রাজন ভট্টাচার্য ॥ তিন দফায় নয় বছর থেকে অটোরিক্সার ইকোনমিক লাইফ কাগজে-কলমে ১৫ বছর বাড়ানোর হয়েছে। এবার আবারও ছয় বছর বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছেন মালিকরা। আগামী ডিসেম্বরে অটোরিক্সার সর্বশেষ মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। মালিকরা বলছেন, আন্দোলন করেই দাবি আদায় করা হবে। যদিও পরিবহন বিশ্লেষক, বুয়েটের পরিবহন ইঞ্জিনিয়ার ও আমদানিকারকরা বলছেন, সরকার ও যাত্রীদের জিম্মি করে গাড়ির লাইফ বাড়ানো হলেও আদতে যাত্রীরা বঞ্চিত হবে পরিবহন সেবা থেকে। অটোরিক্সাগুলো বর্তমানে যে অবস্থায় আছে তাতে ইকোনমিক লাইফ বাড়ানোর কোন যৌক্তিকতা নেই। আবারও মেয়াদ বাড়ানো হলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে। এমন বাস্তবতায় নতুন অটোরিক্সা রিপ্লেসমেন্ট দেয়াই একমাত্র সমাধান।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, বিষয়টি নিয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের আপত্তির মুখেও চলতি সপ্তাহেই এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলেও একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে গাড়ির মেয়াদ শেষে ইঞ্জিন পরিবর্তন করার অনুমতি দেয়া মানেই মোটরযান অধ্যাদেশের পুরোপুরি পরিপন্থী। এ দৃষ্টান্ত স্থাপন হলে অন্য পরিবহনগুলোর মেয়াদ শেষে বাড়ানোর দাবি উঠবে। ২০১৩ সালে বুয়েটের পরীক্ষার বাইরে থেকে গেছে অনেক অটোরিক্সা।
জানতে চাইলে বিআরটিএ কর্মকর্তা শওকত আলী বলেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব যোগ দিয়েছেন। আশা করি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা আসবে। তিনি বলেন, আমি মনে করি যাত্রী নিরাপত্তার বিষয়টিতে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থে অনেকেই অনেক দাবি-দাওয়া জানাতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে মানুষের স্বার্থ সবার আগে। যদি অটোরিক্সা চলাচলের অযোগ্য হয় তাহলে সেগুলোর নতুন করে মেয়াদ বাড়ানো ঠিক হবে না বলেও মত দেন তিনি।
এদিকে আটোরিক্সার মেয়াদ বাড়ানোর নামে মালিকদের কাছ থেকে ‘অটোরিক্সা মালিক শ্রমিক ঐক্যজোট’-এর ব্যানারে চাঁদা তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাশাপাশি পরিবহনটির ইকোনমিক লাইফ বৃদ্ধি না করতে আন্দোলনে নেমেছে শ্রমিকদের একটি অংশ। অর্থাৎ এ ইস্যুতে মালিক-শ্রমিকপক্ষ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সাধারণ যাত্রী ও চালকরা বলছেন, আন্দোলনের মুখে তিনবার অটোরিক্সার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। মালিক সমিতি সরকারকে জিম্মি করে প্রতিবারই অনৈতিক কাজে সফল হচ্ছে। এবারও আন্দোলনের মাধ্য দিয়ে তারা সফল হতে চায়।
পরিবহন চালকরা বলছেন, পুরনো গাড়ির ইঞ্জিন ও চ্যাসিস দুটিই এখন ড্যামেজ। প্রায়ই অটোরিক্সাগুলো চলা অবস্থায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নতুন ইঞ্জিন লাগানো হলে গাড়ির শক্তি বাড়বে। এতে দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। তাছাড়া মোটরযান অধ্যাদেশে মেয়াদের ভেতরে ইঞ্জিন পরিবর্তন করা যায়। মেয়াদ শেষে ইঞ্জিন পরিবর্তন করা মানেই আইনের ব্যত্যয় ঘটানো।
জানা গেছে, ২০০২ ও ২০০৩ মডেলের প্রায় ২৬ হাজার সিএনজি অটোরিক্সার কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় গাড়িগুলো চলতে পারবে না। বিআরটিএ পরিচালক মাহবুব ই ইলাহী বলেন, আমরা নতুন গাড়ি নামানোর পক্ষে। ইঞ্জিন নতুন হোক বা পুরনো হোক সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। গাড়ি রিপ্লেসমেন্ট করলেই সব সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
সিএনজি অটোরিক্সা মালিক সমিতির সভাপতি বরকম উল্যাহ বুলু বলেন, অটোরিক্সার ইকোনমিক লাইফ বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক। দাবির যথার্থতা আছে বলেই আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি যেন আমাদের দাবি-দাওয়া মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। আশা করি আগামী এক থেকে দুই দিনের মধ্যে সমস্যা সমাধানে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণা আসবে। আমরা সে অপেক্ষায় আছি। ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত না এলে আমাদের ধর্মঘটে যাওয়া ছাড়া কোন পথ নেই বলেও জানান তিনি। আমরা মেয়াদ শেষ হওয়া গাড়িগুলোতে সিলিন্ডার যুক্ত করে চালাতে চাই।
সম্প্রতি সিএনজি অটোরিক্সার ইকোনমিক লাইফ ছয় বছর বৃদ্ধিসহ সরকারের কাছে ১০ দফা দাবি জানিয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। অন্যথায় চলতি মাসেই ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। তারা বলছেন, গাড়িগুলোর সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ মানুষ। বন্ধ হলে চালকরা বেকার হয়ে পড়বে। অটোরিক্সার সংখ্যাও অর্ধেকে নেমে আসবে। ফলে যাত্রী ভোগান্তি ও পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে।
তারা বলছেন, প্রায় এক বছর আগে ইঞ্জিন প্রতিস্থাপন ও গ্যাস সিলিন্ডার পরিবর্তনের মাধ্যমে বুয়েট, চুয়েট ও মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) মতামতসাপেক্ষে সিএনজি অটোরিক্সার ইকোনমিক লাইফ ছয় বছর বৃদ্ধির দাবি করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) থেকে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। নানা রকম টালবাহানা ও সময় পার করে আমাদের শেষ পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ২৬ হাজার সিএনজি অটোরিক্সা রিপ্লেসমেন্ট করতে খরচ পড়বে ১৩ হাজার কোটি টাকা। ইকোনমিক লাইফ বৃদ্ধি করলে ব্যয় হবে ৩৬০ কোটি টাকা। এতে বিপুল পরিমাণ টাকা বেঁচে যাবে। দাবি মানা না হলে আগামীকাল ১৮ ও ১৯ অক্টোবর ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করা হবে।
এর আগে ২০১৩ সালেও রাজধানীতে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিক্সার ‘ইকোনমিক লাইফ টাইম’ বাড়ানোর দাবিতে ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘট ডাকার হুমকি দিয়েছিল সিএনজি অটোরিক্সা মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদ।
রাজধানীর বায়ুদূষণ কমাতে দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিক্সার পরিবর্তে চার স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিক্সা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবেই ২০০২ সালে রাজধানীর রাস্তায় নামে সবুজ রঙের সিএনজিচালিত অটোরিক্সা।
বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, যেগুলো এখন আর চলাচলের যোগ্য নয় সেগুলো বাদ দিতে হবে। যেগুলো এখন ভাল আছে সেগুলো রাখা যেতে পারে। তিনি বলেন, পরীক্ষা করলে দেখা যাবে প্রায় ৫০ ভাগের বেশি অটোরিক্সা এখন চলাচলের উপযোগী নয়।
অটোরিক্সা শ্রমিক সংগঠনের নেতা জাকির হোসেন বলেন, নতুন ইঞ্জিনের কম্পনে পুরনো গাড়ির ক্ষতি হতে পারে। তাই আমরাও চাই না যাত্রী ও চালকরা ঝুঁকির মধ্যে থাকুক। এজন্য আমরা চাই মেয়াদ শেষ হওয়া গাড়িগুলো রিপ্লেস করা হোক। তিনি বলেন, মেয়াদ শেষে গাড়ির ইঞ্জিন পরিবর্তন করা মোটরযান আইনের পরিপন্থী। মালিকদের দাবি মেনে যদি অটোরিক্সার মেয়াদ বাড়ানো হয তাহলে ভবিষ্যতে অন্যান্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও মালিকরা এমন দাবি জানাবেন। তাছাড়া মেয়াদ ছাড়া গাড়ি পরিবেশ দূষণ করছে বলেও জানান এ শ্রমিক নেতা।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: