ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক সৈয়দ মাহমুদুল আজিজ

স্মরণ ॥ জহুরুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ১৯ অক্টোবর ২০১৭

স্মরণ ॥ জহুরুল ইসলাম

জহুরুল ইসলাম এই জনপদের একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি এবং শিক্ষাসহ সামাজিক উন্নয়নের প্রায় সর্বক্ষেত্রে নজিরবিহীন অনন্য উদাহরণ সৃষ্টিকারী এই বিস্ময়কর প্রতিভার জন্ম ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌরসভার ভাগলপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতার নাম আফতাব উদ্দিন আহমেদ এবং মাতা রহিমা খাতুন। জহুরুল ইসলামের শৈশব কেটেছে ভাগলপুর গ্রামে। স্থানীয় স্কুলে ৫ম শ্রেণী পড়ার পর সরারচর শিবনাথ হাইস্কুল ও পরবর্তীতে বাজিতপুর হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। চাচা মুর্শিদ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কলকাতা যাওয়ার পর রিপন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর বর্ধমান জেলার ১টি কলেজে ভর্তি হলেও চলে আসেন মুন্সীগঞ্জে এবং পড়ালেখা করেন হরগঙ্গা কলেজে। মেধাবী জহুরুল ইসলামের ছিল শিক্ষার প্রতি অসীম আগ্রহ কিন্তু অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও পারিবারিক দায়িত্ববোধ থেকে উচ্চশিক্ষা পরিহার করে চাকরিতে যোগ দেন ১৯৪৮ সালে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি তৎকালীন সিএন্ডবিতে স্বল্প বেতনে যোগদান করেন। কিন্তু প্রখর দূরদর্শিতা ও অদম্য সাহসের অধিকারী এই মানুষটি নিজের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে নিজেই বড় কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। অল্পদিনের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু করলেও অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে নিজের অধ্যবসায় ও প্রজ্ঞাবলে তাঁর কর্মপরিধি ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। ‘বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলাম গ্রুপের প্রথম প্রতিষ্ঠান। তৎকালীন পাকিস্তানে যেখানে সকল ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের একচেটিয়া দখলে, সেই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও জহুরুল ইসলাম তাঁর প্রতিষ্ঠানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন প্রথম শ্রেণীর মানসম্পন্ন কোম্পানি হিসেবে। এই কোম্পানির প্রথম দিককার উল্লেখ্যযোগ্য কিছু স্থাপনা তৈরির নিদর্শন হিসাবে বলা যায় বাংলাদেশ ব্যাংক, পুরনো হাইকোর্ট ভবন, সুপ্রীমকোর্ট ভবন, গণভবন ইত্যাদি। অক্লান্ত পরিশ্রমী এবং চ্যালেঞ্জিং মনোভাবের অধিকারী এই ব্যক্তিত্ব স্বল্প সময়ের কার্যাদেশে তৈরি করেন এমপি হোস্টেল, পুরনো সংসদ ভবন, খাদ্যগুদাম, বিভিন্ন সড়ক যা নির্মাণ শিল্পে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠানের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশে-বিদেশে। সময়ের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি গড়ে তোলেন আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এবং বিস্তৃত করেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মপরিধি। দেশের মানুষের আবাসন সঙ্কট নিরসনে প্রতিষ্ঠা করেন ইস্টার্ন হাউজিং যা এই খাতে প্রথম এবং অদ্বিতীয়। প্রতিষ্ঠা করেন ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন যা বেসরকারী ব্যাংকিং খাতের অগ্রদূত। কৃষি উন্নয়নে আধুনিক সেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন মিলনার্স পাম্প ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ধীরে ধীরে তাঁর কর্মকা- আরও বিস্তার লাভ করে। কয়েকটি পাটকল, ওষুধ শিল্প, গাড়ি সংযোজন কারখানা এবং আরও অনেক স্থাপনা গড়ে তোলেন। জনদরদী জহুরুল ইসলাম অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন তাঁর এলাকা এবং আশপাশের জেলা ও বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকার চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্দশা ও হয়রানির কথা। মনের লালিত বাসনা থেকে তিনি ১৯৮৯ সালে নিজ গ্রাম ভাগলপুরে নির্মাণ শুরু করলেন একটি হাসপাতাল সেই সঙ্গে ডিপ্লোমা নার্সিং ইনস্টিটিউট। ভাগলপুরের মতো প্রত্যন্ত গ্রামে হাসপাতাল স্থাপনের কথা শুনে অনেকেই তখন অবাক হয়েছিলেন এমনকি নিজ পরিবারের মধ্যেও কেউ কেউ নাকি দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ী এই মানুষটি তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন জনগণ সুলভে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পাবে এবং কেউ যেন অর্থের অভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। একটি অলাভজনক-সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসাবে এটি গড়ে উঠেছিল এবং হাসপাতালকে সহায়তা দানের জন্য তিনি তৈরি করেছেন আফতাব বহুমুখী ফার্ম। ১৯৯০ সালে হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে এবং বিভিন্ন বিভাগ চালু হয়। বর্তমানে হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫০০ এর অধিক এবং সকল অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা সুসজ্জিত। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে এই হাসপাতালে সুলভে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকে। জহুরুল ইসলামের জীবনচরিত ও বিশাল কর্মকা- স্বল্প কথায় সহজে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কিংবদন্তি উদ্যোক্তা, অক্লান্ত পরিশ্রমী নিষ্ঠাবান এই মহাপরুষের কর্মপরিকল্পনা ছিল অসীম যা তিনি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। স্বল্প সময়ে তিনি যে বিশাল কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন, মানবিক ও চারিত্রিক গুণাবলীর যে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা বাঙালী জাতির আদর্শ, কর্মোদ্যোগ ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। ১৯৯৫ সালের ১৯ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন এবং ভাগলপুরে নিজ গ্রামে সমাহিত হন। পরম করুণাময় তার আত্মার শান্তি দান করুন। লেখক : অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ
×