ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাখাইনে এক মাসে পুড়েছে ২৮৮ গ্রাম

রোহিঙ্গা ঢল কবে থামবে কেউ জানে না

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৮ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা ঢল কবে থামবে কেউ জানে না

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা স্রোত মাঝে কিছুটা স্তিমিত হলেও ফের শুরু হয়েছে । নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আবারও তারা ঢুকছে হাজার হাজার। আর কত রোহিঙ্গা এলে এই ঢল বন্ধ হবে তা অজানা। শুধু মিয়ানমার নয়, ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের আকর্ষণও বাংলাদেশ। স্বজন এবং পরিচিতদের সিংহভাগই চলে আসায় বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টায় তারা। তাছাড়া চলছে এদিকে পুশ করার চেষ্টাও। সেদিক রোহিঙ্গা ঠেকাতে ভারত সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে বিজিবি। এদিকে, মিয়ানমারের রাখাইনে এখন নির্যাতন না চললেও সেখানে একমাসে ২৮৮ গ্রাম পোড়ানোর প্রমাণ পেয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইট ওয়াচ। স্যাটেলাইটে সর্বশেষ পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ দাবি করেছে সংগঠনটি। কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ার সীমান্তবর্তী অধিবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, বুধবার পর্যন্ত দুদিনেই নতুন করে রোহিঙ্গা এসেছে ৫০ হাজারের অধিক। ক’দিন আগে আসা রোহিঙ্গারা তথ্য দিয়েছিল যে, সীমান্তের ওপারে অন্তত ১ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। মাত্র দুদিনের এমন স্রোতে তাদের বক্তব্যই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। সীমান্ত খোলা থাকায় এখন রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে একেবারে বাধাহীন। কুতুপালং এবং বালুখালীতে রীতিমত গিজগিজ অবস্থায়। আর কত রোহিঙ্গা এলে স্রোত থামবে সে প্রশ্ন রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোরও। কারণ, এই সকল সংস্থায় কর্মরতরা হিমশিম খাচ্ছেন। প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের তালিকাভুক্তি এবং তাদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনার কাজ শেষ হতে না হতেই এসে পড়ছে নতুন রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা এসে জানাচ্ছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কথা, যদিও এখনকার অভিযোগগুলো অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। এদিকে, ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কাছেও বাংলাদেশ এখন আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ভারত সরকারের রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থানের পাশাপাশি বাংলাদেশে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এসে পড়ায় তারাও এখন বাংলাদেশমুখী হওয়ার চেষ্টায়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের পটুয়াখালী হয়ে ইতোমধ্যেই শতাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকে পুশ করছে বলে তথ্য রয়েছে। প্রকারান্তরে ভারতও এখন বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের বিকল্প আবাসস্থল হিসেবে দেখছে, এমন ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছে। ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে জানা যায়, বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে এসে প্রবেশের সুযোগ খোঁজার চেষ্টায় রয়েছে ভারতে থাকা রোহিঙ্গারা। সীমান্তের পটুয়াখালী এলাকায় দায়িত্বরত বিজিবির এরিয়া কমান্ডার লে. কর্নেল তারিকুল হাকিমের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থাটি জানায়, পটুয়াখালী এলাকায় সরু একটি নদীর ওপারে রোহিঙ্গাদের ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। তাদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করা। সে কারণে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সীমান্তে সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে। এএফপির খবরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানানো হয়, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশ করতে নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ করছেন তারা। স্থানীয়দের সহায়তায় বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করানো হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ভারতে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। বর্তমান সরকার তাদের বের করে দেয়া হবে বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ রোহিঙ্গাদের গন্তব্যও হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, এটাই চিন্তার বিষয়। সূত্র জানায়, ভারতে থাকা রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশেই প্রবেশ করতে চায়। কেননা, দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এবং উখিয়াতে রাখাইন থেকে নতুন করে এসেছে ৬ লাখের কাছাকাছি। আগের রোহিঙ্গাসহ এ সংখ্যা এখন ১০ লাখের ওপরে। নতুন এবং পুরনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই আত্মীয়স্বজন এবং পূর্ব পরিচিত। সে কারণেই ভারতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাংলাদেশে ঢোকার প্রবণতা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। সবমিলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশই রোহিঙ্গাদের আবাসস্থল হতে যাচ্ছে কি না তা নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের বোঝা ও দায়িত্ব ভাগ করে নিতে জাতিসংঘের উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি বাংলাদেশের পক্ষে জোরালো অবস্থান রয়েছে জাতিসংঘের। আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্র এ জনবহুল বাংলাদেশের ওপর যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা অনুধাবন করে বিশ্বের সকল দেশকে নিয়ে একটি কনফারেন্সের আয়োজন করেছে জাতিসংঘের তিনটি সংস্থা। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ইউএনএইচসিআর), মানবতা বিষয়ক কাজের সমন্বয়কারী কার্যালয় (ওসিএইচএ) এবং আইওএস সোমবার প্রদত্ত এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আগামী ২৩ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এই তিন সংস্থার আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে প্লেজিং কনফারেন্স। এর উদ্যোক্তা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কুয়েত সরকার। এতে যোগ দেবেন বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধিরা। জাতিসংঘের তিন সংস্থার বিবৃতিতে এই সম্মেলনে যোগ দিয়ে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা লাঘব এবং বাংলাদেশের ওপর চাপ কমাতে সকলকে এক হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে জোর দেয়া হয়, রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা বন্ধ, রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান, দেশান্তর বন্ধ এবং নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করার ওপর। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি, ওসিএইচএ প্রধান মার্ক লওনক এবং আইওএম প্রধান উইলিয়াম ল্যাসি সুইং। এ সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আহ্বান থাকছে বাংলাদেশের বোঝা ও রোহিঙ্গাদের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়ার। রাখাইনে একমাসে গ্রাম পুড়েছে ২৮৮ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার মধ্যে ২৫ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একমাসে গ্রাম পুড়েছে ২৮৮টি। সে দেশের সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ ভূমিকায় এ গ্রামগুলো সম্পূর্ণ এবং আংশিক ধ্বংস হয়েছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংগৃহীত সর্বশেষ তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে এ প্রতিবেদন পেশ করেছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইট ওয়াচ। খাদ্য সঙ্কটের তথ্য গোপন করেছিল জাতিসংঘ সংস্থা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বর্তমানে যে খাদ্য সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে তা একদিনে হয়নি। বরং তিন বছর আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে এ সঙ্কট সৃষ্টি করানো হচ্ছিল। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ডব্লিউএফপি একটি প্রতিবেদন তৈরিও করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের কাছে সুসম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, এই ভেবে প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। সকল রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন দাবিতে স্থানীয়দের স্মারকলিপি উখিয়া এবং টেকনাফে হঠাৎ করে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এসে পড়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে সেখানকার জনজীবনে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি সামাজিক জীবনযাত্রা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে এ দুই উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। তারা রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন দ্রুত সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছেন। কক্সবাজার জেলাব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নতুন ও পুরাতন রোহিঙ্গাদের সরকার নির্ধারিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বায়োমেট্রিকের আওতায় তালিকাভুক্ত করার দাবি জানিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে কক্সবাজার পিপলস ফোরাম। মঙ্গলবার দুপুরে কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সভাপতি দৈনিক রূপালী সৈকতের সম্পাদক ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবালের নেতৃত্বে এ স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ২৭ লাখ মানুষ রোহিঙ্গাদের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে কক্সবাজার জেলার প্রায় ২৭ লাখ মানুষ। উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে এখনও। একারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিধি প্রতিদিনই বাড়ছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে পড়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় লোকজন। নৌকাডুবির ঘটনায় আরও এক নারীর লাশ উদ্ধার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাবাহী নৌকাডুবির ঘটনায় মঙ্গলবার আরও এক রোহিঙ্গা নারীর লাশ ভেসে এসেছে। সোমবারের এই নৌকাডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে।
×