ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মাসে পুড়ছে ৪৫ হাজার টন লাকড়ি

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১৮ অক্টোবর ২০১৭

মাসে পুড়ছে ৪৫ হাজার টন লাকড়ি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা প্রায় নয় লাখ রোহিঙ্গা প্রতিদিন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে পনেরো লাখ কেজি লাকড়ি। যা স্থানীয় বাজার দরে মূল্য দাঁড়ায় দেড় কোটি টাকা। প্রতিকেজি ১০ টাকা অর্থাৎ মাত্র ৪শ’ টাকা মণ হিসেবে লাকড়ি বিক্রি হচ্ছে স্থানীয় বাজারে। বেসরকারী পরিসংখ্যান অনুসারে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত প্রায় দেড় লাখ পরিবারের মধ্যে প্রত্যেক পরিবার প্রতিদিন দশ কেজি করে লাকড়ি ব্যবহার করে থাকলে ওই রোহিঙ্গাদের জন্য মাসে জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন পড়ে সাড়ে চার কোটি কেজি অর্থাৎ ৪৫ হাজার টন। এই ১১ লাখ ২৫ হাজার মণ তথা ৪৫ হাজার টন লাকড়ির মূল্য দাঁড়ায় ৪৫ কোটি টাকা। রোহিঙ্গারা প্রতিমাসে ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের বনাঞ্চলের কচি গাছ ধ্বংস করে চলেছে। গত ২৭ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত হওয়ার পর লাখ লাখ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাকে সরকার, দেশী-বিদেশী এনজিও, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তা, চিকিৎসা সেবা, বাসস্থান-স্যানিটেশন ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করে আসছে। এমনকি অনেকে নগদ টাকাও বিলি করছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও জ্বালানি হিসেবে কোন গ্যাস সিলিন্ডার বা তেলের চুলা কেউ দেয়নি। ওসব ত্রাণ পেয়ে রান্না করার কোন ব্যবস্থা না থাকায় তারা সামাজিক বনায়ন ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে প্রতিনিয়ত। এতে ধ্বংস হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকার বনজসম্পদ। গত পঞ্চাশ দিন ধরে সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন জিরো পয়েন্ট হয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করেই চলছে। যা এখনও অব্যাহত আছে। বিশাল এই রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে চরম দুর্ভোগ ও বেকায়দায় পড়েছে টেকনাফ ও উখিয়ার বাসিন্দারা। কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এবং উখিয়া বাসিদের জন্য রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ নতুন কিছু নয়। এসব রোহিঙ্গার প্রতি পদে পদে স্থানয়ীদের পড়তে হচ্ছে অর্থনৈতিক অসঙ্গতিসহ নানা জটিলতায়। সচেতন মহল বলেন, দেশের অন্য ৬৩ জেলাবাসী রোহিঙ্গাদের জন্য আবেগে থাকলেও কিন্তু কক্সবাজার জেলাবাসী রয়েছেন চরম আতঙ্কে। গত আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের ঢল নামলেও তাদের অনুপ্রবেশের এ ধারা চলে আসছে ১৯৭৮ সাল থেকেই। রোহিঙ্গারা বেঁচে থাকার জন্য দেশী-বিদেশী ত্রাণ সহায়তা পেলেও চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয়রা চাল, ডাল, মাছ, তরকারি, লবণ, দুধ, চিনি, পেঁয়াজ-রসুন, হলুদ-মরিচ সব কিছুতেই এখন ভুক্তভোগী উখিয়া টেকনাফের পৌনে পাঁচ লাখ স্থানীয় মানুষ। ১৫০ বর্গমাইলের টেকনাফ ও ১০১ বর্গমাইলের উখিয়ায় মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার। ইতোমধ্যে টেকনাফে ২ লাখ ৬৫ হাজার, উখিয়ায় ২ লাখ ১০ হাজার লোকসংখ্যা রয়েছে। এ দুটি উপজেলায় বর্তমানে রয়েছে ৯ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। স্থানীয় গরিব শ্রেণীর বাসিন্দারা বনাঞ্চলের নষ্ট লাকড়ি ব্যবহার করে প্রচলিত আইন মেনে এবং দেশের টানে বনাঞ্চলের কচি গাছ ক্ষতি করেনি এ পর্যন্ত। তারপরও বনবিভাগ স্থানীয় অনেকের নামে বনআইনে মামলা টুকে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের আদিকাল থেকে জ্বালানির চাহিদা মেটানোর একমাত্র পথ কাঠ। রোহিঙ্গারা সামাজিক বনায়ন ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ছোটবড় সব রকমের গাছ কেটে সাবাড় করে দিচ্ছে। অসহায় হয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে বনকর্মীরা। তবে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়া দুইটি রেজিস্ট্রাট ক্যাম্পে প্রত্যাবাসনের জন্য অপেক্ষাকৃত প্রায় ৩৪ হাজার শরণার্থীকে ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে তুষের লাকড়ি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তারা ওসব লাকড়ি বরাদ্দ পাওয়ার পরপরই বস্তা না খুলে ফের ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করে দিয়ে ব্যবহার করে আসছে বনাঞ্চলের লাকড়ি। জলবায়ু অনুকূলে রাখতে দেশের সর্ব দক্ষিণ টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছিল। লাখ লাখ রোহিঙ্গার ভিড়ে ওসব গাছ তথা সবুজায়ন আর নেই। গাছ ও পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের আবাসন তৈরি করায় সেখানে নেই বন্যপ্রাণী। নেই পাখিও। এদিকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়রা বলেন, উখিয়া ও টেকনাফের অধিকাংশ মানুষ গত কয়েক বছর ধরে প্রতিদিনের রান্নার কাজে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছে। দুই উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শত শত গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রেতার দোকান এজেন্ট রয়েছে। ডিজিটার দেশে স্থানীয় বাসিন্দারা লাকড়ির বদলে ইদানিং গ্যাসের প্রতি ঝুঁকছে বেশি। ইতোপূর্বে টেকনাফ সড়ক দিয়ে যেতে সবুজ শ্যামল পাহাড়ের দৃশ্য দেখলে স্থানীয়রা ছাড়াও পর্যটকদেরও মন জুড়ে যেত। কিন্তু সৌন্দর্য়ের লীলাভূমি আর নেই। গত একমাসের মধ্যে রোহিঙ্গারা ওসব পাহাড় কেটে ন্যাড়া করে দিয়েছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে ২ হাজার একর উন্নয়নশীল বনভূমিতে নতুন ক্যাম্প তৈরির ঘোষণার পর উখিয়া টেকনাফ এলাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। ওইসময় ওসব রোহিঙ্গার জন্য হয়ত দুই হাজার একরের বেশি পাহাড় লাগবে না বলে ধারণা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গার ঢল নামে উখিয়া-টেকনাফে। একত্রে এত বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করবে-এটা সবাইর কল্পনার বাইরে ছিল। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার আরও ৩ হাজার একর জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে। কক্সবাজার বিভাগীয় (দক্ষিণ) বনকর্মকর্তা মোঃ আলী কবির বলেন, বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ণ এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে পরিবেশ, বন, জীব-বৈচিত্র যে হুমকির মুখে-তা আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছি। এদিকে টেকনাফ উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই স্থানীয় জনগণের জীবন ও জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব বাড়ছে।
×