ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আরও দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা আসার অপেক্ষায়

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৯ অক্টোবর ২০১৭

আরও দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা আসার অপেক্ষায়

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ দুর্দশায় পতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানবিক আচরণের সুযোগ নিচ্ছে মিয়ানমার। রাখাইন রাজ্যে পরিকল্পিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এ জনগোষ্ঠীকে সীমান্ত অতিক্রমে বাধ্য করছে সে দেশের সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ অভিমুখে যে স্রোত গত ২৫ আগস্ট শুরু হয়েছিল তা এখনও অব্যাহত আছে। কক্সবাজারের কুতুপালং ও বালুখালীতে অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করে ত্রাণ, চিকিৎসাসহ যে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে তাতে করে রোহিঙ্গাদের কাছে লোভনীয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। রাখাইনে নির্যাতন এক প্রকার বন্ধ হলেও রোহিঙ্গা স্রোত রয়েছে আগের মতোই। বর্তমানে সেখানে দুই থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা থাকতে পারে। তারাও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায়। এদিকে, বাংলাদেশ সীমান্তে শৈথিল্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় উগ্রবাদী সংগঠনগুলো বাকিদেরও ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশান্তরী করার তৎপরতা চালাচ্ছে। পুরো রাখাইন রাজ্যজুড়ে রোহিঙ্গাবিরোধী বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে সেখানকার উগ্রবাদী মগরা। সেনাবাহিনী এখন প্রত্যক্ষ ভূমিকায় না থাকলেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নানা কৌশলে তৎপর রেখেছে স্থানীয়দের। কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফে রোহিঙ্গাদের চাপ প্রতিদিনই বাড়ছে। জায়গা করে নিচ্ছে নতুন নতুন আসা রোহিঙ্গারা। এপারে যারা এসে পড়েছে তারা আহ্বান জানাচ্ছে তাদের স্বজনদের। এখানকার মানবিক পদক্ষেপগুলো তাদের এদিকে টানছে। এপারের স্বজনরা জানিয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক মহলের নানা কল্যাণকর ব্যবস্থার খবর। এর ফলে সেখানে যারা রয়েছে তারাও ধেয়ে আসছে সীমান্তের দিকে। গত চারদিনে নতুন করে প্রবেশ করেছে লাখের কাছাকাছি। সব মিলিয়ে নতুন রোহিঙ্গার সংখ্যা এরমধ্যেই ৬ লাখ ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুরনোদের মিলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা অন্তত ১১ লাখ। উখিয়ার আঞ্জুমান পাড়া সীমান্তে এখন সুযোগের অপেক্ষায় অসংখ্য রোহিঙ্গা। বিজিবি প্রবেশে বাধা দেয়ায় তারা জিরো লাইনে অবস্থান নিয়ে করে চলেছে অনুনয় বিনয়। বাংলাদেশ তাদের গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছুটা গড়িমসি করলেও মানবিক কারণে ঠেলে সেখান থেকে তাড়িয়েও দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার শেষ পর্যন্ত এ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে কি না, আর নিতে রাজি হলেও এরা যেতে রাজি হবে কি না সে প্রশ্ন এখন যেন অনেকটাই মীমাংসিত। কেননা, বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারীরা এ প্রশ্নের জবাবে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, নাগরিকত্ব এবং সমান মর্যাদা ও অধিকারসহ তাদের দাবিগুলো মেনে নেয়া না হলে তারা ফিরে যাবে না। এতে করে যে প্রশ্নটি দেখা দিয়েছে, মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গাদের চাওয়াগুলো পূরণ না করে তবে কি তারা বাংলাদেশেই থেকে যাবে? আবার অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশের সীমান্ত পথগুলোতে এখন কঠোরতা আরোপ করা উচিত। কেননা, রাখাইনে আগের মতো নির্যাতন এখন নেই। বরং এখন যারা আসছে, তাদের মধ্যে রয়েছে খাদ্য, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার লোভ। নিবন্ধিত আড়াই লাখ রোহিঙ্গা ॥ বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে শুরুতে ধীরগতি থাকলেও এখন তা নয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পাসপোর্ট অধিদফতরের সহায়তায় নিবন্ধন কাজে এসেছে গতি এবং শৃঙ্খলা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ অনুপ্রবেশকারীর বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বুধবার দুপুরে কুতুপালং ক্যাম্পে নিবন্ধন কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি এ তথ্য জানান। মন্ত্রী সেখানে স্থাপিত সেনাবাহিনীর ত্রাণ সমন্বয় কেন্দ্র এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) ৩৪টি গোডাউন পরিদর্শন করেন। সার্বিক কার্যক্রমে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। ত্রাণমন্ত্রী মায়া জানান, সম্পূর্ণ মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কোন রোহিঙ্গা যেন অনাহারে না থাকে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালিতে ৬ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখা সম্ভব হবে। তাদের স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়া হযেছে। ইতোমধ্যেই ৯ হাজার ল্যাট্রিন নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া ৪ হাজার নলকূপসহ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা হবে। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামাল, শরণার্থী ও ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা। রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচর ডাক ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে এরমধ্যেই বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে। কিন্তু বাকিদেরও দেশান্তরী করতে অপতৎপরতা থেমে নেই। রাখাইন রাজ্যজুড়ে রোহিঙ্গাবিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচীর ডাক দিয়েছে সেখানকার স্থানীয় মগ উগ্রবাদীরা। আগামী ২২ অক্টোবর এ কর্মসূচি পালিত হবে। এর পেছনে ইন্ধন রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। বাহিনীর সদস্যরা আগের মতো তৎপর না হলেও পরোক্ষ ভূমিকা রেখে চলেছে। কর্মসূচীর সমর্থনে মংডু, রাচিদং, বুচিদংসহ বিভিন্ন শহরে রোহিঙ্গাবিরোধী লিফলেট বিতরণ এবং ব্যানার ফেস্টুন টানানো হয়েছে বলে জানিয়েছে এপারে আসা রোহিঙ্গারা। তারা বলছে, সকল রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার টার্গেট নিয়ে তৎপরতা চলছে। রোহিঙ্গাবিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচী সংক্রান্ত লিফলেটে মিয়ানমার সরকারকে আরও কঠোরতা অবলম্বনের দাবি জানিয়েছে সেখানকার উগ্রবাদী সংগঠনগুলো। বিতাড়িতদের বাঙালি আখ্যা দিয়ে, তাদের আর ফেরত না আনার জন্য দাবি করছে রাখাইনরা। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যে অবশিষ্ট যেসকল রোহিঙ্গা রয়েছে তাদেরও বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার দাবি রয়েছে ওইসব লিফলেটে। সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ঐক্য গড়ার আহবান জানিয়েছে রাখাইন এবং অন্য সম্প্রদায়গুলোর প্রতি। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার আহ্বান ॥ ‘আঁরা এডে ভালা আছি। খানা ল-নার, কনো পেরেশান নাই। তোঁয়ারাও আইজও-গৈ।’ অর্থাৎ আমরা এখানে ভাল আছি, খাওয়া-দাওয়ার কোন চিন্তা নেই। তোমরাও চলে আসো। এভাবেই ওপারে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে চলে আসতে উদ্বুদ্ধ করছে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। মুঠো ফোনে নেটওয়ার্ক থাকায় এপার-ওপারের মধ্যে কথা চালানো যাচ্ছে খুব সহজেই। রাখাইনের চেয়ে রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন বাংলাদেশে অনেক বেশি। যারা রয়ে গেছে তারা এদেরই স্বজন, প্রতিবেশী এবং পরিচিত। তারা অন্যদেরও এপারে নিয়ে আসতে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে টেলিটক এর বুথ স্থাপনের পাশাপাশি টেলিফোন সুবিধা দিচ্ছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিও। স্বেচ্ছাসেবীরা রোহিঙ্গাদের ডেরায় ডেরায় গিয়ে এই এই সেবা দিচ্ছে। এছাড়া পুরনো অনেকের হাতেই রয়েছে মোবাইল ফোন। অনেক বাঙালিও রোহিঙ্গাদের নানাভাবে কথা বলতে সহায়তা করছে। ফলে মিয়ানমারে থাকা স্বজনদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কোন সমস্যা নেই। রাখাইন রাজ্যের অনেকটুকু এলাকাজুড়ে বাংলাদেশের মোবাইল টেলিফোন অপারেটরগুলোর নেটওয়ার্কও রয়েছে। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এক কর্মী বলেন, গত ১০-১৫ দিন যারা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারছে না, বেছে বেছে তাদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বিনিময়ে কোন টাকা নেওয়া হচ্ছে না। বিনামূল্যে এই সেবা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের এই কর্মসূচী নিয়ে কাজ করছে রেড ক্রিসেন্টের প্রায় ৪০ জন কর্মী। এরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে উখিয়া-টেকনাফের ১২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঘুরে এ কাজ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা এই সেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে মিয়ানমারে থাকা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে। উখিয়ার শফিউল্লাহ, বালুখালী ও থাইংখলী ক্যাম্পের বহু রোহিঙ্গা জানায়, তাদের প্রায় প্রত্যেকের কাছেই মোবাইল ফোন আছে। রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার সময় এসব ফোন এবং চার্জ করার জন্য সঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছে সোলার প্যানেলও। এইডস রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে ॥ সহিংসতার মুখে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে মারাত্মক বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগও। এ ধরনের রোগীদের অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইডস রোগ ধরা পড়া রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বুধবার পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া ২৪ জন এইডস রোগীর মধ্যে এ পর্যন্ত একজন মারা গেছে। মিয়ানমার থেকে ২২ জন শরীরে এই ভাইরাস নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। এখানে আসার পর আরও ২ জনের মধ্যে পাওয়া গেছে এ ভাইরাসের উপস্থিতি। বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরও এইডস রোগী থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আবদুস সালাম জানান, শনাক্ত হওয়া ছাড়া আরও এইচআইভি পজেটিভ রোগী আছে কি না তা নির্ণয় করতে শিগগিরই একটি পরীক্ষা চালানো হবে। এভাবে এইডস রোগী শনাক্ত হওয়া আমাদের জন্য অতি উদ্বেগের বিষয়। ৬০ হাজার পিস ইয়াবা ফেলে পালিয়েছে রোহিঙ্গারা ॥ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আসছে ইয়াবা ট্যাবলেটও। যারা আনছে তাদের অনেকেই আগে থেকেই ইয়াবার কারবারী। আবার সঙ্গে করে কেউ কেউ নিয়ে আসছে বাড়তি কিছু আয়ের উদ্দেশ্যে। মঙ্গলবার গভীর রাতে টেকনাফ সাবরাং লাফারঘুনায় উদ্ধার হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ৬০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট। এগুলো ফেলে পালিয়েছে রোহিঙ্গারা। পরে ইয়াবাগুলো উদ্ধার করেছে বিজিবি। টেকনাফ-২ বিজিবির পরিচালক অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম অভিযানের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, লাফারগোনার পূর্ব পাশে মাঠের মধ্য দিয়ে ইয়াবার একটি চালান মিয়ানমার হতে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে এমন খবর পেয়ে বিজিবির একটি বিশেষ টহলদল মাঠের একপাশে অবস্থান নেয়। কয়েকজন লোককে ব্যাগ হাতে আসতে দেখে টহলদল তাদের চ্যালেঞ্জ করে। বিজিবি টহলদলের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় চোরাকারবারিরা। ওই ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় ৬০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট।
×