ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের নিয়ে খেলছে আরএসও, বানাচ্ছে বলির পাঁঠা!

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২২ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের নিয়ে খেলছে আরএসও, বানাচ্ছে বলির পাঁঠা!

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ রাখাইন রাজ্যে দুটি কারণকে প্রাধান্য দিয়ে আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপের ক্যাডাররা দেশটির নিরাপত্তা চৌকিতে হামলে পড়েছিল। ১৯৭৭ সাল থেকে কয়েক বছর পর পরই এরা মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চৌকিতে হামলা চালিয়ে আসছে। ওসব হামলার পর দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারে সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কিছু অংশ পালিয়ে এসে ইতোপূর্বেও আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। যাদের অনেকে এখনও প্রত্যাবাসন হয়নি। সম্প্রতি দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দুই মাসের প্রত্যাবাসন চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সদ্য অনুপ্রবেশকারী কয়েক রোহিঙ্গা নেতা এবং সীমান্তের একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, অন্য জাতিগোষ্ঠীর ন্যায় সকল প্রকার নাগরিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে স্বাধীন আরাকান গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন নতুবা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে শর্তসাপেক্ষে শান্তি আলোচনায় বসতে বাধ্য করার লক্ষ্যে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা বার বার দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার পথ বেছে নিচ্ছে। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে সেখানে নিপীড়িত এবং অধিকার বঞ্চিত থাকায় রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা চরম পন্থার দিকে পা বাড়িয়েছে। তারা এটি জঙ্গী বা চরমপন্থা বলে মনে করে না। এটা তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই বলে দাবি করছে তারা। বিদ্রোহীদের মতে, সাধারণ রোহিঙ্গাদের স্বার্থেই তাদের এ লড়াই। তবে সাধারণ রোহিঙ্গারা আরাকান বিদ্রোহীদের চক্রান্তের শিকার বলে মত প্রকাশ করেছে অভিজ্ঞ মহল। তারা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে যারা খেলছে তারা কৌশলে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। নিজেদের স্বার্থরক্ষায় রোহিঙ্গা সমস্যাটি জিইয়ে রাখতে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মহলে জোর লবিং ও তদ্বির শুরু হয়েছে পুরনো ধনাঢ্য (আরএসও) রোহিঙ্গাদের। ফলে ১৯৭৮ সাল থেকে বার বার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা স্রোতে বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সচেতন মহল জানায়, একটি সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করা বা তাদের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়া রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আদৌ সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নয়। অথচ মাঝে মাঝে বিদ্রোহীরা যে চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে, তাতে বিদ্রোহীরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের একটি মোক্ষম অস্ত্র হাতে তুলে দিচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গার জীবনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে বিদ্রোহীরা অদূরদর্শী কোন সিদ্ধান্ত নিলে তার পরিণাম কত যে ভয়াবহ হতে পারে, তা তাদের ভালভাবে বোঝা উচিত। তাদের এই লড়াইকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে আখ্যা দিয়ে দেশটির সেনাবাহিনী সাধারণ রোহিঙ্গার ওপর বার বার ঢালাওভাবে নিপীড়ন চালাবে, আর প্রাণ বাঁচাতে তারা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়ে স্থানীয়দের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে; এটা আরএসও-আরসার জঙ্গীদের বোঝা উচিত। বর্তমান রাখাইন রাজ্য থেকে সিংহভাগ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হয়ে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। আর মাত্র দুই লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়ন করতে পারলে তাহলে অচিরেই রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে যাবে। অভিজ্ঞজনরা বলেন, আরাকান বিদ্রোহীদের কারণে রাখাইনে হত্যা এবং ধর্ষণের শিকার হয়েছে বহু রোহিঙ্গা। নিজ নিজ মাতৃভূমি, জমিজমা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভিটাবাড়ি ত্যাগ করে আরেকটি দেশে শরণার্থী হয়ে জীবনযাপন করার দায় এড়াতে পারে না বিদ্রোহীরা। তাই রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের উচিত সহিংসতার পথ পরিহার করে সকল প্রকার মানবিক এবং নাগরিক অধিকার আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। আরাকান স্বাধীন করার নামে নাভীছেড়া দেশে রোহিঙ্গা নিশ্চিহ্ন না হয়ে নাগরিক অধিকার আদায়ের দিকে তাদের জোর দেয়া উচিত। ১৯৭৮ সালে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার বেশিরভাগই প্রত্যাবাসন হলেও থেকে যায় সে দেশের দাগী ও সন্ত্রাসী প্রকৃতির কিছু কিছু রোহিঙ্গা। যারা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে অবস্থান নিয়ে আরএসও, এআরএনও, আরপিএফসহ বিভিন্ন শক্তিশালী সংগঠন গড়ে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে আন্দোলন করেছে। সে সময় কোন সফলতা আসেনি। পরে আবির্ভূত আল ইয়াকিন তথা আরসার কর্মকা- নিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে তাদের বলিরপাঁঠা হতে হয়েছে রোহিঙ্গাদের। সীমান্তের একটি সূত্র জানায়, আরসার লক্ষ্য মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা। বিদেশী ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আরসার সংযোগের কোন শক্ত প্রমাণ না থাকলেও বর্মী সরকার সন্দেহ করছে, দলটি বিদেশী ইসলামী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের সাহায্যপুষ্ট। আবার কারও কারও মতে, আরসা মিয়ানমার সরকারের সৃষ্টি। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের জন্যই অজুহাত তৈরি করে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে আরসা প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর মিয়ানমার মংডুর কাউয়ারবিলে ৩টি সীমান্ত চৌকিতে হামলায় ৯ কর্মকর্তা ও ৪ সৈনিক মারা যায়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দিবাগত রাতে সশস্ত্র দলটি উত্তর মংডু এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি ও সেনাঘাঁটিতে সমন্বিত হামলায় ১২ নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়। এরপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে। স্থানীয়রা জানান রোহিঙ্গারা অকৃতজ্ঞ, জঙ্গী তৎপরতা, সন্ত্রাসী কর্মকা-, মাদক ব্যবসাসহ নানান অপরাধের সঙ্গে জড়িত এমন ধারণা থাকা সত্ত্বেও মানবিক বিবেচনা, ধর্মীয় ও জাতিগত আবেগসহ বিভিন্ন কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি এদেশের মানুষের দয়া এবং করুণা আছে। যেহেতু স্থানীয়রা ভালভাবে জানেন, একটা জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা, ধর্মীয়, নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠছে। রাগ, ক্ষোভ, প্রতিশোধের স্পৃহা ইত্যাদি নিয়ে যারা বড় হচ্ছে তাদের কাছে ভাল আচরণ আশা করা তো উচিত নয়। মিয়ানমারে তারা যুগ যুগ ধরে মানবিক এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। সূত্র জানায়, আগে থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, দেখা গেছে টাকার বিনিময়ে তাদের যে কোন অপরাধমূলক কর্মকা-ে খাটানো যায়। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধেও তারা অস্ত্রশস্ত্রে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারদের সঙ্গে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রোহিঙ্গারা দলে দলে রাস্তায় নেমে এসেছিল। যুদ্ধাপরাধী সাঈদী মুক্তি আন্দোলনে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে কক্সবাজার শহরে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিল। হামলে পড়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর। ওই সময় তাদের সশস্ত্র হামলায় হাশেমিয়া মাদ্রাসা ও ঈদগাঁওতে নিহত হয়েছিল তিন গ্রামবাসী। ওই রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সাবেক আরএসও কমান্ডার হাফেজ ছলাহুল ইসলাম, মৌলবি শফিকুর রহমান, মৌলবি আয়াছ, নুর হোসেন, মৌলবি আবদুল হামিদ, বাইট্টা শামসু, হাফেজ হাসিম, মৌরীব সলিম উল্লাহ ও মৌলবি আবদুর রহিমসহ কয়েক আরএসও নেতা। যারা এখনও বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা স্থাপনসহ ঘাপটি মেরে রয়েছে। ইতোপূর্বে রামুতে গোপন বৈঠক থেকে গ্রেফতার ও পরে জামিনে মুক্ত হয়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা জঙ্গী আবু সিদ্দিক আরমান ওসব আরএসও ক্যাডারের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ পাঠিয়ে থাকে নিয়মিত। ভয়ঙ্কর জঙ্গী আবু সিদ্দিক আরমানের নামে জেলার বিভিন্নস্থানে কোটি কোটি টাকা মূল্যের একাধিক ভূসম্পদ রয়েছে এবং ওসবের দেখভাল করার দায়িত্বে রয়েছে রোহিঙ্গা আরএসও ক্যাডার হাফেজ হাসিম। ওই সময় পালানোর প্রাক্কালে বাস টার্মিনাল থেকে ২৫ রোহিঙ্গাকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে আরএসও জঙ্গীদের ব্যাপক তদ্বিরে ছাড়া পেয়ে যায় সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। এদিকে ২০১৬ সালের ১২ মে টেকনাফ নয়াপাড়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে আনসার বাহিনীর শালবন ব্যারাকে হামলা চালিয়ে অস্ত্র এবং বিপুল গুলি লুট করা হয়েছিল। সেই হামলায় আনসার কমান্ডার মোঃ আলী নিহত হওয়ার পাশাপাশি অনেকে আহত হয়েছিলেন। পরে লুণ্ঠিত অস্ত্র উদ্ধার ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এই হামলা চালিয়েছিল বলে সত্যতা বেরিয়ে আসে। তাই বাংলাদেশ, দেশের জনগণ এবং সরকার বেকায়দায় পড়ে এমন কোন কাজে রোহিঙ্গাদের না জড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সচেতন মহল বলেন, রোহিঙ্গারা এদেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য হুমকি এমন ভাবমূর্তি যেন প্রতিষ্ঠা না পায় সেদিকে রোহিঙ্গা নেতাদের সাবধান থাকতে হবে। বাংলাদেশ এবং এদেশের মানুষ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। এ দেশ, এদেশের জনগণ, ভূমি, প্রকৃতি, শান্তি ও সুরক্ষার প্রতি তাদেরকে যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি স্বার্থান্বেষী মহলসহ তাদের নিয়ে কেউ যাতে রাজনীতির খেলা খেলতে না পারে, সেদিকেও সচেষ্ট থাকতে হবে।
×