ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের ছোট নদী ॥ বাঁকে বাঁকে প্রকৃতির রূপ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২০ অক্টোবর ২০১৭

আমাদের ছোট নদী ॥ বাঁকে বাঁকে প্রকৃতির রূপ

‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটি একদিকে যেমন বাংলার ঋতু শরত ও বর্ষার রূপ বর্ণনায় একটি অনন্যসাধারণ কবিতা অন্যদিকে প্রকৃতি, প্রাণি, মানুষ সমন্বয়ে ছোট নদীর বর্ণনা আর ছান্দসিক ভাষার প্রয়োগ কবিতাটিকে সুপরিচিতি দিয়েছে। কবিতাটিতে ছোটদের জন্য যেমন আস্বাদনের একটি বিষয় রয়ে যায় তেমনি বাংলার নদী বিভিন্ন ঋতুতে যে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে তাও জানা যায়। কবিতাটির মাঝে উল্লেখযোগ্যভাবে চমৎকার চিত্রময়তা ফুটে উঠেছে ; কবিতাটি পাঠ করলে আমরা যেন চোখের সামনেই সেই হারিয়ে যাওয়া গ্রাম্যনিকুঞ্জের মাঝে প্রাণরূপী ছোট নদীটিকে বয়ে যেতে দেখি। আর হারিয়ে যাওয়া অতুলনীয় বাংলা প্রকৃতি যা এখন শুধুই অতীত তা আমাদের নগর কেন্দ্রী শুষ্ক সভ্যতার সামনে দাঁড়িয়ে মনকে ভীষণ নাড়া দেয়। নদী এখানে প্রাণের প্রতীক, বহমানতার প্রতীক, জীবনের প্রতীক আর স্পন্দনের প্রতীক। কবিতাটি আমাদের ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতাটির কথা মনে করিয়ে দেয় কিন্তু তির্যক ব্যঞ্জনায়: ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর, লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি, গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,’ ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় কবি উচ্ছ্বাসে পূর্ণ ; তার, সুর, ছন্দ, মমতাবোধ আর নদীর সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র কবিতাটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে অন্যদিকে কবি নগরায়নের ফলে গাছের ছায়া, তপস্যার বন, ¯œানের সেই নদীর ম্লানরূপ দেখে ব্যথিত তার ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় আর দারুণভাবে বিচলিত তাই কবি নগরায়নকে সর্বগ্রাসী বলে অভিসম্পাত করেন ; ফিরে পেতে চান সেই আদিম কিন্তু অকৃত্রিমকে। কবি মন যখন নিরাশায় দগ্ধ প্রকৃতি পিয়াসী কবি মানস কল্পনায় ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার চিত্র এঁকে তৃপ্ত করেন অতৃপ্ত মনকে। ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় কবি শ্যামল, স্নিগ্ধ, সুনীল বাংলাকে ভালবেসে তার মনোরম, সহজ-সরল, সুশোভিত রূপের সুধাময় বর্ণনা দিয়ে গিয়েছিলেন; তা আজ লুপ্ত, বিনষ্ট। নগর সভ্যতার নামে আমরা আমাদের আবহমানকে ত্যাগ করেছি ; গ্রাম, নদী, গ্রাম্য সাবলীল, নিষ্কলুষ জীবন যেখানে আমাদের আত্মপরিচয় কিন্তু কালের যাত্রায় তা আমরা ভুলে গিয়েছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গ্রাম বা পল্লীর সমস্ত নিয়ামকগুলো এবং পল্লী জীবনের সঙ্গে মানুষের জীবন যে গভীরভাবে জড়িত তা তার কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন। তাই ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় কবি দ্বিধাহীনভাবে সেই পুরানো প্রকৃতি প্রধান বাংলাকে ফিরে চান আর সভ্যতাকে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাাসী বলে পুরোপুরি পরিত্যাগ করেন। ‘আমাদের ছোট নদী‘ কবিতায় কবি গ্রামের গরু, শেয়াল এমনকি বালু কণাকেও ভালবেসে লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার অকৃত্রিম ভাললাগার বাস্তব আবেগে। তিনি তার বিখ্যাত ‘ তপোবন’ প্রবন্ধে খুব স্পষ্ট করে প্রকৃতি ও নদী এবং এদের প্রেমের সাক্ষী রেখে গেছেন - কবি বলেন ‘ কিন্তু ভারতবর্ষে এই একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেছে, এখানে সভ্যতার মূল প্রসবণ শহরে নয় বনে। ভারতবর্ষের প্রথমতম আশ্চর্য বিকাশ যেখানে দেখতে পাই সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষ অত্যন্ত ঘেঁষাঘেঁষি করে একেবারে পি- পাকিয়ে ওঠেনি। সেখানে গাছপালা নদী সরোবর মানুষের সঙ্গে মিলে থাকবার যথেষ্ট অবকাশ পেয়েছিল। সেখানে মানুষও ছিল, ফাঁকাও ছিল, ঠেলাঠেলি ছিল না।’ মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এই প্রীতিকর সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথ বার বার বলে গেছেন তার অনেক লেখায় নদী আর মানুষের সুনিবিড় সম্পর্কের উল্লেখ করে। আধুনিক যুগ যে জনাকীর্ণ, ঠাসাঠাসি, আবদ্ধ সমস্যায় নিপতিত হতে যাচ্ছে কবি মানস তার অশনি ইঙ্গিত পেয়েছিল শতবর্ষ আগেই। তিনি দেখেছিলেন কল্পনার তৃতীয় নয়নে মানুষ প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে। কবি এর আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন অনেক লেখায়। আধুনিক যুগে যেখানে নদী, নালা ডোবা, ক্ষেত, আবাদি জমি ভরাট করে মানুষ নিজের আয়ত্তে নিতে মরিয়া ; যেখানে প্রকৃতি মুক্ত নয় মানুষের বন্দী দাস এই সময় রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি প্রেম দারুণভাবে প্রশংশাযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোট গল্পও গ্রাম প্রধান; মানুষকে কেন্দ্রে রেখে প্রকৃতি, মানুষ ও নদীকে একসূত্রে বেঁধেছেন; আমরা স্পষ্টভাবে ‘সমাপ্তি’ ‘সুভা’ ‘ পোস্টমাস্টার’ ‘ বলাই’ ‘ অতিথি’ ও অন্য আরো অনেক ছোটগল্পেই তা খুঁজে পাই। একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনা শুরু হয় নদীকে কেন্দ্র করেই- ‘ঘাটের কথা’ - তার প্রথম ছোটগল্পই প্রমাণ করে নদী রবীন্দ্র মননে কতো গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান ছাড়াও বিশেষভাবে নদী তার বিভিন্নমুখী লেখায় উল্লেখযোগ্যভাবে উপস্থিত। তার অধিকাংশ কবিতা, গান ও ছোটগল্পে নদীর কথা ছাড়াও উপমা ও চিত্রকল্প হিসেবে এসেছে নদী সম্পর্কিত বিষয়াবলি। যেমন খেয়া ঘাট, পাল, মাঝি, শেষ পারানির কড়ি, তরী, তরঙ্গ, তরণী, জল ইত্যাদি। নদীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন জলের রানী। কবি নদী নিয়ে গান লিখেছেন ; নদী অনুরক্ত কবি বলেন ‘ওগো জলের রানী. . .কখন তুমি শান্তগভীর , কখন টলোমলো. . .কখন আঁখি অধীর হাস্যমদির কখন ছলোছলো’(পূজা -৮২)। ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথের বাবা তাকে জমিজমা দেখার জন্যে পদ্মার তীরবর্তী শিলাইদহে পাঠান তিনি সেখানে দশটি বছরকাল ছিলেন: বস্তুত রবীন্দ্র কবি প্রতিভার উন্মেষ ও উৎকর্ষতা এই নদীকেই ঘিরে। বিশেষ করে শিলাইদহ, শাহজাদপুর আর পতিসরে। এ সময়টা কেটেছে তার নদীতে, ক্ষেতে, সবুজে, পল্লীর সান্নিধ্যে আর নদীকেন্দ্রিক মানব জীবনের সঙ্গে একীভূত হয়ে। নদী কেন্দ্রী জীবন আর প্রকৃতি কবি মানসে স্থায়ী আর সুনিবিড় প্রভাব ফেলে। পদ্মায় নৌকায় যখন তার সুন্দর সময়গুলো কাটত আর বিমোহিত করা নদীর সৌন্দর্য আর এর দু’কূলের সবুজ ¯িœগ্ধ শোভা কবি মানসে সুখ,দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, আবেগ, ভালবাসা, উচ্ছ্বাস নদী ও মানব জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে অপূর্ব সাহিত্যের সৃষ্টি করেছে; তার জীবনদেবতার অনেকখানিই যেন পদ্মার অব্যক্ত অনুভূতির থেকে পাওয়া। ধীরে ধীরে কবি মনের নদীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। পদ্মা নদী তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও নদী তীরবর্তী মানুষ তার অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও চিন্তাচেতনাকে গভীরভাবে আলোড়িত ও আচ্ছন্ন করেছিল; কবির রচনার অন্যতম প্রধান প্রেরণা হয়ে এসেছিল। শিলাইদহে পদ্মার প্রভাবে কবির বিস্ময়কর সৃজনশীলতার বিকাশ; তিনি এ অঞ্চলেই তার সুবিখ্যাত - সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি, কণিকা, ক্ষণিকা, কল্পনা, কথা, নৈবেদ্য, চিত্রাঙ্গদা, মালিনী, গান্ধারীর আবেদন, বিদায় অভিশাপ, এবং এছাড়াও গল্পগুচ্ছের অনেকগুলি গল্প এবং ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিগুলি লিখেন। এই সব রচনার মধ্যেও নদী এসেছে কবি মনের নানান অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি পরিস্ফুট করতে পরতে পরতে। ছিন্নপত্রাবলীর প্রায় পুরোটাই নদীকে আবর্তিত করে মহাকব্যিক আখ্যানে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘কূলে’ কবিতায় ‘আমাদের এই নদীর কূলে/নাই কো স্নানের ঘাট/ধু ধু করে মাঠ’ এমনি করে, ময়ূরাক্ষী, কোপাই, অজয়, ধলেশ্বরী ও আরো অনেক নদীই মিশে গেছে তার লেখায় তাদের বিচিত্র গতিধারা নিয়ে। নদী সেখানে কেবল নদী মাত্র নয় ; নদী সেখানে জীবনের প্রতীক, কবি মননের রঙিন উপমায় চিত্রায়িত । নদী যেন জীবন্ত হয়ে তার অন্তরের সব সুষমাকে আরো প্রকট করেছে ; আর এর ক্ষুদ্ররূপ ‘আমাদের ছোট নদী।’ তাই পদ্মা নদীর বর্ণিল চরিত্র ও বিচিত্র গতিপ্রবাহ তার রচনায় বিভিন্নভাবে এসেছে। তিনি স্বীকার করেছেন ‘বাস্তবিক, পদ্মা নদীকে আমি ভালবাসি...আমি যখন শিলাইদহ বোটে থাকি, তখন পদ্মা আমার কাছে স্বতন্ত্র মানুষের মতো’। পদ্মাই যেন রবীন্দ্রনাথের অনুভূতিতে মানুষের সুখ, দুখ: আশা, নিরাশা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, এমনকি প্রেম ভালবাসার সুক্ষ্ম বিষয়গুলি আরো বেশি প্রগাঢ় করে তুলেছিলো। ‘পদ্মা’ যে নানরূপে তার কবিতায় এসেছে কবি নিজেই তা বলে গেছেন, ‘হে পদ্মা আমার/তোমায় আমায় দেখা শত শত বার’। বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথের কবি মানসের উন্মেষ ঘটেছিল এই পদ্মার তীরে তাই বিখ্যাত ছোট নদী কবিতা তার চির জাগরণের ; আত্ম- আবিষ্কারের সেই পদ্মা নদী। তাই ‘আমাদের ছোট নদী একটি বিশিষ্ট কবিতা হয়ে থাকবে; আছে। সেই ছোট নদী যদি পদ্মা হয় ; পদ্মা তেমনি আছে, যদিও মৃতপ্রায়, শরতের পদ্মার তীরের কাশ এখন প্রায় নিশ্চিহ্ন ; রূপময় যে বর্ষা কবি এর কূলে দেখেছিলেন তা ম্লান; শালিকের ঝাঁকও আজ নেই প্রায়। কবি শিল্পমাধুর্যের অনুপ্রেরণাদায়ী সেই নদী জীবন হারিয়ে আজ বিলীন হবার পথে। আমবন, তালবন, গাঁয়ের বামুন পাড়া আজ ইতিহাস কারণ সেই ছোট নদী এখন নেই তাই একে ঘিরে স্বপ্নের মতো সেই প্রকৃতির রূপ আর জীবনের কোলাহল আজ ইতিহাস। গ্রাম্য জীবন; ছেলেমেয়েদের নদীর জলে আনন্দমুখরতা এ যুগে অচল। কবি বলেছেন সেখানে বালু চিকচিক করে কোন কাদা নেই কিন্তু সভ্যতার নিষ্ঠুরদানে নদীগুলো এখন বিষাক্ত পানিতে বা পানি নামক পদার্থে পূর্ণ। রবীন্দ্র রচনার সাফল্য হচ্ছে বাংলাকে নিরাভরণ, সত্য কিন্তু নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা। তাই গাঁয়ের মেয়েরা যে আঁচল পেতে ছোট মাছ ধরে কবি সেটাও মুগ্ধ হয়ে দেখেন। কবি চমৎকারভাবে গ্রাম্য নারীদের প্রাত্যহিকতাও তুলে ধরেন কবিতাটিতে- ‘বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে, বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহ কাজে।’ বরষা যে আমাদের প্রাাণের ঋতু ; মানুষের জীবনের সঙ্গে যে এ ঋতুর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক তা কবি ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় মনে করিয়ে দেন: ‘আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর। মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে, ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে। দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া, বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।’ ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় নদী ছাড়াও, গ্রামের মানুষ, নদী তীরবর্তী সুন্দর বনভূমি নদীকূলে মানুষের আচার, অভ্যাস, তাদের নদীর সঙ্গে সুগভীর সম্পর্ক এবং ঘটি, থালা, কাপড়, গামছা ইত্যাকার পল্লী উপাদান স্মরণ কবির গ্রাম্য জীবনের প্রতি অনুরাগ ও আবেগ স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতাটি একটি নদীর বর্ণনা বা একটি নদীকে আশ্রিত করে রচিত হলেও ; গ্রাম বাংলার একটি খ-চিত্র অখ-িতরূপে চিত্রায়িত। কবিতাটি যদি আমরা বিনির্মাণ করে পাঠ করি তবে আমরা বাংলাদেশের গ্রাম, মানুষ, নদী ও মানুষের পারস্পরিক সমন্ধ, পল্লী জীবনচিত্র ও কবি মন যে পল্লী বাংলায় সুনিবিড় মমতায় গ্রথিত তার ব্যাপারে সম্যক ধারণা লাভ করি। কবিতাটির বিনির্মাণ আমাদের এ অঞ্চলের ভৌগোলিক ধারণাও দেয়। স্বচ্ছ, নির্মল, শুদ্ধ নদী আর একে ঘিরে মানুষ ও প্রকৃতি আর উচ্ছ্বাস-আকুল জীবন কবি ভালবেছিলেন; আরো অনেক নদী যেমন তার সাহিত্যে মানবজীবন প্রবাহের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা পড়েছে তেমনি ‘আমাদের ছোট নদী’ প্রতীকী আঙ্গিকে প্রকৃতি ও মানবের মাঝে প্রাণবন্ত যোগসূত্র বেঁধে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার সুপরিচিত সহজ পাঠে অঞ্জনা নদী তীরে, চন্দনী গাঁয়ে- কবিতায় যে অঞ্জনা নদীর বর্ণনা দিয়েছিলেন শহরকে ব্যঙ্গ করে আজ সেই নদী হারিয়ে গেছে। নদী যেমন গতিশীল রবীন্দ্র কাব্যও গতিময়তায় অগ্রগামী। বলাকা কবিতা যেমন জীবনের চলার গতি ও পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে উড়ন্ত পাখিদের একটা অন্তর্নিহিত ভাব প্রকাশ করে তেমনি ছোট নদীর এঁকেবেঁকে চলা মানব জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতের, আনন্দ বেদনার, উত্থানপতনের ইতিহাস নির্মাণ করে। তাই ক্ষুদ্র হয়েও আমাদের নদীগুলো গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই ছোট নদীই আমাদের বৃহৎ জীবনের একান্ত, আপন, অমূল্য জীবনাচরণের জন্য ইঙ্গিতবাহী। তার আরেক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো গীতনাট্য ’মুক্তধারা’ এই নাটকে স্বৈরাচারী রাজা রণজিত তার প্রকৌশলী বিভূতিকে দিয়ে এক অতিকায় যান্ত্রিক লৌহযন্ত্র যাকে আমরা বাঁধ ভাবতে পারি ; সেটা দিয়ে মুক্তধারা নদীর পানির নিজস্ব ধারাকে গতিরোধ করতে চায়। এটি করলে শিবতরাইবাসীরা পানির অভাবে মৃত্যুমুখে পড়বে। কিন্তু আরেক যুবরাজ অভিজিৎ তার জীবন দিয়ে এই বাঁধ নির্মাণের চক্রান্ত বিনষ্ট করে; এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ মানুষ অনিষ্টকারী অপচেষ্টায় যে প্রকৃতির অপব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে তার চমৎকার সোচ্চার মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং আমরা ইদানীংকালে নদী থেকে সাগরের অতলে ‘ ব্লু ইকোনমি’ নামে ধনিক রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপে দেখতে পারি শুধু নদী নয় সাগরও মানুষের লোভ থেকে মুক্ত নয়। মানব সভ্যতা শুধু নয় মানব জীবন নানাভাবে নদীর ওপর নির্ভরশীল তাই নদীকে রক্ষা করতে হবে শুধু সৌন্দর্যের কারণে নয় আমাদের প্রয়োজনের তাগিদে।
×