ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে এগিয়ে এশিয়া

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২০ অক্টোবর ২০১৭

আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নে এগিয়ে এশিয়া

বহুতল গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণের শুরুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সাম্প্রতিককালে এ ধরনের ভবন নির্মাণের প্রবণতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এশীয় দেশগুলোতেও। এ ব্যাপারে পাল্লা দিয়ে উঠে আসতে চাইছে তারা বিশ্ব দরবারে। প্রায় এক শতাব্দী আগে নিউইয়র্ক আর শিকাগো দেখিয়েছে মূলত গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলো হয়ে উঠতে পারে অর্থনীতির একটি মৌলিক সমস্যার সমাধান। সমস্যাটি স্থান সঙ্কুলানের। একই সঙ্গে ও সময়ে একই স্থানে হাজারও মানুষের, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্থানের সমাধান দিয়েছে এই বহুতল অট্টালিকা। নগরায়ণের বিস্তার ও প্রযুক্তির বিশ্বে বিষয়টির গুরুত্ব বর্তমানে আগের যে কোন সময়ের চাইতে বেশি। স্বাভাবিকভাবে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এ ধরনের ভবন একটি শহরকে করে তোলে বাণিজ্যিক বাতিঘর। গত এপ্রিলে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বেজিংয়ের অনতিদূরে শিয়নগন নামে এক নতুন নগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানান। বলা হচ্ছে শিয়নগন হবে চীনের স্বপ্ননগরী, যা গড়ে তোলা হবে বর্তমানে শত বর্গমাইলব্যাপী কৃষি জমি ও শহরের ওপর। মিলিয়নের বেশি মানুষের সে আবাস একই সঙ্গে হয়ে উঠবে প্রযুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থান কেন্দ্র। অনেকটা শেনজেনের মতো। হয়ত এই নগরী আগামীতে দাবি করতে যাচ্ছে বিশ্বের সর্বোচ্চ দালানের গর্বিত মালিকানা। দ্য পিং নামে শেনজেন নগরীতে সদ্য নির্মিত বাণিজ্যিক ভবনটির তলার সংখ্যা ১১৫। সর্বোচ্চ দালানের তালিকায় বিশ্বে এর স্থান চতুর্থ। অপরদিকে ১২৮ তলা নিয়ে ২০১৫-তে নির্মিত সাংহাই টাওয়ার এই গ্রহের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অট্টালিকা। ১৯৯০ দশক থেকেই বিশ্বের সর্বোচ্চ দালানের মালিকানা প্রাচ্যের দখলে। বর্তমানে এই মুকুটের দাবিদার আরব আমিরাতের দুবাইয়ের ‘দ্য বুর্জ খলিফা’ (৮২৮ মিটার)। শীঘ্রই একে ছাড়িয়ে যাবে ১০০০ মিটার উচ্চতা নিয়ে নির্মীয়মাণ সৌদি আরবের ‘জেদ্দা টাওয়ার’। বিশ্বের সর্বোচ্চ দশটি ভবনের নয়টির মালিকানা এখন এশীয় দেশগুলোর। এর বাইরেও উল্লেখ্য যে, ১৫০ মিটার বা ততোধিক উচ্চতার দালানের মালিকানা অন্য সব মহাদেশের মিলিত সংখ্যার চেয়ে বেশি। আকাশছোঁয়া ভবনসমৃদ্ধ শহরগুলো যেন অন্যদের একটি বার্তা দিচ্ছে, তাহলো শহরটি বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত আর ভবিষ্যত নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। সুউচ্চ কাঠামো নিয়ে ভবনগুলো দৃষ্টি আকর্ষণ করছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের। বলাইবাহুল্য, চীনজুড়ে এখন পুঁজিপতিদের ভিড়। আরবেরাও নয় কেবল তেল উত্তোলনকারী। তারা এখন আন্তর্জাতিক পরিম-লে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে। বিষয়টি এমন নয় যে, শহরগুলো কেবল নিজেদের মধ্যে দানবাকৃতি দালান নির্মাণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই দালানগুলোও এখন হয়ে উঠছে সেই শহরের সমৃদ্ধির প্রতীক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘দ্য বুর্জ খলিফা বা সাংহাই টাওয়ার’ হয়ে উঠেছে নিজ নিজ শহরের প্রতীক। সেইসঙ্গে ঘোষণা করছে শহরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অধিবাসীদের জীবনমান। পাশাপাশি দেশগুলোর অবস্থানও বিবেচনা করা যায়। গত এক দশকে প্রায় প্রতিবছর ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনগুণ। এই উন্নয়নের অংশ হিসেবে বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং সেক্টর। গবেষণা বলছে আকাশছোঁয়া ইমারত আজ তাদের সময়ের দাবি। বলা হয় চীন মোকাবেলা করছে তার ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বসতি স্থানান্তরের। যেখানে ১৯৭৯তে চীনে নগরে বসবাসকারীদের সংখ্যা ছিল ১৯% আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭%-এ। এই স্থানান্তর কমার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থা বিবেচনায় বলা যায় ১৯৭৯-এর পর চীনে নগরবাসীর সংখ্যা বেড়েছে ৬০০ মিলিয়ন, যা উত্তর আমেরিকার বর্তমান জনসংখ্যার (৫৮০ মিলিয়ন) চেয়ে বেশি। অপরদিকে ১৯০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নগরায়ণ ছিল ৪০%, ১৯৭০-এ ৭৪%, যা বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২%-এ। এই দ্রুত প্রবৃদ্ধিকে সামনে রেখে সরকারের হাতে দুটি বিকল্প বিদ্যমান। প্রথমত নগরায়ণের চাহিদাকে সামনে রেখে গগনচুম্বী ইমারত নির্মাণকে উৎসাহিত করা। অপরটি হলো উচ্চতার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। চীনজুড়ে লক্ষণীয় যে, গগনচুম্বী দালানগুলোর সঙ্গে নগরীর জনসংখ্যা ও স্থানীয় অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আড়াল থেকে হলেও চীনে সরকার এই নির্মাণ কাজে রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করছে। সেখানে একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে ব্যক্তি উন্নতি নির্ভর করে সফলভাবে কর্মসম্পাদনের ওপর। গগনচুম্বী ইমারতগুলো সে উদ্দেশ্য পূরণে সক্ষম। সাম্প্রতিক এক জরিপ জানাচ্ছে তরুণ বিনিয়োগকারীরা বহুতল ইমারত নির্মাণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করে সরকার সমর্থনে এগিয়ে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুুউচ্চ দালান নির্মাণ বিষয়টি এখনও বিতর্কিত। তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। যদিও এখন সেখানে প্রতিটি পরিবারের জন্য একক গৃহ ধারণাটি বহুল জনপ্রিয়। অনেক শহরের উচ্চতার ব্যাপারে সীমা নির্ধারিত অথবা কেবল শহরের জনবহুল কেন্দ্রে সুউচ্চ দালান নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। ফলে আকাশছোঁয়া দালান নির্মাণে আসছে নতুন বিন্যাস। নগর গড়ে তোলার ধরন নিয়েও বিতর্ক চলমান। আকাশছোঁয়া ইমারতগুলোর ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এশিয়ার শহরগুলোর প্রেক্ষিতে বিচার করলে নাগরিকদের জীবনমান পাশ্চাত্য স্তরে উন্নয়নে এ ধরনের ইমারত নির্মাণ অব্যাহত থাকবে, যা কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেই ভূমিকা রাখবে না, তা নির্ধারণ করবে নগরীর স্কাইলাইন, যা হয়ে দাঁড়াবে নগরীর পরিচয়। প্রকাশ করবে তার চরিত্র। প্রযুক্তির অগ্রগামিতা সুউচ্চ দালান নির্মাণকে করেছে সহজতর। সেইসঙ্গে কমিয়ে এনেছে নির্মাণের সময়কাল। তাই বিশ্বের সর্বোচ্চ দালান নির্মাণের গৌরবের দাবিতে নগরগুলোর পারস্পরিক প্রতিযোগিতা থাকবে অব্যাহত। সেই ১৮৯০ থেকে বাড়ছে দালানের উচ্চতা। প্রতিবছর এই বৃদ্ধির হার ১৭ ফুট। পরিসংখ্যান বলছে, এ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২২শ’ শতকের মাঝামাঝি দেখা যাবে এক মাইল বা ততোধিক উচ্চতার দালান। কিন্তু পরিসংখ্যান তো কেবল একটি গাণিতিক ধারণা, যা মানুষের ইচ্ছেশক্তির কাছে ভুল প্রমাণিত হয়েছে বারবার। তাই ২২৫০-এ নয়, এক মাইল উচ্চতার স্বপ্ন টোকিও ছুঁতে চাইছে ২০৪৫-এ। আর তা সম্ভব হলে আকাশছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় অনেকদূর এগিয়ে যাবে এশিয়া। লেখক : সাংবাদিক
×