ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাদুবাস্তবতার কথা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২০ অক্টোবর ২০১৭

জাদুবাস্তবতার কথা

‘জাদু’ এবং ‘বাস্তবতা’ দুটি আলাদা বিষয়। জাদুর সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। কিন্তু এ দুটি বিষয় এক হয়ে সাহিত্যে নতুন আবেদন সৃষ্টি করেছে। যার ইংরেজী নাম ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’। বাস্তবতার সঙ্গে জাদুর কিংবা জাদুর সঙ্গে বাস্তবতার সংমিশ্রণে বিশ্বাসযোগ্য ধারণা তৈরি না-ও হতে পারে। তবে তা পাঠকের বোধকে জাগ্রত করতে পারে। কেননা সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা এমন এক রীতি যা সবসময় দ্ব্যর্থক এবং বিভ্রান্তিকর। এই জাদুবাস্তবতা আসলে কী? এ সম্পর্কে ম্যাক্সিকান সাহিত্য সমালোচক লুই লীল বলেছেন, ‘আপনি যদি ব্যাখ্যা করতে পারেন এটি কি, তাহলে তা জাদুবাস্তবতাই নয়।’ অর্থাৎ জাদুবাস্তবতা এমন এক বিষয় যা ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতা এক উজ্জ্বল সত্য, অত্যাধিক জনপ্রিয় এবং প্রচুর আলোচিত উপাদান। তবে এ নিয়ে ভুল ব্যাখ্যাও অনেক। অনেকেই ভুল বিষয়কেও জাদুবাস্তবতা বলেন। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, লেখায় উপস্থাপিত ঘটনাটি ঘটবে জাদুর মতো, মুহূর্তের মধ্যে। কিন্তু যারা অনুভব করবেন; তারা এমন কিছু পাবেন, যা থেকে বোঝা যাবে তার মূলে একটি গভীর সত্য রয়েছে। যেখানে কোন প্রশ্নের অবকাশ নেই বরং এটি একটি চরম বাস্তবতা। জাদুবাস্তবতার উৎপত্তি কোথায়? একটু যদি খেয়াল করি মধ্যযুগে রচিত মঙ্গলকাব্যগুলোর দিকে। চ-ীমঙ্গলে উল্লিখিত ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ কি এর সন্ধান পাই? কেননা দেবী চ-ী একেক সময় একেক রূপ ধারণ করেছেন। হতে পারে জাদুবাস্তবতারই রূপান্তর। যদিও মঙ্গলকাব্যকে ধর্মীয় আখ্যান বা পৌরাণিক ঘটনা বলা হয়েছে। এছাড়া আরব্য রজনীর কাহিনীতেও কি জাদুবাস্তবতার সন্ধান মেলে? তারপরও আমাদের ঔপনিবেশিক চিন্তাতে সাহিত্যের যেকোন বিবর্তনে পারস্য বা ইউরোপীয় সাহিত্যের শরণাপন্ন হতে হয়। সাহিত্য সমালোচকরা বলেছেন, জাদুবাস্তবতা কথাটি প্রথম উল্লেখ করেন ফ্রানৎস রোহ। তিনি জার্মান চিত্রকলা বিষয়ক একজন সমালোচক। তিনি ১৯২৫ সালে ‘এক্সপ্রেসিওজমুস : মাগ্রিশের রেয়ালিজমুস : প্রোবলেমে ডের নয়েস্টেন অয়রোপেইশেন মালেরাই’ অর্থাৎ ‘এক্সপ্রেশনিজমের পর ম্যাজিক রিয়ালিজম : নবীন ইউরোপীয় চিত্রকলার সমস্যাবলী’ বইতে এ কথার প্রথম সূত্রপাত করেন। রোহ বলেছেন, ‘জাদুবাস্তবতা পরিমিত ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী। এটি আবেগহীন এবং ভাবালুতামুক্ত। তাই শিল্পী দৃষ্টি রাখবেন ছোটখাটো গুরুত্বহীন বিষয়ের প্রতি। যা অস্বস্তিকর হলেও নিঃসঙ্কোচে তুলে ধরবেন। এর কাঠামো স্থির, ঘনবদ্ধ, কাঁচে ঘেরা স্থানের মতো। এটি শ্বাসরুদ্ধকর। গতিময়তার পরিবর্তে স্থিতিশীলতাই কাম্য। এর চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি সম্পূর্ণ নতুন। আগের কোন ছবি বা হস্তশিল্পের ছাপ তাতে থাকবে না। এতে থাকবে বস্তুজগতের সঙ্গে এক নতুন আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। সে অনুযায়ী, জাদুবাস্তবতা হচ্ছে পোস্ট-এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সমার্থক। জাদুবাস্তবতার উদ্ভব যদি চিত্রকলার মাধ্যমে ঘটেও থাকে; তবে এর বিকাশ ঘটেছে সাহিত্যেই। কেননা চিত্রকলার ভাষা বা বার্তা সাধারণের বোধগম্য নাও হতে পারে। সাহিত্য অন্তত সাধারণের মনের চাহিদাকে উপলব্ধি করতে পারে কিংবা সাধারণও সাহিত্যের ভাবাবেগ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হতে পারেন। কেননা ম্যাগি এন বাউয়ার্সের মতে, ১৯৫৫ সালে এ্যাঞ্জেল ফোর্স ‘আমেরিকান স্প্যানিশ উপন্যাসে জাদুবাস্তবতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এর কথা সাহিত্যরীতি হিসেবে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেছিলেন। আর উইকির মতে, জাদুবাস্তবতা এমন এক ধরনের সাহিত্যরীতি যাতে জাদুর উপকরণ অপরাবাস্তব জগতের অপরিহার্য অংশ। যে রীতি চলচ্চিত্র এবং চিত্রকলায়ও ব্যবহৃত হয়। লেখক আলেহো কার্পেন্তিয়ার ‘এল রেইনো দে এস্তে মুন্দো’র ভূমিকায় বলেছেন, ‘জাদুবাস্তবতা পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি জিনিস গল্পে নিয়ে আসে।’ জাদুবাস্তবতার গডফাদার মার্কেজ বলেছেন, ‘আমরা যে বাস্তবকে দেখি, তার পেছনে যে ধারণাটা আছে সেটাই জাদুবাস্তবতা।’ সহজভাবে বলা যায়, বাস্তব পার্থিব কাঠামোর সঙ্গে ফ্যান্টাসির উপাদান মিলে তৈরি হয় জাদুবাস্তবতা। এটি এমন একটি জাদুময় অনুভূতি, যাতে মনে হবে যেকোন কিছুই ঘটা সম্ভব। তবে এ রীতিকে প্রায়ই মেলানো হয় পরাবাস্তব, অতিপ্রাকৃত, উদ্ভট, রূপকথা, আজগুবি ঘটনার সঙ্গে। কেননা শুধু জাদু সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গল্প বললেই সেটি জাদুবাস্তবতা নয়। লিন্ডসে মুরের মতে, জাদুবাস্তবতা স্বাভাবিক ও আধুনিক পৃথিবীর মানুষ আর সমাজের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনার প্রেক্ষাপটে স্থাপিত। তাই রূপকথা, লোকসাহিত্য, পুরান বা মিথ, ভৌতিক বা হরর গল্পও জাদুবাস্তবতা নয়। তবে বিশেষ কোন কিংবদন্তি জাদুবাস্তবতা বলে গণ্য হতে পারে। জাদুবাস্তবতা মহাকাশ কিংবা এলিয়েন কোন গ্রহকে ঘিরে লেখা হয় না। আলবার্তো রাইওর মতে, জাদুবাস্তবতায় জাদু শব্দের আরেকটি অর্থ ‘বিস্ময়কর’ যা বাস্তবতাকে বিশেষভাবে প্রতিপন্ন করে, বাস্তবতাকে বিকৃত বা প্রতিস্থাপন করে না। জাদুবাস্তব গল্পের কাহিনী যে কোন বাস্তব জায়গার পটভূমিতে গড়ে উঠতে পারে। জাদুবাস্তব গল্পের অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে অদ্ভুত বা চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য। সেটা সময়, স্থান বা চরিত্রের মধ্যে মিশে থাকতে পারে। জাদুবাস্তব কাহিনীর মূল বৈশিষ্ট্য হলো- এতে দৈনন্দিন ঘটনাবলী এমনভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে অসাধারণ সব ঘটনা ঘটতে থাকবে। গল্প বলার সময় হঠাৎ ‘সময়’ থমকে দাঁড়াবে, আবার চলতে আরম্ভ করবে। জাদুবাস্তবতায় গল্প বলার স্বরভঙ্গিটাই সব। এখানে কোন বিস্ময়সূচক যতিচিহ্ন ব্যবহার করা হয় না। বিষয়টি যখন বড়; তখন তা বলা হয় নিচুস্বরে। আর তুচ্ছ বিষয় হলে তার বর্ণনা হবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে।
×