ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সানাউল্লাহ সাগর

সার্কাস সুন্দরী ॥ সময়ের মানসিক বিভ্রাট

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২০ অক্টোবর ২০১৭

সার্কাস সুন্দরী ॥ সময়ের মানসিক বিভ্রাট

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ একাধারে কবি, গল্পকার ও সাহিত্য সমালোচক। প্রতিশ্রুতিশীল এই তরুণের হাতে প্রবন্ধ-নিবন্ধও গতি পায়। দীর্ঘ এক যুগ সাহিত্যচর্চার পর ২০১৭ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম গল্পের বই ‘সার্কাস সুন্দরী।’ বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত তেরোটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। গ্রন্থসূচির প্রথম গল্পটি লেখক জীবনের সূচনালগ্নে প্রেম-অপ্রেমের যে ধাঁধা থাকে, সেই বিষয়কে ঘিরে এগিয়েছে। লেখক সেখানে মিথিলা চরিত্রের মধ্যে সমকালীন নারীর ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পে প্রেমিকার সঙ্গে একজন লেখক বা প্রেমিকের মধ্যকার নিজস্ব জগতের পরিভ্রমণ অঙ্কন করেছেন। এই ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছে দ্বন্দ্বও। তার ‘মাহিনের ইচ্ছেগুলো’ গল্পে ছোটগল্পের যে সংজ্ঞা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়ে গেছেন; সে রকম প্রত্যাশিত-অপ্রত্যাশিতভাবেই সমাপ্তি টেনেছেন। কেন্দ্রীয় চরিত্র মাহিন ও মিথিলা দূরত্ব ও যৌথতা ঘুচিয়ে আবার গাড়িতে প্রবেশের মধ্য দিয়ে নিজেদের চেনা সেই সংলাপের দিকে ফিরে যাচ্ছেন! আসলে কি যাচ্ছেন! কোথায় যাচ্ছেন? আর তাদের হারানো সময়? এ রকম অনেক প্রশ্নের মধ্য দিয়ে পাঠককে গল্পের মধ্যে ডুবিয়ে দেন লেখক। ‘সার্কাস সুন্দরী’র দ্বিতীয় গল্প ‘কবির সঙ্গে ফোনালাপ’। পাঠক হঠাৎই যেন হোঁচট খাবেন। কারণ এ তো রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ফোনালাপ! কোথায় রবীন্দ্রনাথ? কলেজে বাংলা পড়ানো একজন শিক্ষকের কলমে লিখিত ফোনালাপ! কিন্তু একি বিভ্রাট? সময়ের না মানসিক? লেখক তার গল্পে উত্তম পুরুষে এভাবে বলেনÑ ‘ফোন কানে ধরে আছি। অনিন্দিতার হাসির লহরি বেজে যাচ্ছে অবিরাম। আর কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ফোনালাপ। আসলে রবীন্দ্রনাথ আমাকে স্বপ্ন দেখায়। রবীন্দ্রনাথ আমাকে বাঁচতে শেখায়। কেন চলে গেলে রবীন্দ্রনাথ? আর কিছুদিন থাকতে পারলে না? কিংবা আবার কেন ফিরে আসো না?’ বইয়ের ‘ক্ষত’ গল্পের শুরুটা অসাধারণ। গল্পের শুরুতেই ‘তোমার মন চাইলে যে কারো সঙ্গে সেক্স করতে পার। আমি তাতে রাগ করবো না’Ñ বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর এমন কথা শুনে ভড়কে যায় নববধূ সোহানা।’ যে কোন স্বামীর কাছ থেকে নতুন বউ এ রকম কথা শুনে ভড়কে যাবেÑ এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু গল্পের মধ্যেই লেখক তার এমন শুরু করা সংলাপের জবাব পাঠকের কাছে দিয়ে দেন। ‘অসুস্থ ভাবার কিছু নেই। আমি সুস্থ মস্তিষ্কেই কথাগুলো তোমাকে বলছি। ব্যাপারটি পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক। রেগে গেলে সমাধান হওয়ার নয়। কারণ যৌনতা এক ভয়ানক ব্যাধি। দেখ না, ছয় বছরের একটি কন্যাশিশু যৌনতার উপযুক্ত নয় জেনেও ধর্ষক সাইফুল ব্লেড দিয়ে যৌনাঙ্গ কেটে ধর্ষণ করেছে। আসলে চরিত্র আমাদের মুকুট নয় বরং মুখোশ।’ সত্যিই তো তাই। আমাদের চারপাশে মুখোশ পরা প্রতিটি মানুষের মধ্যে যে এক ধরনের যৌনকাতরতা তা আমরা জানি। কিন্তু মানি না। সমাজের খোলস চাপিয়ে তা কোনোক্রমেই স্বীকার করতে চাই না। এই সমাজ আর এই সমাজের দেয়াল টানা সময়ের প্রতি দাঁড়িয়ে সালাহ উদ্দিন মাহমুদের ‘ক্ষত’ যেন আমাদের মধ্যে আরও ক্ষত তৈরি করে দিয়ে যায়। যে সমাজ আমাদের নারী ও পুরুষের আলাদা আলাদা জীবনে অভ্যস্ত করে দিয়েছে; সেই সমাজের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে নিজের মতকে স্বাধীনভাবে প্রকাশের সুযোগ কোথায়? এমন প্রশ্নই আমাদের মধ্যে তৈরি করে দেন ‘সার্কাস সুন্দরী’র প্রণেতা। তবে ‘ক্ষত’ গল্পে লেখক ধর্ম ও সামাজিকতার ছবি তুলতে গিয়ে ক্ষণিক সময়ের জন্য উপস্থাপনাকে এক ধরনের জটিলতার মধ্যে নিয়ে গেছেন বলেই মনে হয়। যেটা অনেক পাঠকের ক্ষেত্রেই হজম করা কষ্টকর হবে। অথবা এমন ঘটাও অস্বাভাবিক নয়। কারণ যা কিছু ঘটতে পারে; তা-ই তো গল্প। বইয়ের নামগল্প ‘সার্কাস সুন্দরী’। এর মধ্যে জীবনের গূঢ় সত্য আবিষ্কৃত হয়েছে। গ্রামীণ জনপদের এক পরিচিত নাম সার্কাস খেলা। মানুষের জীবনের মধ্যে এর প্রভাব চিরন্তন সত্য। সার্কাস সুন্দরীর করুণ পরিণতি গল্পটিকে বাস্তবসম্মত না করলেও এমনটি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। লেখক হয়ত গল্পটিকে মিলনাত্মক না করে বিয়োগান্তক করেছেন। যাতে পাঠকও আপ্লুত হতে পারে। উত্তম পুরুষে বর্ণিত গল্পের শেষে লেখক বলছেনÑ ‘বলতে বলতেই আমার ফলা ধরা হাতে সজোড়ে চাপ দিল একটা। চামড়া ভেদ করে ঢুকে গেল চার ইঞ্চি। কোন চিৎকার নেই। সুন্দরীর মুখে স্বর্গের হাসি। আমি হতবাক। সুন্দরীর দেহটা এলিয়ে পড়ছে আমার কোলে। আমি নির্বোধ সহকারীর মতো সাহায্য করে যাচ্ছি তার সার্কাসে।’ সার্কাস সুন্দরীর অন্য গল্পের মধ্যে অতিপ্রাকৃত গল্প ‘বাসর রাতের বেড়াল বৃত্তান্ত’, আঞ্চলিক গল্প ‘হাক্কা’, ‘অন্তহীন’, বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত ‘দ্বিখ-িত কণ্ঠনালী’, ‘মিথিলা এখনও কানামাছি খেলে’, কল্পকাহিনী ‘মাউছ্যা ভূত’ ও ‘কাশফুল’ ভিন্ন স্বাদ দেয়ার চেষ্টা করেছে। বিষয় নির্বাচনে নতুনত্ব আনার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। কিছু মুদ্রণজনিত ত্রুটি ছাড়া শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন বা উপমা প্রয়োগে বড় ধরনের কোন ঘাটতি চোখে পড়ে না। ‘সার্কাস সুন্দরী’ সালাহ উদ্দিন মাহমুদের প্রথম গল্পের বই হলেও তার চিন্তা ও উপস্থাপন ভঙ্গির মধ্যে পরিপক্বতার ছাপ স্পষ্ট। গল্পের কাহিনী বিন্যাসের বাঁক-বদল পাঠককে চমকে দেবে। তবে গল্প নির্বাচনে দু’-একটি গল্প এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত না করলেও লেখক ভাল করতেন। ভাষার ক্ষেত্রে পাঠক হিসেবে একজন উদীয়মান কথাসাহিত্যিকের কাছে আরও প্রাঞ্জলতা প্রত্যাশা করি। তার নতুন গল্পে নতুন চিন্তা ও ভাষার কাব্যময়তা আমাদের মুগ্ধ করতে সমর্থ হবে। আমার বিশ্বাস- পরবর্তী বইয়ে আমরা তাকে আর নতুনভাবে আবিষ্কারের সুযোগ পাব। বই : সার্কাস সুন্দরী লেখক : সালাহ উদ্দিন মাহমুদ প্রকাশক : দোয়েল প্রকাশনী প্রকাশকাল : বইমেলা ২০১৭ প্রচ্ছদ : আল নোমানমূল্য : ২৫০ টাকা
×