ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ ছাড়ের আগেই সিকি কাজ শেষ ;###;নবেম্বরে চায়না এক্সিম ব্যাংক অর্থ ছাড় করবে ;###;’১৯ সালের এপ্রিলে প্রথম ইউনিট ও অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে

দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২২ অক্টোবর ২০১৭

দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ

রশিদ মামুন॥ ঋণের অর্থ ছাড়ের আগেই এক-চতুর্থাংশের বেশি কাজ শেষ করে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র নজির স্থাপন করেছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির এক নম্বর বয়লার স্থাপনের জন্য স্টিলের কাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে দুই নম্বর বয়লারের ভিত তৈরির কাজ শেষপর্যায়ে রয়েছে। খুব শীঘ্রই বিদ্যুত কেন্দ্রের মূল যন্ত্রাংশ পায়রায় এসে পৌঁছবে। প্রায় তিন হাজার মানুষের দিনরাত পরিশ্রমে নির্ধারিত সময়ের আগেই এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির তাপবিদ্যুত কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী মাসে অর্থাৎ নবেম্বরেই বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য চায়না এক্সিম ব্যাংক অর্থও ছাড় করতে যাচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র তাদের সামনে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সাধারণত প্রকল্প শুরুর আগেই ঠিকাদারকে অর্থ প্রদানের রীতি প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু পায়রা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১৫ শতাংশ খরচ করার শর্ত জুড়ে দিয়ে এনইপিসি এবং সিইসিসি কনসোর্টিয়ামকে কাজ দেয়া হয়। এতে বিদ্যুত কেন্দ্রটির চুক্তি সই হওয়ার পর থেকেই কাজ শুরু হয়েছে। অর্থের জন্য কাজ একদিনও আটকে থাকেনি। অন্যসব প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই ধরনের নীতি গ্রহণ করা হলে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নতুন পথ দেখিয়েছে। এরমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নতুন একটি আধুনিক আবাসস্থল নির্মাণের কাজও শেষপর্যায়ে রয়েছে। এখানে আধুনিক জীবনযাপনের জন্য সেমিপাকা বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার, খেলার মাঠ, গোচারণক্ষেত্র রাখা হচ্ছে। তবে সব থেকে আশার কথা হচ্ছে, বিদ্যুত কেন্দ্রটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ঠিক করেছে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মাণ করা স্কুলটিতে কারিগরি বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে সরাসরি বিদ্যুত কেন্দ্রে কাজ দেয়া হবে। বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ শেষের আগেই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে এসব বাড়ি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছে বিদ্যুত বিভাগ। বাংলদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে শর্ত অনুযায়ী ঠিকাদার ১৫ ভাগ অর্থ প্রকল্পে যোগান দিয়েছে। প্রকল্পটির মূল অবকাঠামো নির্মাণে এনইপিসি এবং সিইসিসির সঙ্গে এক হাজার ৬৮৭ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। কোম্পানিটি তাদের মূলধনের ১১০ মিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যে প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহের জন্য দিয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুত কেন্দ্রটির ভৌত নির্মাণকাজ ২৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত তিন হাজার ৬৬৩ পাইল স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। কোলইয়ার্ড নির্মাণের জন্য পিএইচসি পাইল সাইটে পৌঁছেছে। এক নম্বর বয়লার স্থাপনের জন্য স্টিলের অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে আর দুই নম্বর বয়লারের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণের কাজ শেষপর্যায়ে। প্রকল্প এলাকায় নির্মাণ করা অস্থায়ী জেটিতে পণ্য ওঠানামার কাজ শুরু হয়েছে। মেইন পাওয়ার বিল্ডিংয়ের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সার্ভিস রোড এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকল্প নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পঞ্চাশ পুলিশের জন্য একটি ব্যারাক নির্মাণকাজ শেষের পথে। নির্মাণ করা হয়েছে প্রকল্পের পরিদর্শন অফিস, কর্মকর্তাদের জন্য আবাসস্থল। দ্রুত এগিয়ে চলছে পুনর্বাসনের কাজ। এরমধ্যে পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রায় সবগুলো বাড়ির কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। দুটি বাড়ির চালে টিনও চড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম খোরশেদুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা এখন বিদ্যুত কেন্দ্রের কয়লা সংস্থানের জন্য চুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা মনে করছি বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্ধারিত সময়ের আগেই উৎপাদনে আসবে। এজন্য সর্বোচ্চ গতিতে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আগামী জুন থেকেই বিদ্যুত কেন্দ্রের যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু হবে। ২০১৯-এর এপ্রিলে প্রথম ইউনিট এবং অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণে দুই হাজার ৭শ’ জন একসঙ্গে কাজ করছেন। এরমধ্যে এক হাজার ২শ’ চীনা রয়েছেন। দেশীয় এক হাজার ৫শ’ জন এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। কেন্দ্রটির নিরপাত্তায় ৮০ চীনা এবং ৫৯ বাংলাদেশী নিরাপত্তারক্ষী নিযুক্ত রয়েছেন। দেশে বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগের পর পায়রা কেন্দ্রটি দ্রুততম সময়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য আস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে সমান হারে কয়লা আনা হবে। প্রতিদিন কেন্দ্রটির জন্য ১২ হাজার টন কয়লা প্রয়োজন হবে। বছরে চার মিলিয়ন টন। বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে ৬০ দিনের কয়লা মজুদ রাখতে সাত লাখ ৮০ হাজার টন ধারণক্ষমতার কোলইয়ার্ড নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়লা আমদানির জন্য সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়েছে। এখন চূড়ান্ত চুক্তি সই করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। তবে সময়মতো পায়রা সমুদ্রবন্দরের ড্রেজিং শেষ না হওয়ায় কয়লা খালাস করতে বেগ পেতে হবে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ ড্রেজিংয়ের জন্য বেলজিয়ামের একটি কোম্পানির সঙ্গে এমওইউ সই করলেও এখনও কাজ শেষ হয়নি। এতে বিদ্যুত কেন্দ্রের কয়লা আনলোডের জন্য চট্টগ্রাম বা আন্দামান বন্দর ব্যবহার করতে হবে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্যে বন্দরটি ঘিরে গড়ে ওঠা অন্য প্রকল্পগুলোও বিপাকে পড়েছে। ড্রেজিং শেষ না হওয়ায় শুধু পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের কয়লা খালাস নয়, দক্ষিণের উন্নয়নে সরকার যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল) এবং চীনা কোম্পানি সিএমসি বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি গঠন করে কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে। এ কেন্দ্রটিতে বাংলাদেশ সরকার এবং চীন সরকারের সমান অংশীদারিত্ব রয়েছে। চীনা এক্সিম ব্যাংক প্রকল্পটিতে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদন শুরু করবে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল। একই ক্ষমতার অন্য ইউনিটটি ওই বছরের ৩০ অক্টোবর উৎপাদনে আসবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ (পিজিসিবি) গ্রিডলাইন নির্মাণ করছে। আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুত কেন্দ্রটিতে দূষণ প্রতিরোধে আধুনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হবে। এতে বায়ু, পানি এবং শব্দে কোন দূষণ ছড়াবে না। কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরকালে গত বছরের অক্টোবরে বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য ঋণচুক্তি সই হয়। এরপর চীনা এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে। নবেম্বরেই কেন্দ্রটির জন্য প্রতিশ্রুত ঋণের অর্থ ছাড় করবে চীনা ব্যাংকটি। প্রসঙ্গত, দেশে বড় বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণ উদ্যোগের শুরুতে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। নানামুখী প্রতিবন্ধকতা রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণকে বিলম্বিত করেছে। সম্প্রতি রামপাল কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। রামপালের দুই বছর পর সমঝোতা স্মারক সই হলেও পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। এর বাইরে জাইকার অর্থায়নে মাতারবাড়িতে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি একটি ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য চুক্তি করেছে। তবে এখনও ওই কেন্দ্রের কাজ শুরু হয়নি। এই তিন কেন্দ্রের বাইরে দেশে আর কোন বড় বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পরেনি বিদ্যুত বিভাগ।
×