া বালু উত্তোলনের ফলে নদী পাড়ে ধস ও ভাঙ্গনের হুমকিতে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী নাকালিয়া বাজার, অন্তত ১২টি গ্রামসহ ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা পাবনা আইআরডি প্রকল্পের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত যমুনা নদীর পশ্চিম তীর স্থায়ী ভাঙ্গনরোধ প্রতিরক্ষা বাঁধ। নগরবাড়ী ঘাট নলখোলা বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও পুরাণভারেঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান এ এম রফিকউল্লাহ বলেন, বালু উত্তোলনের ফলে উত্তরবঙ্গের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র নগড়বাড়ীঘাট মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। তবে ঈশ্বরদী-ঢালারচর নতুন রেলপথ নির্মাণে প্রচুর বালুর প্রয়োজন হচ্ছে। যেহেতু বেড়া অংশে যমুনা নদীতে কোন বালুমহাল নেই সেজন্য প্রশাসনের উচিত নদী সার্ভে করে নিরাপদ স্থান থেকে বালু উত্তোলনের আদেশ দেয়া। এ ব্যাপারে বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল হামিদ জানিয়ছেন, ভাঙ্গন প্রতিরক্ষা বাঁধের পাশ দিয়ে যমুনা নদী প্রবাহিত হওয়ায় নদীর যে কোন পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন প্রতিরক্ষা বাঁধের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। নদীর যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হয় তার চার পাশের এলাকা ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য প্রশাসন অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে এগিয়ে এলে সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
×