ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিবন্ধনে আগ্রহ বেড়েছে

১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সোয়া দুই লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ২১ অক্টোবর ২০১৭

১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সোয়া দুই লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন

ফিরোজ মান্না ॥ মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতায় নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে। পাসপোর্ট অধিদফতর কাজটি শুরু করেছে। প্রথমে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীতে ২টি টিমের ২০টি বুথে ছবি তোলা, নিবন্ধন আইডি কার্ড দেয়া হচ্ছে। নিবন্ধনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পাসপোর্ট অধিদফতরকে। শুক্রবার পর্যন্ত সোয়া দুই লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন হয়েছে। সম্পূর্ণ বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। প্রতিজনের ১০ আগুলের ছাপ নেয়া হচ্ছে। এই কার্যক্রমে এক শ’ সেনা ও ৬০ বিজিবি সদস্য কাজ করছেন। এর আগে পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে রোহিঙ্গাদের শুমারি কার্যক্রম চালায়। তারা ২ লাখ রোহিঙ্গার শুমারির কাজ শেষ করেই ক্ষান্ত দিয়েছে। এরপর সরকার পাসপোর্ট অধিদফতরকে নিবন্ধনের দায়িত্ব দিয়েছে। পাসপোর্ট অধিদফতরের ডিজি মেজর জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান জনকণ্ঠকে বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিবন্ধন কাজ শুরু করা হয়েছে। প্রথমে আমরা ২ টিমে ২০টি বুথে কাজ শুরু করেছিলাম। এখন তা বাড়িয়ে ৭০টি স্টেশনে নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নিবন্ধন কার্যক্রম চলে। ১৬০ জনবল দিয়ে নিবন্ধন কাজ চালানো হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে নিবন্ধন কার্যক্রমে লোকবল বাড়ানো হবে। প্রতিটি বুথ থেকেই ১০ মিনিটের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা নাগরিককে পরিচয়পত্র দিয়ে দেয়া হচ্ছে। পুরাতন ও নতুন সব রোহিঙ্গাকেই নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে; যাতে কেউ বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে পাসপোর্টসহ অন্যান্য সুবিধা না নিতে পারেন। নিবন্ধন কার্যক্রমের জন্য সরকার প্রাথমিকভাবে দেড় কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। আরও সাড়ে ৪ কোটি টাকা কয়েক দিনের মধ্যে বরাদ্দ পাওয়া যাবে। ওই টাকা পেলে স্টেশনের সংখ্যা বাড়ানো হবে। রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিবন্ধন কার্যক্রমের নাম দেয়া হয়েছে ‘মিয়ানমার ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন’। দেশে এখন পর্যন্ত ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের একটা পরিচয় না দিলে তারা মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাবে। জেনারেল মাসুদ বলেন, এমআরপি পাসপোর্ট কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করায় সরকার কাজটি পাসপোর্ট অধিদফতরকে দিয়ে করাচ্ছে। আমরা ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছি। তখন অল্প কয়েকটি কম্পিউটার ও প্রিন্টার দিয়ে কাজ শুরু করি। লোকজন তখন সমালোচনা শুরু করে, এভাবে নিবন্ধন চললে ১০ বছর সময় লাগবে। কিন্তু মানুষের সেই ধারণা অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বদলে যেতে শুরু হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সোয়া দুই লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের নিবন্ধন কাজ শেষ হয়েছে। ধীরে ধীরে কাজের গতি বাড়ছে। এখন দিনে প্রতিটি বুথ থেকে এক শ’ রোহিঙ্গার নিবন্ধন হচ্ছে। কয়েকদিন পরেই প্রতিটি বুথ থেকে দুই শ’ জনের নিবন্ধন হবে আশা করছি। জেনারেল মাসুদ তিন দিন ধরে কক্সবাজারের উখিয়া-বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থাপিত বুথ পরিদর্শনে রয়েছেন। তিনি কক্সবাজার থেকে বলেন, বৃষ্টি উপেক্ষা করে নিবন্ধন কর্মীরা কাজ করছেন। রোহিঙ্গা নাগরিকরাও বুথে বুথে এসে নিবন্ধন করে যাচ্ছেন। সূত্র জানিয়েছে, ২৫ আগস্ট থেকে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কতসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তার কোন সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ প্রধান জানিয়েছেন, এ সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অন্যান্য সংস্থা বলছে, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা কম করে হলেও ১০ লাখ হবে। এখন প্রতিদিন যে হারে রোহিঙ্গা নাগরিক দেশে ঢুকছে তাতে সংখ্যার হিসাব বেড়ে যাবে। ইউএনএইচসিআর বলছে, মানসম্মত শুমারি ছাড়া সঠিক সংখ্যা বলা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার নতুন আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা জানতে শুরু করেছে শুমারি ও নিবন্ধন কার্যক্রম। সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট স্থানীয়রা এই কাজ শুরু করেছেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প ও এলাকা, বান্দরবান এবং চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় এই শুমারি চলছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সব রোহিঙ্গার প্রকৃত সংখ্যা জানতে গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শুমারি শুরু করে। নবেম্বর নাগাদ তা পুরোপুরি নির্ধারণ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরই মধ্যে নতুন করে রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থীরা বাংলাদেশে আসতে শুরু করলে, আগের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। নিজ দেশে জাতিগত সহিংসতায় নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষ। ২৪ আগস্ট কোফি আনান কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর দিবাগত রাতে আরাকান রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলার অভিযোগে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে অভিযানে নামে সে দেশের সেনা-পুলিশ। তারা সাধারণ রোহিঙ্গাকে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে এলাকা ছাড়া করে। ঘটনার পর থেকে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে এসে জড়ো হয় আতঙ্কিত হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষ। তখন তাদের বাংলাদেশে ঢুকতে বাধা দেয়া হলেও ১ সেপ্টেম্বর রাত থেকে নতুন করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢোকা শুরু করে। এরপর থেকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সীমান্ত খুলে দেয়া হয়, লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে ৫ লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। সহযোগিতা দেয়া ও নিরাপত্তার সুবিধার্থে এসব রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের মাধ্যমে পরিচয়পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। সে অনুযায়ী পাসপোর্ট অধিদফতর নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছে। পুরনো রোহিঙ্গা নাগরিকদেরও নিবন্ধনের আওতায় আনা হবে বলে পাসপোর্ট অধিদফতর জানিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন বা নিপীড়ন বলতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান সামরিক অভিযান শুরু করে। প্রথমে দোহাই দেয়া হয় ২০১২ সালের অক্টোবরে অজ্ঞাত বিদ্রোহীরা বার্মা সীমান্তে হামলা করেছে। তথাকথিত ওই হামলার জের ধরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও শিশুহত্যাসহ অত্যধিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।
×