ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

বিনোদনের অষ্টপ্রহর

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১৯ অক্টোবর ২০১৭

বিনোদনের অষ্টপ্রহর

কোন রকম নেতিবাচক মন্তব্য নয়, অনেক শুভ সংবাদের লেখা এটি। নেতিবাচক খবর শুনতে বা লিখতে লিখতে সুবচনকে আমরা একরকম নির্বাসনে পাঠিয়েছি। প্রশংসা থেকে সমালোচনা আমাদের বরই প্রিয়! সুভাষণে আমরা অভ্যস্থ নই। সবক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক আলোচনা আমাদের চাই-ই! তবে হ্যাঁ, নেতিবাচক আমরা লিখি বা লিখব, সেটা পরম সত্যের খাতিরে। কিন্তু, যেখানে মিষ্ট বলার বা লেখার সুযোগ সেখানে আমরা অবশ্যই উদারতা দেখাব। এমন চিন্তা বোধ করি সকলের জন্য শুভ। আমরা এখন ২০১৭ সালের দশ নম্বর মাসের শেষের দিকে। আর একটা মাস পার হলেই শুরু হবে নানা বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ। এরমধ্যে পাওয়া না পাওয়ার বিনোদন তো আছেই। বছরজুড়ে বিনোদনের অষ্টপ্রহর খুব একটা ভাল না কাটলেও শেষ প্রহরে বিনোদনের মধুর বাঁশি আমাদের সবার হৃদয়ে সুখের দোলা দিয়েছে! শেষ বেলার অরুণ আলোর আভায় বেশ ভালই আমরা মোজেছি। আমরা ভয় পেয়েছি, আতঙ্কে কেঁপেছি আবার বুকভরা আবেগে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেছি। বিদ্যুতের ঝলকানির মতো আবার চমকেও গিয়েছি। সম্প্রতি এমন সব অনুভূতি আমাদের সিনেমা, টিভি নাটক, মঞ্চনাটক ও সঙ্গীত থেকে পেয়েছি! আমাদের দর্শক বিনোদনের তারণায় এক রকম অন্যের ঘরে প্রায় ঢুকেই পড়েছিল! সেখান থেকে বলা যায় আমাদের দর্শক এখন নিজ ঘরে আমুদে সময় পার করছে! শিকড় বলে কথা! এই পরম সত্য অপাতত বর্তমান। আসলে আমাদের মধ্যে যারা বিনোদন প্রমোট করেন, তাদের ডেডিকেশন বা উৎসর্জনের উপর নির্ভর করে দর্শক কতদিন আমাদের আপন হয়ে থাকবে। সকলেই চায় আপনজনদের কাছাকাছি থাকতে! এক প্রাজ্ঞ গুণীজন বলেছিলেন শিল্প-সাহিত্য বা সৃজনকর্ম হতে হবে, হয় সাময়িক না হয় ঐতিহাসিক। অর্থাৎ বর্তমান এবং অতীতের মধ্যেই আমরা। আর এর বাইরে হলো অবাস্তবতা। গত কোরবানির ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর চিত্র ছিল একরকম নীল বর্ণের শূন্যতার আবেশে ঘেরা। এমন বস্তবতায় আনন্দকণ্ঠের এক লেখার শিরোনাম হয়েছিল ‘ঢাকাই সিনেমার দর্শক হাইজ্যাক’ ঈদের সিনেমা থেকে দর্শক বিনোদনের লেশমাত্রটি পায়নি। কিন্তু, একাধিক নাটক ও টেলিফিল্ম ছিল দর্শকদের অন্তরমহলে রাজকীয় অনুভূতিতে। এরমধ্যে ‘বড় ছেলে’ ‘হোটেল আলবাট্রোস’ ছিল দর্শকদের চিত্তাকর্ষের প্রধান আকর্ষণ। ‘বড় ছেলে’ ছিল সম্প্রতি সর্বাধিক জননন্দিত বড় নাটক। এই টেলিফিল্ম এবং দর্শকদের অনুভূতি একটু আলাদা করে না বললেই নয়। বড় ছেলে মাত্র এক ঘণ্টার একটি টেলিফিল্ম সারা বাংলার অগণিত দর্শকদের প্রায় এক করে ফেলল। টেলিফিল্ম দেখে সকলের অভিন্ন মন্তব্য, ‘বড় ছেলে দেখার সময় তুমি কি কেঁদেছিলে? অনেকের উত্তর; হ্যাঁ। কেঁদেছি বুক ভাসিয়ে কেঁদেছি। আসলে যারা এই নাটক দেখেছেন তাদের বেশিরভাগই গল্পের তারণায় আবেগে কেঁদে ফেলেছেন। জাতি হিসেবে আমরা ভীষণ আবেগী এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। নাট্যকার ও পরিচালক মিজানুর রহমান আরিয়ান আমাদের সেই আবেগটা বেশ ভালভাবেই ধরতে পেরেছিল। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত জনগেষ্ঠীর বুকফাঁটা হাহাকার বেশি কাজে দিয়েছে। টেলিফিল্ম বড় ছেলে ভীষণভাবে প্রশংসিত। ‘চ্যানেল আইয়ের ঈদ অনুষ্ঠানে প্রাচার হলেও মূলত এই নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায়। টেলিভিশন অনএয়ারে কত দর্শক এই নাটক দেখেছেন, তার হিসাব কারও কাছে নেই। তবে, ইউটিউবে এ পর্যন্ত কতসংখ্যক বা কতবার দেখা হয়েছে এই নাটক তার সংখ্যা কিন্তু স্পষ্ট। এক কোটি ছাড়িয়েছে সপ্তাহ দেড়েক আগেই। এখন চলছে এক কোটি প্লাস। জিয়াউল ফারুক অপূর্ব এবং মেহেজাবিন চৌধুরীর অভিনিত এই নাটক প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ দেখেই চলেছে। হোটেল আলবাট্রোস নুহাশ হুমায়ূন। যার একাধিক শক্তিশালী পরিচয় বর্তমান। তা সত্ত্বেও নিজের যোগ্যতায় নিজের নামকে করেছেন যথেষ্ট উজ্জ্বল। নুহাশ প্রমাণ করেছেন, নাট্যচিন্তায় আধুনিকতা কাকে বলে। ‘হোটেল আলবাট্রোস’ বিদ্যুতের ঝলকানির মতো দর্শকদের হৃদয় ঝলসে দিয়েছে। মাত্র চৌত্রিশ মিনিটের এই নাটক দর্শকদের তছনছ করেছে। কেউ কেউ এটাকে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র বলেছেন। গল্পের রোমাঞ্চকতা, আধুনিক নির্মাণশৈলী এবং অভিনয় শিল্পীদের দুর্দান্ত অভিনয় হোটেল আলবাট্রোসকে অগণিত দর্শকদের দারুণভাবে ঝাঁকি দিয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ তার এমন বিচক্ষণতার জন্য তার পিতাকে ক্রেডিট দিয়েছে। এটা অবেগীয় উক্তি। বাস্তবতা বর্তমান নুহাশ তার চিন্তায় অতীব সৃজনশীল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিত তত্ত্বের মতো নুহশের ৩৪ মিনেটের নাটক কেউ কেউ চার মিনিটে শেষ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক প্রাজ্ঞজন তার নাটক দেখে ধন্য করেছেন। সবমিলিয়ে হোটেল আলবাট্রোস দর্শকদের এক কথায় মুগ্ধ করেছে। রিজওয়ান কেউ কি কখনও দেখেছে বা শুনেছে, ঈদের ছুটিতে শিল্পকলার অনেক স্টাফের ছুটি রহিত করে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য হল খুলে রেখে নাটক প্রদর্শন করতে। প্রথমত এটা বিরল দ্বিতীয়ত এটা চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এটা মঞ্চনাটক। আমাদের দেশের দর্শক বরাবরই মঞ্চ থেকে পর্দায় বেশি অভস্থ। এসব কারণে ঈদের ছুটিতে ‘রিজওয়ান’ ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। আসলে এসব কথার কথা কাজের কথা হলো যিনি রিজওয়ান মঞ্চায়িত করবেন তাঁর কাছে এসব কিছুই না। সে দৃঢ়ভাবে জানতেন, হলে শো হলে দর্শক আসবে। আসতেই হবে। যদিও তাঁর এমন চিন্তার কথা কাউকে না বলে তিনি কাজে প্রমাণ করেছেন। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল হলে প্রদর্শিত হয় রিজওয়ানের প্রিমিয়ার শো। কোন সৌজন্যতা ছিল না ‘পার পারসন’ টিকেট মূল্য ১ হাজার টাকা। টিকেট মূল্য একটু না হয় অস্বাভাবিক লাগছে! কিন্তু, যারা সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনার এই নাটক দেখেছেন তারা নির্দ্বিধায় বুঝেছেন শিল্পকর্ম কি, সৃজনশীলতা কাকে বলে। কেউ কেউ এই নাটক দেখে বলেছেন জাদু দেখলাম! লাল নীল আলো আঁধারির জাদু! অভিনয়ের জাদু! সঙ্গে হিমশীতল অনুভূতি! চাপা উত্তেজনায় নীল রক্ত বেরিয়ে আসার উপক্রম রিজওয়ানের আর্তনাদে। দর্শক বুঝে না বুঝে দুটোতেই বিমোহিত। সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় উর্দু কবি আগা শাহী আলির ‘এ কান্ট্রি উইদাউট এ পোস্ট অফিস’এর নাট্যরূপে। নাটবাঙলা থিয়েটার টানা দশ দিন এই নাটক মঞ্চায়িত করেছে। কোন কোন দিন শো-এর সব টিকেট একদিন আগেই বিক্রি হয়েছে। সবগুলো শো-ই ছিল হাউসফুল। বোদ্ধা, সমালোচক কিংবা সাধারণ দর্শক সকলেই থ বনে গিয়েছেন নাট্যপুরোধা সৈয়দ জামিল আহমেদের জাদুবাস্তবতার শৈল্পিক খেলায়। ঢাকা এ্যাটাক দেশের সিনেমা হলগুলো যখন দিনের পর দিন দর্শক খরায় ভুগছে। তখন, দিপংকর দীপনের থ্রিল গল্পের ‘ঢাকা অ্যাটাক’ একরকম হুলস্থূল কা- ঘটিয়ে বসল। এই সিনেমা নিয়ে যদি এখন লিখতে হয় তাহলে দর্শকদের অভিমত অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। লিয়াকত মোল্লা পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ি ঢাকার মতিঝিলে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় কেমন দেখলেন ‘ঢাকা অ্যাটাক’। উত্তরে লিয়াকত বলেন, কেমন দেখছি এইটা পরে বলি, ঢাকা অ্যাটাক দেখতে গিয়ে যে প্যারাটা পাইছি সেইটা আগে বলি। প্রথমে ৬ তারিখ শুক্রবার গেলাম বলকা হলে বিকেল ৩টার শো দেখতে। হলের সামনে নেমে দেখি কেবল মানুষ আর মানুষ। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় গেট থেকে ঢুকে সোজা কাউন্টারে গিয়ে বললাম একটা ৬টার শোর টিকেট দেন। উত্তর, টিকেট নেই শেষ। ব্লাকেও পেলাম না। ফেরত আসলাম। নতুন করে বলাকা হলের ডেকোরেশন সুন্দর করায়, সিনেমা এখন বলাকাতেই দেখি। সাউন্ডও ভাল। তাই ঠিক করলাম কাল আবার আসব। কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে পারলাম মর্নিং শো সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হবে। ভিড় কম থাকায় পরদিন দোকানে ছোট ভাইকে বসিয়ে চলে এলাম নিউমার্কেট। তখন ৯টা পঁয়তাল্লিশ বাজে। কাউন্টারে একটা দুইশ’ টাকার টিকেট চাইলাম। উত্তর আবারও নেই, শেষ। ভীষণভাবে হতাশ হলাম। একজনকে অনুরোধ করলাম একটা টিকেটের ব্যবস্থা করতে, দাঁড়ান দেখি কি করতে পাড়ি। মিনিট দশেক পর এই নেন তিনশ’ পঞ্চাশ টাকা দেন। সময়ের মূল্য বুঝে আমি নিয়ে নিলাম। সিনেমা শুরুর দশ মিনিট আগে ভেতরে ঢুকলাম। বিজ্ঞাপন শেষে সিনেমা শুরু হলো। শো শেষে যখন বের হলাম তখন বিশ্বাস করেন দুই দিনের কষ্ট একটুও গায় লাগল না। মনটা ভরে গেল এমন জব্বর সিনেমা দেখে। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা স্পিড পাইছি। এই তো বেশ লেগেছে। লিয়াকত মোল্লা সেই নব্বইর দশক থেকে নিয়মিত সিনেমা দেখেন। তবে ইদানীং কয়েক বছর আর নিয়মিত হলে যান না। সময়ে সময়ে খোঁজখবর রেখে তারপর যান। যেখানে গত কোরবানির ঈদে হলগুলো ছিল একরকম দর্শকশূন্য সেখানে এমন দর্শক প্রতিক্রিয়া সিনেমা সম্পর্কে আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকা অ্যাটাক দর্শকদের দীর্ঘ দিনের আক্ষেপ পূরণ করেছে। জেফারের ‘আনকোড’ প্রচ- আত্মবিশ্বাসী শিল্পী জেফার রহমান। গত ২৫ অক্টোবর মুক্তি পায় তার ‘আনকোড’। এ্যালবামের ৯টি গানের ৭টি ইংরেজী ভাষায়। এর মধ্যে বাংলা গান ‘কে কবে হেরেছে’ গানটি তার বাস্তবজীবনের বিতৃষ্ণার বহির্প্রকাশ। জেফার সঙ্গীতে উচ্চাকাক্সক্ষী সে বিষয়ে তার ডেডিকেশন পরিষ্কার। সবমিলিয়ে গত কয়েক মাস ধরে আমাদের বিনোদন জগতের করিশমা বেশ জৌলুসপূর্ণ। যার প্রভাবে আমাদের বিনোদনপ্রেমীরা এই জৌলসে মন শান্ত করছেন।
×