ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. আর এম দেবনাথ

কিশোরগঞ্জসহ দেশের সবচেয়ে গরিব ৫ জেলার প্রতি নজর দিন

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ২০ অক্টোবর ২০১৭

কিশোরগঞ্জসহ দেশের সবচেয়ে গরিব ৫ জেলার প্রতি নজর দিন

এই সপ্তাহে লেখার বিষয় অনেক। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬।’ এই বিষয়ে যাওয়ার পূর্বে একটা তথ্য অবশ্যই পাঠকদের জানিয়ে রাখতে হয়, আর তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির তথ্য। মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের নিচে ছিল অনেকদিন। কিন্তু তা আবার বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে এর হার ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। চৌদ্দ মাস পর তা ৬ দশমিক ১২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে গত মাস অর্থাৎ সেপ্টেম্বর। বলাইবাহুল্য, বন্যাজনিত কারণ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এতেই মূলত মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি। তবে কারণ যাই হোক মূল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করে। এর জন্যই এটা বাড়লে উদ্বেগ বাড়ে। উদ্বেগ বাড়ে আরও, কারণ মূল্যস্ফীতি বাড়লে সরকারের মূল প্রচেষ্টা ‘দারিদ্র্য হ্রাস’-এর অগ্রগতি ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। অথচ এই ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য প্রশংসাযোগ্য। এই সাফল্যের খবর আমরা সর্বশেষ ‘খানা জরিপ-২০১৬’ থেকেও পাই। খানা জরিপটি হয় দেশবাসীর আয়-ব্যয়ের ওপর। প্রতি ৫ বছর অন্তর অন্তর করা এই জরিপ থেকে আমরা বহুবিধ খবর পাই। দারিদ্র্য, বৈষম্য, আয়-ব্যয়, ভোগ, বিদ্যুত প্রাপ্যতা, সাক্ষরতার হার, বাড়ি-ঘর, খাদ্যাভ্যাস, পানীয়জলের প্রাপ্যতা, প্রোটিনপ্রাপ্তি ইত্যাদি নানা বিষয়ে আমরা খানা জরিপের মাধ্যমে অবহিত হই। এর থেকে বোঝা যায় কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আমাদের শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বশেষ খানা জরিপটিকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর যেমন সবল দিক রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক অস্বস্তির দিক, দুশ্চিন্তার দিক। ভাল দিকের মধ্যে প্রথমেই চোখে পড়ে দারিদ্র্য হ্রাসের খবরটি। ‘সার্বিক দারিদ্র্য’ এবং ‘অতি দারিদ্র্য’ দুটোই হ্রাস পেয়েছে বিগত পাঁচ বছরে। প্রায় ৭ শতাংশ কমে সার্বিক দারিদ্র্যের হার এখন দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। শতাংশ দিয়ে অনেক সময় বোঝা যায় না। অতএব, সংখ্যা দিয়ে বলি। বর্তমানে আমাদের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে তিন কোটি ৯৩ লাষ মানুষ। এভাবে হিসাব করলে বিষয়টি সুখকর হয় না। দেখা যাচ্ছে অতি দরিদ্র লোকের সংখ্যাই হচ্ছে এখন ২ কোটি ৮০ লাখ। শতাংশের হিসেবে তা ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এই হিসাবটিও সুখকর নয়। শত হোক স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও প্রায় তিন কোটি লোক দুইবেলা ভাত খেতে পায় না। কী করে এই খবর স্বস্তিদায়ক নয়। নিশ্চিতভাবে বলা যায় এটা সরকারেরও অনুভূতি। যদিও এই দারিদ্র্য হার সারা বিশ্বের গড় দারিদ্র্যের নিচে। এরপরও বলা চলে এটা আত্মতুষ্টির কোন বিষয় নয়। দ্বিতীয় ভাল খবর হচ্ছে মানুষ এখন ভাত কম খাচ্ছে। এর পরিবর্তে শাক-সবজি, মাছ-মাংস, ডিম খাচ্ছে বেশি। আমি আর তথ্য দিচ্ছি না। শর্করা জাতীয় জিনিসের ওপর নির্ভরতা কমলে এবং পুষ্টিজাতীয় দ্রব্যাদির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়লে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অবশ্যই সুখবর। কিন্তু এই খবরের সঙ্গে যদি ধান-চালের প্রাপ্যতার হিসাবটা মিলাই তাহলে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। বিগত ৪৫ বছরে খাদ্যশস্য উৎপাদন দেশে বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিনগুণ। অনেক লোক এখন কম ভাত খায়। তার ওপর আবার প্রায় তিন কোটি লোক দুই বেলা ভাত পায় না। তাহলে প্রশ্নÑ এত চাল যায় কোথায়? অথবা সময় সময় চালের সঙ্কট হয় কেন? গমের চাহিদা বাড়ছে কেন? তার মানে কী এই যে, ভাতের পরিমাণ কমছে, কিন্তু আটা খাওয়া বাড়ছে। ভাত ও আটার মধ্যে পার্থক্য কী? এসব নিয়ে ভাবতে হবে। আরেকটি ভাল খবর হচ্ছে ভোগ ব্যয় বিগত পাঁচ বছরে বেশ কিছুটা বেড়েছে। এটা পরিষ্কার হয় যখন দেখা যায় ইটের বাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। টিন ও কাঠের বাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যুত সংযোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্যানিটারি পায়খানা ব্যবহার, বিশুদ্ধ খাবার জলের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির লক্ষণ। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন আজকাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় সূচক। শুধু জিডিপির হার বৃদ্ধিকেই এখন আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলা হয় না। এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকে সামাজিক সূচকও আছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিগত ৫ বছরে সরকারের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাফল্য উল্লেখ করার মতো। এর সঙ্গে গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আরও সূচকের হিসাব ধরলে আমাদের উন্নয়নকে সার্বিক উন্নয়ন বলতে বাধা নেই। এত ভাল খবরের মধ্যে জরিপে কিছু অস্বস্তির খবরও আছে। অবশ্য অস্বস্তির খবরগুলো জানা এবং বহুল আলোচিত। যেমন আয়বৈষম্য। আয়বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। এটি বহুল চর্চিত বিষয় এবং সরকার এবং বেসরকারী লোকজনÑ সবার জন্যই তা উদ্বেগের বিষয়। কারণ আয়বৈষম্য একপর্যায়ে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। দেখা যাচ্ছে মোট জাতীয় আয়ে ২০১০ সালে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ লোকের ভাগ বা অংশীদারিত্ব ছিল শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা হ্রাস পেয়ে হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ। বিপরীতে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ লোকের জাতীয় আয়ে অংশীদারিত্ব বিগত ৫ বছরে ২৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৮ শতাংশ। এই তথ্যের সঙ্গে ব্যাংক আমানত ও ব্যাংকঋণের ভিন্ন একটা সূত্রের তথ্যের সামঞ্জস্য রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, আমানতে ধনীদের অংশীদারিত্ব দিন দিন বাড়ছে। মোট আমানতে গরিবদের অবদান হ্রাস পাচ্ছে। বিপরীতে ঋণের ক্ষেত্রে তাই। এখানেও ধনীদের আধিপত্য দিন দিন বাড়ছে। এদিকে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যও দিন দিন বাড়ছে। এ কথা আমরা সাধারণ আলোচনায় বলে থাকি। এখন তথ্যেও পাওয়া যাচ্ছে তা যা অবশ্যই অস্বস্তিকর খবর। বৈষম্য মাপার জন্য ‘গিনি সূচক’ নামীয় একটা সূচক ব্যবহার করা হয়। দেখা যাচ্ছে ২০১৬ সালের ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ’ মোতাবেক বৈষম্যের সূচক ২০১৬ সালে শূন্য দশমিক ৪৮৩ এ উন্নীত হয়েছে। ২০১০ সালে তা ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৪৫৮। সূচক যত বেশি হবে তত খারাপ হচ্ছে বৈষম্য পরিস্থিতি। এই তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে এবং তা উন্নয়নের পাশাপাশি। এর অর্থ ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব। এই লক্ষণ সর্বত্র। তবে বলতেই হয় এই সমস্যা সমাধানের কথা বলেই কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নও ছিল বৈষম্যহ্রাস। তিনি সারা জীবন অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন। বর্তমান কাঠামোতে এটা অসম্ভব মনে করে তিনি পুরো কাঠামো ভাঙতে উদ্যোগী হয়েছিলেন এ কথা সবারই জানা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা ওই ফাঁদেই পড়েছি। পরিবারের আয়-ব্যয়ের হিসাবে গেলে পরিষ্কার দেখা যায় মানুষের আয়, মাসিক আয় বাড়ছে। ২০১০ সালে মাসিক আয় ছিল ১১ হাজার ৪৭৯ টাকা। তা এখন ১৫ হাজার ৯৪৫ টাকা। এই সংবাদ খুবই ভাল সংবাদ। কিন্তু অসুবিধার খবর হচ্ছে, মানুষের খরচ বা ব্যয় বেড়েছে বেশি হারে। যদি তা না হতো তাহলে সঞ্চয় বাড়ত এই সঞ্চয় আমাদের বহুদিন যাবত প্রায় স্থবির। অথচ আমাদের সঞ্চয় বেশি বেশি দরকার। রাষ্ট্রের দরকার বিনিয়োগের জন্য, আর মানুষের দরকার বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। আমাদের সরকার শুধু ট্যাক্স আদায় করে। বিপদে-আপদে কোন সাহায্য করে না। অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিজের টাকায় করাতে হয়। চাকরি গেলে রাস্তায় বসতে হয়। বেকার ভাইবোন পালতে হয়। এমনকী দরিদ্র গ্রামবাসীকেও সাহায্য করতে হয়। এসবের জন্য টাকা লাগে। সুতরাং বলছিলাম ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি বাড়লে দেশবাসী উপকৃত হতো। কিন্তু তা হচ্ছে না। এর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। এদিকে আরেকটা অস্বস্তির খবর প্রতিবেশী জেলার। প্রতিবেশী জেলা বলতে আমি ঢাকার কাছের জেলা কিশোরগঞ্জের কথা বলছি। এই জেলা আমার বলে ভীষণ দুঃখ পেয়েছি খানা জরিপ পাঠ করে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির জেলাও এটা। অনেক প্রভাবশালী নেতাও এই জেলার। এই জেলায় যেতে মাত্র ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। কোন নদী পড়ে না। সেতু পার হতে হয় না। ঢাকার লাগুয়া জেলা। যে ঢাকায় এত মধু সেই ‘মধুময়’ ঢাকার পাশে থেকে এই জেলা দারিদ্র্যের তালিকায় সবচেয়ে নিচে। বাংলাদেশে যে পাঁচটি জেলা সবচেয়ে দরিদ্র তার মধ্যে কিশোরগঞ্জ একটি। ওই সীমান্ত জেলা কুড়িগ্রামের সঙ্গে তার স্থান। কিশোরগঞ্জে দরিদ্র্যের সংখ্যা ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এই তথ্যের মর্মার্থ কী? এটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের আরেক ধাঁধা। সবচেয়ে উন্নত শহর, রাজধানী শহর ঢাকার লাগুয়া হয়েও একটি অঞ্চলের এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা। এর কারণ খুঁজে বের করা দরকার। যে পাঁচটি জেলার অবস্থা খুবই খারাপ তাদের ওপরও স্টাডি হওয়া দরকার। শত হোক এদের অবস্থা জাতীয় পরিস্থিতির তুলনায় অনেক খারাপ। কিশোরগঞ্জের লোক হিসেবে আমার মন বেশ খারাপ, আরও খারাপ এ কারণে যে, মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়িও সেই এলাকায়। কিশোরগঞ্জসহ সবচেয়ে হতভাগ্য পাঁচটি জেলার দায়িত্ব কে নেবে? বস্তুত পাঁচটি জেলা নয় অনেক অঞ্চল জাতীয় ‘গড়ের’ নিচে। এর অর্থ ‘সার্বিক দারিদ্র্য’ ২৪ শতাংশ হলেও কোথাও তা অনেক বেশি কোথাও কম। এটা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকা-ের আরেকটা দুর্বলতা। কোথাও ৫০-৬০ শতাংশ কোথাও ৫-১০ শতাংশ। এটা কিন্তু কাম্য নয়। কারণ এতে গড়ের হিসাব ভাল দেখায়, কিন্তু তা অঞ্চল ভেদে মারাত্মক। এই ব্যবধান দূর করা দরকার। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর জেলাকেই জাতীয় গড়ের কাছাকাছি আনতে উদ্যোগ নিতে পারেন। তেমনি যার যার অঞ্চলকে উন্নত করতে উদ্যোগ নিতে পারেন আঞ্চলিক নেতারা। এতে সরকারী কাজ সহজতর হয়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×