ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হায়াতুদ্ দুনিয়া বা পার্থিব জীবন

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ২০ অক্টোবর ২০১৭

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হায়াতুদ্ দুনিয়া বা পার্থিব জীবন

(গত সপ্তাহের পর) এই আয়াতে কারিমায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, পার্থিব জীবন একেবারেই ক্ষণস্থায়ী এবং পৃথিবীতে উপভোগ্য বস্তুনিচয় ও জাগতিক শোভা-সৌকর্য ক্ষণস্থায়ীই কেবল নয়, তা নিকৃষ্ট ও অতিতুচ্ছ অথচ আখিরাতে যে নিয়ামতরাজি রয়েছে তা চিরসুন্দর, চিরস্থায়ী এবং অত্যন্ত উৎকৃষ্ট। আল্লাহ্ বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করে বনী আদম বা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, পৃথিবীর ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা দিয়েছেন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য হালাল ও পবিত্র বস্তু সামগ্রী দিয়েছেন। তিনিই হালাল কোনটা এবং কোনটা হারাম তা বিস্তারিতভাবে বলে দিয়েছেন। তিনি মানুষকে সৎপথে চলার দিশা দেয়ার জন্য যুগে যুগে নবী-রসূল পাঠিয়েছেন যাতে মানুষ হিদায়াত লাভ করতে পারে, পার্থিব জীবনকে আখিরাতের জীবনের জন্য প্রস্তুত করতে পারে এবং আখিরাতের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য যথাযথ পাথেয় সংগ্রহ করতে পারে। পার্থিব জীবনটা হচ্ছে কর্মের জন্য, ‘আমল করার জন্য। সেই কর্মগুলো হতে হবে সৎকর্মÑ‘আমালুস সলেহ। পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী হচ্ছেন সরকারের দো’আলম সাইয়েদুল মুরসালিন নূরে মুজাসসম খাতামুন্নাবিয়ীন হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহমদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম। তিনি বলেছেন : লায়সাল গিনা ‘আন কাছরাতিল ‘আরাদি ওয়ালা কিন্নাল গিনা সিনান্নাফ্স- প্রচুর ধন-সম্পদ থাকলেই অভাবমুক্ত হওয়া যায় না। অন্তরের অভাব মুক্তিই প্রকৃত ধন-সম্পদ। (মুসলিম শরীফ)। ঐশ্বর্যের এই ধারণা ধারণ করে চলতে পারলে পার্থিব জীবনটা ভালয় ভালয় অতিবাহিত হতে পারে। অল্পে তুষ্টির মধ্যেই প্রকৃত সুখ নিহিত রয়েছে। সৎকর্ম পার্থিব জীবনে যেমন কল্যাণ বয়ে আনে, আখিরাতের জীবনেও অধিকতর কল্যাণ বয়ে আনে। পার্থিব জীবন তো ক্ষণিকের। অথচ আমরা এই ক্ষণিক জীবন নিয়ে এমন ব্যতিব্যস্ত থাকি যে, মনে হয় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে না, মনে হয় যেন আখিরাতের স্থায়ী জীবনে যেতে হবে না। কোন্ এক মায়ার কুয়াশার ধূম্রজালে আটকা পড়ে আমরা পৃথিবীটাকে আঁকড়ে ধরতে চাই। প্রতিদিন কত মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে- সে সব দেখেও আমাদের টনক নড়ে না। এই জীবনের পরেও যে আরেক জীবন আছে, সেই জীবনের সুখ-দুঃখ নির্ভর করছে এই জীবনের কর্মের ওপর সেটা যেন আমরা বেমালুম ভুলে আছি। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মৃত্তিকা থেকে, তারপর শত্রু থেকে, তারপর রক্তপি- (‘আলাক) থেকে, তারপর তোমাদের বের করেন শিশুরূপে। অতঃপর যেন তোমরা উপনীত হও তোমাদের যৌবনে, তারপর হয়ে যাও বৃদ্ধ। আর তোমাদের মধ্যে কারও মৃত্যু ঘটে এবং কারও মৃত্যু ঘটে বৃদ্ধ হওয়ার পূর্বেই নির্দিষ্টকাল প্রাপ্ত হয়ে। (সূরা মু’মিন : আয়াত ৬৭)। পার্থিব জীবনের এই যে বাস্তবতা, এটা ভুললে চলবে না। আমরা এ কথাটি নানাভাবে শুনি যে, কোথায় ছিলাম, কোথায় এলাম, আবার কোথায় যাব। ভাবে বিভোর না হয়ে আমাদের বাস্তবতার চৌহদ্দীতে বিচরণ করে সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে, জীবনটাকে বুঝতে হবে। অনেক সময় আমরা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে বিস্মৃতির উত্তাল তরঙ্গে যেন হাবুডুবু খাই, আমাদের বিশ্বাসের সূক্ষ্ম তন্ত্রীগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এমনটাও হয়ত কারও কারও হয় যারা বুঝেও বুঝতে চায় না, শুনেও শুনতে চায় না, তাদের বোধশক্তি যেন লোপ পেয়ে যায়। আবার এমন লোকও আছে যারা বিবাগী হয়ে, পার্থিব জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উদাসীনতার খপ্পরে পড়ে। এই জীবনকেই চূড়ান্ত জীবন মনে করে যারা অর্থ-জৌলুস, ভোগ-বিলাসের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের আয়ু খতম করে দেয় কিংবা অবিশ্বাসের নিকষ কালো অন্ধকারে হাবুডুবু খায় তারা কি একটুও ভাবতে পারে না যে, মৃত্যু তো পেছনে লেগেই আছে। আল্লাহর নির্দেশ পেলেই মৃত্যু সাধের প্রাণটাকে কবজ করে নেবে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : আয়না মা তাকুনু ইউদরিক কুমুল মাউতু ওয়া লাও কুনতুম ফী বুরুজিম মুশায়ইয়াদা- তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, এমনকি সুউচ্চ সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও। (সূরা নিসা : আয়াত ৭৮)। অন্যদিকে যারা পার্থিব জীবনের সবকিছু ছেড়েছুড়ে বিবাগী হয়ে যায় তাদেরও বোঝা উচিত পৃথিবীতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ্আমাদের কি জন্য পাঠিয়েছেন। পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্যটাই বা কি। আল্লাহ, জাল্লা শানুহু তো মানুষকে পাঠিয়েছেন খলিফা করে। তিনি পার্থিব জীবনের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান দিয়েছেন, ইবাদত-বন্দেগী করতে বলেছেন, সৎকর্ম করতে বলেছেন, মানব কল্যাণের দিশা দিয়েছেন : সালাতের ওয়াক্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সিয়ামের জন্য মাস নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যাকাতের বিধান দিয়েছেন, সকাল-সন্ধ্যায় খাসভাবে তার তস্বিহ-তাহলীল করতে বলেছেন, বেশি বেশি করে তাঁর যিকর করতে বলেছেন, হজের বিধান দিয়েছেন, হুুকুল্লাহর পাশাপাশি হুক্কুল ইবাদও আদায় করতে বলেছেন, নবীর প্রতি যথাযথ তাজীমের সঙ্গে সালাত ও সালাম পেশ করতে বলেছেন, সুন্নতে নববীর পায়রাবি করতে নির্দেশ দিয়েছেন, স্বামী-স্ত্রীর হক আদায় করতে বলেছেন, নারীদের মর্যাদা দান করেছেন, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং মানুষের হক আদায় করতে বলেছেন, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে বলেছেন। তিনিই তো এই মুনাজাত করতে বলেছেন : রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনয়্যা হাসানাতাও ওয়াফিল আখিরাতে হাসানা- হে আমাদের রব্! আপনি আমাদের পার্থিব কল্যাণ দিন ও আখিরাতের কল্যাণ দিন। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (স.)
×