ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মঋণ

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ২২ অক্টোবর ২০১৭

জন্মঋণ

যে দেশে মানুষ জন্মগ্রহণ করে থাকে, সেই দেশটির প্রতি তার দায় থাকে। আর সে কারণেই মাতৃভূমির জন্য মানুষ জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে যুদ্ধে যায়। তেমনি যে পরিবারের সন্তান হিসেবে তার পৃথিবীতে আগমন, সেই পরিবারের প্রতিও তার দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে। সবার আগে বাবা-মায়ের প্রতি তার অঙ্গীকারবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়। পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বড় করে তোলেন। তাদের যথাযথ শিক্ষার্জনে সর্বাত্মক সহায়তা দেন। আজকাল একটি সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। বাবা-মায়েরা শত কষ্ট হলেও সন্তানের জন্য অর্থব্যয়ে কখনও কার্পণ্য করেন না। অথচ অনেক সন্তান উপার্জনক্ষম হয়ে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের কথা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যান। সুস্থ ও উপার্জনক্ষম থাকা অবস্থায় পরিবারের বাবা-মা কখনই তার সন্তানের টাকা নিতে চান না। কিন্তু প্রয়োজনে উপায়হীন হয়ে সন্তানের মুখাপেক্ষী হতে হয় তাদের। আমাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত নৈতিকতা ও মূল্যবোধই হলো বড় হয়ে সন্তান তার বাবা-মায়ের পাশে থাকবে; তাদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কালেকালে সমাজ থেকে সেই সুন্দর মূল্যবোধ হারিয়ে যেতে বসেছে। এক্ষত্রে বাধ্য হয়ে তাই রাষ্ট্রকেই উদ্যোগী হতে হয়েছে। পরিবারের সঙ্কটে সমস্যায় রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সন্তান যখন বৃদ্ধ ও উপার্জনহীন বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব এড়িয়ে যান, তখন রাষ্ট্রকে ভূমিকা নিতে হয়। সমাজের বয়স্কদের ভরণপোষণ ও সেবাশুশ্রƒষার দায়িত্ব তাদের সন্তানদের। সন্তানরা সেই দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ালে তাদের সুপথে আনার দায়িত্ব নিকটাত্মীয় কিংবা পরিচিতজনদের ওপরই বর্তায়। রাষ্ট্র ও সমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে সমাজের শিক্ষিত বিবেকবান সংস্কৃতিবান অংশের দায়িত্ব অনেক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেই দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের শিখা জ্বালিয়ে রাখা চাই। বেঁচে থাকলে প্রতিটি শিশুরই জীবনে আসবে বৃদ্ধকাল। বয়স্কদের জন্য আজকের তরুণসমাজ যদি শ্রদ্ধা ও মমতাবোধকে জাগ্রত না রাখে, তাহলে তাদের বৃদ্ধকালে উত্তরসূরিদের কাছ থেকে সে কিভাবে উত্তম কিছু প্রত্যাশা করবে? আমরা চাই বৃদ্ধাশ্রম নয়, পরিবারই হোক বাবা-মায়ের নিরাপদ আবাস। মানুষ দিনে দিনে আরও শিক্ষিত ও আধুনিক হচ্ছে, অথচ তার ভেতর থেকে খসে পড়ছে মানবতা, বিলুপ্ত হচ্ছে পরম মূল্যবোধ। এই সমাজে এমন আত্মকেন্দ্রিক মানুষও আছেন যারা জন্মদাতা পিতা কিংবা জন্মদাত্রী মাতাকে রেখে আসছেন বৃদ্ধাশ্রমে। কর্মসূত্রে সন্তান যদি দূরেও থাকেন তবু বাবা-মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব তাকে নিতেই হবে। এমন পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরকার পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩ পাস করেছে। এ আইনে পিতা-মাতা, দাদা-দাদি এবং নানা-নানির ভরণপোষণ করা সন্তানের নৈতিক ও আইনী দায়িত্ব। অন্যথায় তাদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিছুকাল আগে কোন সরকারী চাকরিজীবী বাবা-মাকে বৃদ্ধ বয়সে ভরণপোষণ না দিলে তাঁকে পদোন্নতি না দিতে ও বেতন কাটার জন্য পরিপত্র জারি করার সুপারিশ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য অসমে এমন একটি আইন প্রণয়ন হতে চলেছে, যাতে সরকারী কর্মচারীরা তাদের বাবা-মায়ের ঠিকমতো দেখাশোনা না করলে তাদের বেতন থেকে একটা অংশ কেটে নেয়া হবে। এটা ঠিক যে, কেবল আইন করে সব অধিকার আদায় করা যায় না। এজন্যে মানুষের বিবেচনাবোধ ও সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। জন্মঋণ এড়ানোর কোন সুযোগ নেই সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দাবিদার মানুষের।
×