ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রিপোর্টারের ডায়রি

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ১৮ অক্টোবর ২০১৭

রিপোর্টারের ডায়রি

‘ও পানি পেল কিনা জানি না’! ঢাকার বাইরে রিপোর্ট করতে এবার কক্সবাজারের পালা। তাও আবার মিয়ানমারে গণহত্যা আর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ। ভিন দেশের একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে সংবাদ তৈরির অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন। প্রতিদিন সংবাদপত্র আর টেলিভিশনে দেখছিলাম রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ভয়াবহতা। বিদেশী সংবাদমাধ্যমে একই চিত্র। তারাও বেশ ফলাও করে খবরটি প্রচার ও প্রকাশ করছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে তা যাবার আগ থেকেই টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু কক্সবাজারের টেকনাফ আর উখিয়ার চিত্র দূর থেকে যা কল্পনা করছিলাম তার চেয়ে কত গুণ ভয়াবহ; নিজ চোখে না দেখলে তা বর্ণনা করা কঠিন। সত্যিই কঠিন। এক কথায় বললে সত্যিই মানবিক বিপর্যয়। যা অন্য কোন ভাষায় বোঝাতে পারব না। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রতিটি মানুষ একটি মানবিক গল্পের প্রধান চরিত্র। যা শোনলে গা শিহরে ওঠার মতো। পাশাপাশি বাংলাদেশে তাদের অবস্থা বা জীবনযাপনের দৃশ্যও বড় কঠিন। নির্মম। নারী ও শিশুদের অবস্থা দেখলে চোখে পানি আটকে রাখার উপায় নেই। আর সবার মুখ থেকে মিয়ানমার সেনা ও মগদের নির্যাতনের করুণ গল্পগুলো শোনলে নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখা যায় না। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে আহত শিশু ও নারীদের অবস্থা দেখে অনেককেই কাঁদতে দেখেছি। এ কোথায় এলাম। যেখানে হাজার-হাজার গল্প পড়ে আছে। কত লিখব। বাস্তবতা হলো ঘটনা ঘটলেই সবকিছু জমিয়ে লেখা যায় না। অর্থাৎ ভেতরের খবরগুলো আকর্ষণ তৈরি করে না। তাছাড়া সব ঘটনায় পাঠকের আগ্রহ তৈরি করা যায় না। কিংবা আগ্রহ নিয়ে পাঠক পড়ে না। কিন্তু এখানে যত ঘটনা, সবই যদি পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পায় তা হলে পাঠক বিরক্ত হবে না। আগ্রহ নিয়ে পড়ার মতো সবই। সচরাচর এমন ঘটনা ঘটে না। যা মিয়ানমারে হয়েছে। যদি ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়, ১০টি ঘটনাই পত্রিকায় পাতায় লেখার মতো। সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর এত নির্মম বর্বরতা চালানো হয়েছে যা প্রতিদিন একটি রিপোর্টে লিখে শেষ করা যাবে না। সম্ভবও হয়নি। কক্সবাজার নেমে মেরিন ড্রাইভ হয়ে সরাসরি টেকনাফের শামলাপুর। এই এলাকায় একটি স্কুল মাঠ রয়েছে। সেখানে একটি রাজনৈতিক দলের ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচী ছিল। মাঠের একদিকে ত্রাণ বিতরণ চলছিল। অন্যপাশে ছিল অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প। কিন্তু মাঠের চারদিকে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ভিড়। সবাই যার যার মতো করে ছুটছেন। মাটিতে বসে আছেন। কেউ হাত পাচ্ছেন। সবাই ক্ষুধার্থ। নিরন্ন। বৃদ্ধ মানুষগুলো ক্ষুধার যন্ত্রণায় আহাজারি করছেন। কারও কারও আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠছিল আকাশ-বাতাস। কেউ টাকার জন্য হাতে পায়ে ধরছেন। একটু খাবার সংগ্রহের চেষ্টা তাদের। জীবন বাঁচানোর যুদ্ধ। দেখলাম ক্ষুধায় কাহিল হয়ে গেছে শিশুরা। অনেক শিশু ঘাড় তোলে তাকানোর শক্তিও হারিয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই মাঠে রোহিঙ্গারা অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। রাজনৈতিক দলের ত্রাণ বিতরণকে কেন্দ্র করে আগেরদিন রাত থেকে তাদের উঠিয়ে দেয়া হয়। তাই মাঠের চারপাশজুড়ে তারা বসেছিল। ত্রাণের কাপড়, চাল কেউ পেয়েছেন কেউ। কেউ পাননি। প্রচন্ড হইচই। একটু খাবারের জন্য মানুষের এমন চেষ্টা আর কোনদিন দেখিনি। পানির জন্য ছোট ছোট শিশুগুলোকে কাঁদতে দেখেছি। দুই টাকা দামের একটি বিস্কুটের প্যাকেটের জন্য শত মানুষের কাড়াকাড়ি। যাই হোক, এবার যাত্রা শুরু উখিয়ার পথে। মাঠ থেকে বের হওয়ার সময় বাজারের চারপাশে রোহিঙ্গা নারী শিশুদের জটলা। কারও বাড়ির আঙ্গিনায়, গোলা ঘরে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা। শিশুদের গায়ে কোন কাপড় নেই। টেকনাফ উখিয়া সড়কে ওঠা মাত্রই দৃশ্যপট বদলে গেল। আমি বিস্মিত। হতবাক। শুনেছি শরণার্থীদের অবস্থা। নিজ চোখে দেখিনি। গল্পের সঙ্গে বাস্তব সবকিছু মিলে যাচ্ছে। দেখলাম রাস্তার দু’পাশে হাজারে-হাজারে বুভুক্ষু মানুষের অবস্থান। কেউ মাটিতে শুয়ে আছে। কেউ হাঁটছে। কেউ আশ্রয়ের চেষ্টা করছে। আগের তিন রাতে বৃষ্টি হয়েছে। তাদের কাছে বৃষ্টি কিছু নয়। কাঁদাজল মাড়িয়ে মাটিতেই আছে। সড়কের দু’পাশে ছেড়া কাপড়ের স্তূপ। অর্থাৎ বৃষ্টির পর কাপড় বিছিয়ে রাত কেটেছে তাদের। সামান্য রোদের আঁচে সেগুলো আবারও শুকাচ্ছে। ফের রাতে ঠিকানা হবে খোলা আকাশের নিচেই। রাস্তার পাশে থাকা রোহিঙ্গাদের যে যার মতো সাহায্যের চেষ্টা করছে। কিন্তু অপ্রতুল ত্রাণ কত জনকে দেয়া যায়। একটি বিস্কুটের প্যাকেট বের করলে যেখানে মুহূর্তের মধ্যে শত-শত মানুষ ভিড় করে। আরেকটু সামনে গিয়ে দেখলাম। কেউ জঙ্গলে। কেউ পাহাড়ে। কেউ রাস্তায় আছেন। পাহাড়ে কোন গাছ নেই। সবকটি পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রোহিঙ্গাদের প্লাস্টিকের অস্থায়ী ঘর। সবখানেই বেঁচে থাকার সংগ্রাম। পানি, বাসস্থান, খাদ্য, পয়নিষ্কাশন সব কিছুতেই হাহাকার আর হাহাকার। গাড়ি দেখলেই তারা জড়ো হচ্ছেন। হাত পাচ্ছেন। সব খানেই যেন এক ধরনের রব। ভাত দাও। বাঁচাও আমাদের। কেউ কেউ অজানা গন্তব্যের দিকে হাঁটছেন। টাকা নেই। তাই টেকনাফ থেকে হেঁটে হেঁটে উখিয়ার কুতুপালং পর্যন্ত ক্যাম্পে যাবার চেষ্টা। দিনশেষে একটি দোকান থেকে পানি কেনা। রাস্তায় পাশে দাঁড়িয়ে পানি খাচ্ছিলাম। ক্লান্ত চোখ বার বার বন্ধ হয়ে আসছিল। পেছনে কোমল হাতের স্পর্শ। তাকালাম। চারপাশ জুড়ে অন্তত ৫০টি শিশু। সবাই হাত বাড়িয়ে আছে। এক লিটার পানি কিনে খাচ্ছিলাম। তাই চাইছে তারা। ওদের কচি হাত, ক্ষুধার্ত মলিন মুখ দেখে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। ভেতরে আর পানি গেল না। আমার পিপাসা মিটে গেছে। আরও দুই লিটার পানি কিনে স্যালাইনের সঙ্গে মিশালাম। যে ক’জন হয়েছে তাদের মুখে একটু একটু পানি দেই। ওরা প্রত্যেকেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলছিল। এতেই যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে নিষ্পাপ এই শিশুগুলো। কিন্তু বেশি সময় থাকার সাধ্য এখানে নেই। শয়ে শয়ে মানুষ আমার দিকে আসছে। সবাই ভেবেছে আমি ত্রাণ নিয়ে গেছি। দ্রুত সরে গেলাম। তবে যে শিশুটি একটু পানির জন্য আমার পিছে কোমল হাতে ইশারা করছিল সে পানি পেয়েছি কিনা জানি না। জানার সুযোগও হয়নি...। সময় পেলে হয়ত আগামী ডায়েরিতে আরও ঘটনা তুলে ধরব। -রাজন ভট্টাচার্য [email protected] বিকল্প পথে ঢাকায় ফেরা ৯ অক্টোবর, সোমবার। ঢাকা থেকে সকাল ৭টায় রওনা দিয়ে সকাল সাড়ে ৯টায় কুমিল্লার তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি গ্রামে নিজ বাড়িতে পৌঁছি। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে নিকটস্থ গৌরীপুর বাজারে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে দুপুরে আবার বাড়ি ফিরে যাই। মধ্যাহ্ন ভোজ ও বিশ্রাম শেষে বিকেল ৪টায় ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নেই। ভাবছি আসার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে সড়কের মেঘনা ব্রিজ ও গোমতি ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় যেই যানজট দেখে এসেছি তাতে কতক্ষণে ঢাকায় ফিরে যেতে পারব কে জানে। হঠাৎ মনে হলো বিকল্প পথে ঢাকায় ফিরলে কেমন হয়? বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ফোন দিলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু নিরঞ্জন সরকারকে। সে বি.বাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করে। তাঁর কাছেই একদিন শুনেছিলাম বিকল্প পথে কম সময়ে ঢাকা যাওয়ার কথা। নিরঞ্জন বলল তুমি সিএনজি অটোরিকশাযোগে সোজা বাঞ্ছারামপুর চলে এসো। তারপর আমি কম সময়ে ঢাকা যাওয়ার বাকি পথ চিনিয়ে দেব। তাঁর সঙ্গে ফোনালাপ শেষে বিকেল সোয়া ৪টায় নিজ বাড়ির সামনে থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে বাতাকান্দি বাজারে গিয়ে নামি। তিতাস উপজেলার বাতাকান্দি বাজার থেকে আরেকটি সিএনজি অটোরিকশায় প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে হোমনা উপজেলা সদরে গিয়ে নামি। সেখান থেকে আরেকটি সিএনজি অটোরিকশায় প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বিকেল সাড়ে ৫টায় বি বাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদরে গিয়ে পৌঁছি। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিল বন্ধু নিরঞ্জন সরকার। প্রায় ২৫ বছর পর তার সঙ্গে দেখা। তাই বিকল্প পথে ঢাকা যাওয়ার পথে বাঞ্ছারামপুর পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারলাম না। নিরঞ্জন সরকার আমাকে নিয়ে বাঞ্ছারামপুর সরকারী কলেজ সংলগ্ন বাসায় যায়। কথা হয় চা খাওয়ার পর আমাকে ঢাকা যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেবে। এরই মধ্যে নিরঞ্জনের স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। চা খাওয়ার ফাঁকে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করি। এক পর্যায়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা বললে তারা কিছুতেই বিদায় দিল না। অনেকটা জোর করেই আমাকে রেখে দিল। সন্ধ্যার পর নিরঞ্জনের সঙ্গে পুরো বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সদর ঘুরে দেখি। দেশে যে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে তা এ উপজেলা সদরের অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। যাই হোক, নিরঞ্জনকে এতদিন পরে পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করি। রাতের খাবারের মেন্যুতে ছিল নানা জাতের দেশি মাছ। বৌদির হাতে রান্না করা এই দেশী মাছের স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে। ১০ অক্টোবর সকাল ৬টায় নাস্তা খেয়ে নিরঞ্জনের বাসা থেকে বিদায় নেই। নিরঞ্জন আমাকে সিএনজি অটোরিকশায় তুলে দিয়ে যায়। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে সিএনজি অটোরিকশা বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সীমান্তে কড়ইকান্দি ফেরিঘাটে গিয়ে থামে। ফেরিতে মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে আড়াই হাজার উপজেলা সীমান্ত থেকে আরেকটি সিএনজি অটোরিকশায় করে ৪০ মিনিটে গাউছিয়া গিয়ে নামী। সেখান থেকে ভাড়া করা প্রাইভেট কারে মাত্র ১৫ মিনিটে পূর্বাচল ৩০০ ফিট রাস্তা হয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় চলে আসি। বাসায় আসার পর সবাই জানতে চায় এত তাড়াতাড়ি কি করে বাঞ্ছারামপুর থেকে চলে এলাম। আমি বিকল্প পথে ঢাকা আসার বর্ণনা দিলাম। -শরীফুল ইসলাম
×