ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

গুজবে কান দেবেন না ॥ গুজব সত্য নয়

প্রকাশিত: ০৩:১৩, ২১ অক্টোবর ২০১৭

গুজবে কান দেবেন না ॥ গুজব সত্য নয়

আমরা হুজুগপ্রিয়। আমরা গুজবপ্রিয়। শুধু প্রিয় বললে হবে না, গুজবের গল্প পেলে তার আশপাশে ঘুর ঘুর করাটা আমাদের স্বভাব। গুজবের বৃক্ষ তৈরিতে আমাদের মতো সফল আর কে আছে আমার জানা নেই। সেই বৃক্ষের কত যে শাখা-প্রশাখা! কত যে চটকদার পত্রপুষ্প। শত সতর্কতার পরেও সেই গুজব বৃক্ষের কাছে না আমাকে থমকে দাঁড়াতে হয়। হয়ত ক্ষণিকের জন্য। কেন জানি গুজবের গন্ধ পেতে নাক উসখুস করে, কান খাড়া হয়। ওই যে আগেই বলেছি এটা স্বভাবের দোষ। যারা বিচক্ষণ বুদ্ধিমান, যারা সত্য তথ্য চিনতে পারেন এবং তার বিশ্লেষণের ক্ষমতা রাখেন তাদের কথা আলাদা। তাদের সংখ্যাও অপেক্ষাকৃত কম। তবে এদের ভেতর যারা জ্ঞানপাপী তারা গুজব চর্চাকারীদের চেয়ে বহুলাংশে ক্ষতিকর। অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। অভিজ্ঞতা এও বলে যে, একেকটা সময় আসে যখন অবিরাম গুজব প্রবাহের ধাক্কায় বিরক্ত হতে হয়। মাঝেমাঝে বিচলিতও হতে হয়। আগস্ট মাসের শুরু থেকে প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে গুজবের কারখানাগুলোতে কাঁচামালের সরবরাহ বেড়ে গেল এবং কারখানাগুলো হয়ে উঠল অধিকতর সক্রিয়। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গ। যেখানে আমরা বাতাসে গুজবের গন্ধ পেয়ে ম্যাজিকের মতো ঘটনার ঘনঘটা সাজাই, মনের মাধুরী মিলিয়ে গল্প বানাই, সেখানে উল্লিখিত প্রধান বিচারপতি এবং রোহিঙ্গা বিষয় দুটিতে রগরগে কাঁচামাল। মেশিনে ফেললেই সকাল-বিকেল নতুন নতুন চটকদার গল্প। ৪ অক্টোবর দেশের বাইরে এসেছি হাজার হাজার মাইল দূরে, আমেরিকায়। ভেবেছিলাম গুজবের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। কিন্তু না, মুক্তি মেলেনি। এখানেও বাঙালীর মধ্যে অনেক গুজবের গল্প। সত্য-মিথ্যা বিচারে তাদের হাজারো প্রশ্ন। যেন স্যুটকেস ভর্তি করে আমি তাদের সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এসেছি। মনে পড়ে কবি নির্মলেন্দু গুনের সেই বিখ্যাত কবিতাটির কথা। কবিতার নাম হুলিয়া। ’৭১ সালে প্রকাশিত কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা এটি। কবিতার নায়ক রাষ্ট্রদ্রোহী। অনেকের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজ গ্রামে যাওয়ার পর উচ্চকণ্ঠিত সতীর্থদের প্রশ্নের সম্মুখীন-‘ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসা করবে ঢাকার খবর।/ আমাদের ভবিষ্যত কি?/ আইয়ুব খান এখন কোথায়?/ শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?/ আমার নামে কতদিন আর এ রকম হুলিয়া ঝুলবে?/’ এবারে আমেরিকায় এসেছি উত্তর আমেরিকা বাংলাদেশ কনভেনশন (এনএবিসি)-এর তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে, অতিথি হয়ে। সেই সঙ্গে কানাডার মন্ট্রিয়ালে ‘বঙ্গবন্ধু’ মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ’ শিরোনামের আলোচনা অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে। এনএবিসির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে ফ্লোরিডা রাজ্যের ফোর্ট লডরডেল শহরে। অক্টোবরের ৬, ৭ এবং ৮ তারিখের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আমেরিকা এবং কানাডার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শত শত প্রবাসী। স্থানীয় বাঙালীরা তো ছিলেনই। সুদূর প্রবাসে এটা হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মানুষের এক আনন্দের মিলনমেলা। যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। আলোচনা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঝলমলে সাজপোশাক এবং বাঙালীর নানা প্রকার খাদ্যÑ সব মিলয়ে এনএবিসির সম্মেলন সফল হয়েছে, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সমাপ্তি পর্বে সম্মেলনের ঘোষণায় উচ্চারিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাশ্রিত মানবিক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার কথা। উচ্চারিত হয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার প্রতি সমর্থনের কথা। অনুষ্ঠান স্থল, হোটেলের লবি, ডাইনিং হল- এসব জায়গায় দেখেছি বাংলাদেশের প্রায় স্তিমিত হয়ে যাওয়া গুজবের অনুরণন এবং শুনেছি অনেক অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে অহেতুক আলোচনা। বুঝতে অসুবিধা হয় না এসবের পেছনে রয়েছে একটা গোষ্ঠী যারা পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা কথার বেসাতি করে। অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে সামাজিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে চাতুর্যের সঙ্গে তারা সরল প্রাণ প্রবাসীর মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি করে, বিভ্রান্তি ও হতাশা ছড়ায়। পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণ থেকে জানি উত্তর আমেরিকায় একটি সংঘবদ্ধ শ্রেণী সামাজিক গণমাধ্যমে নিয়মিতভাবে এমন সব উদ্ভট এবং মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ছোটায় যাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। তাদের টার্গেট বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনা। এই গোষ্ঠীর অধিকাংশই শিক্ষিত, বিত্তবান এবং সামাজিক ক্ষেত্রে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত। ডাহা মিথ্যাকে তারা যেভাবে সুন্দর লেখনীতে ফেসবুক, ই-মেইল ইত্যাদির মাধ্যমে প্রবাসীদের মাঝে ছড়ায় তাকে অনেকে সত্য ভেবে বিভ্রান্ত হতেই পারেন। এই অপপ্রচার এবং অসত্যের বিপক্ষে সংগঠিতভাবে সত্য প্রচারের বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্যোগ যত দ্রুত নেয়া যায় ততই মঙ্গল। উত্তর আমেরিকায় বেড়ে উঠছে একটি বাঙালী প্রজন্ম যারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে পারদর্শী। এই প্রজন্ম দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না সত্য কিন্তু বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের রয়েছে সীমাহীন অহঙ্কার। এই প্রজন্মের আরও রয়েছে অকপট সারল্য এবং প্রশ্নহীন সততা। হটকারী জ্ঞানপাপীদের বিরুদ্ধে এই প্রজন্মই হবে তরুণ তুর্কী। যারা বিজ্ঞান মনস্ক এবং আধুনিক। যারা মিথ্যা গুজবে কান দেবে না এবং গুজবকে সত্য বলে স্বীকার করবে না। বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি উত্তর আমেরিকায় প্রচারের কাজ তো তাদেরই মানায়। নতুন তরুণ প্রজন্ম ছাড়াও প্রবাসে রয়েছে প্রগতিশীল চেতনাধারী আমাদের অনেক বন্ধু। শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চাকারী বেশকিছু সংগঠন, তাদেরও সমন্বিত কর্মসূচীর মাধ্যমে এক ছাতার নিচে আনতে হবে। অভিজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা এবং মতামত তরুণদের কাজকে গতিশীল করবে নিঃসন্দেহে। মনে রাখতে হবে সব প্রজন্মেরই নিজস্ব একটা ভাষা থাকে, কর্মপ্রক্রিয়া থাকে, স্টাইল থাকে। তাদের নিজস্ব সাহিত্যও থাকে। সেই সঙ্গে থাকে উদ্দীপ্ত তারুণ্যের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। তাই নতুন প্রজন্মের তরুণ তুর্কীদের হাতেই ধরিয়ে দিতে হবে রিলে রেলের বিজয়ী হওয়ার কাঠি। প্রগতির বিরুদ্ধাচারীরা এখন পরিকল্পিত ছকে প্রবাসে বাংলাদেশীদের বিভ্রান্ত এবং দিকহারা করছে তখন আমাদেরও উচিত সকল মিথ্যা প্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গুজবে কান না দিয়ে হুজুগে না মেতে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরা। এই কাজে অনেক আগেই কোমর বেঁধে নেমে পড়ার প্রয়োজন ছিল। দেরি হয়ে গেছে সত্য, কিন্তু এখনই তো শুরু করা যায়। শেখ হাসিনা এবং তাঁর উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে বিপুলসংখ্যক প্রবাসীকে সম্পৃক্ত করতে পারলে যে সুফল পাওয়া যাবে তা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনবে গৌরবের সম্মান। লেখক : নাট্য ব্যক্তিত্ব
×