আতাউর রহমান ॥ রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর জাতিগত নিধনের দায়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তার সদস্য রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান, জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এছাড়াও দেশটির সঙ্গে সব ধরনের কার্যকর প্রতিরক্ষা সহযোগিতা পর্যালোচনা করে দেখা হবে বলেও জানানো হয়েছে।
লুক্সেমবার্গে সোমবার ইইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বৈঠকে পাস হওয়া প্রস্তাবে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর বল প্রয়োগের আলোকে ইইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সদস্য রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান ও জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের সব ধরনের আমন্ত্রণ স্থগিত রাখবে। বৈঠকে মোট আটটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
অভ্যন্তরীণ নির্যাতন ও নিপীড়নে ব্যবহারের আশঙ্কায় ইইউ বর্তমানে মিয়ানমারে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রফতানি বন্ধ রেখেছে। ২৭ দেশের সংস্থাটি মিয়ানমারকে সতর্ক করে বলেছে, তারা যদি পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটায় তবে আরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এছাড়া রাখাইনে অব্যাহত অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়েছে ইইউ। তারা সকল পক্ষের কাছে সহিংসতার অবসান ও সমান গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের সুরক্ষার আহ্বান জানায়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়ে তাদের সঙ্গে সংলাপে বসতে মিয়ানমারকে উৎসাহিত করা হয়েছে। প্রতিবেশীসুলভ আচরণের মাধ্যমে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বসতবাড়িতে প্রত্যাবাসনেরও আহ্বান জানানো হয়। এই কঠিন পরিস্থিতেও গঠনমূলক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করা হয়েছে।
ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেডেরিকা মগেরিনির সভাপতিত্বে বৈঠকে জার্মানির অর্থনীতি ও জ্বালানিবিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও ভাইস চ্যান্সেলর সিগমার গ্যাব্রিয়েল, বেলজিয়ামের উপপ্রধানমন্ত্রী দিদিয়ের রেনডার্স, বুলগেরিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী ইকাতেরিনা জাহারিয়েভা, ক্রোয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী মারিজা পেজচিনোভিচ বুরিক, চেক প্রজাতন্ত্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আইভো স্রামেক, ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেস স্যামুয়েলসেন, ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ ইভস দ্রিয়াঁ, এস্তোনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্ভেন মাইকসের ছাড়াও স্পেন, ইতালি, সাইপ্রাস, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, হাঙ্গেরি ও নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মাল্টার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আয়ারল্যান্ড ও গ্রিসের স্থায়ী প্রতিনিধিরা ছিলেন।
সোমবারের বৈঠকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, স্থলমাইনের ব্যবহার, যৌন নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে ইইউ। তাতে বলা হয়, এই সহিংসতা অগ্রণযোগ্য এবং তা অবশ্যই অবিলম্বে থামাতে হবে।
হত্যাসহ নির্বিচারে হামলা ও ভয়-ভীতি প্রদর্শনের কারণে ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। প্রস্তাবে বলা হয়, যখন এত বেশি লোক পালিয়ে আসে, তখন বুঝতে হবে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের নিজেদের জায়গা জমি থেকে উচ্ছেদ করে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য এটি একটি পরিকল্পিত কর্মসূচী।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়, যেহেতু মানবিক সহায়তা সেখানে দেয়া যাচ্ছে না এবং গণমাধ্যমের কোন প্রবেশাধিকার নেই, তাই সেখানে সত্যিকারের প্রয়োজন তা সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া, সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
আগামী মাসে মিয়ানমারে অনুষ্ঠেয় আসেম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের পাশাপাশি রোহিঙ্গা বিষয়ে গঠনমূলক আলোচনার ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ রাখবে। এছাড়া, আসিয়ান জোটভুক্ত ১০টি দেশের মধ্যে যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশীদার তাদেরও এ বিষয়ে যুক্ত হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয় প্রস্তাবে।
এতে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে মানবিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবস্থা শোচনীয়। সেখানে ধারাবাহিকভাবে গোলাগুলি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সহিংসতা ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতির পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য এবং এর তাৎক্ষণিক অবসান হওয়া দরকার।
প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছে ইইউ। এছাড়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে দরকারি পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
এতে জানানো হয়, জাতিসংঘ, আইসিআরসিসহ সব আন্তর্জাতিক বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে শর্তহীন পূর্ণ প্রবেশাধিকার দিতে হবে। যারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে, তাদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায়, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণভাবে ফিরিয়ে আনতে বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবিক প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। এরই মধ্যে ধাপে ধাপে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে মানবিক সহায়তা দেয়ার কাজ করছে ইইউ এবং এর পরিধি রাখাইন রাজ্যেও বিস্তৃত করার জন্যও সংস্থাটি প্রস্তুত রয়েছে।
প্রস্তাবে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী মিশনকে অবিলম্বে দেশটিতে নিরাপদে প্রবেশ করতে দিতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল সম্প্রতি অনুসন্ধানী মিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর নির্দেশ দেয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানায় ইইউ।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অন্যান্য অপরাধমূলক কাজের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার যে প্রতিশ্রুতি দেশটির নেত্রী আউং সান সুচি দিয়েছেন, তার সে বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে ইইউ। ইইউ বলেছে, শিশুদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক অভিযোগগুলোর বিস্তারিতভাবে তদন্ত করা উচিত।
কানি ও শান রাজ্যের মানবিক পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইইউ। সেখানেও মানবিক সহায়তা ও প্রবেশাধিকার দিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
২০০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা স্থগিত ॥ ইতোমধ্যে মিয়ানমারকে উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে দেয়া দুইশ’ কোটি ডলারের ঋণ স্থগিত করেছে বিশ্বব্যাংক।
এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, মিয়ানমারের জন্য সম্প্রতি অনুমোদিত উন্নয়ন সংক্রান্ত ঋণ সহায়তার শর্ত আমরা মূল্যায়ন করে দেখেছি। এই ঋণ কার্যকর করতে দেশটিতে সার্বিক পরিস্থিতির আরও অগ্রগতি দরকার বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক সবার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে বৈষম্যহীন মৌলিক নীতিমালা বাস্তবায়নের ওপর অঙ্গীকারাবদ্ধ। এরআগে বিশ্বনেতারা বলেছে, রাখাইনে সহিংসতা, রোহিঙ্গাদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ ও তাদের বল প্রয়োগে বাস্তুচ্যুত করায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
বিশ্বব্যাংক জানায়, বড় ধরনের ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সকল নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে অন্তুর্ভুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, বিদ্যুত ও গ্রামীণ সড়ক উন্নয়নের কথা বিবেচনা করা হয়। এসব বিষয় মাথায় রেখেই মিয়ানমারের সঙ্গে ঋণচুক্তি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
বিশ্ব ঋণদাতা সংস্থাটি জানায়, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সমন্বয় করা হচ্ছে। রাখাইনে সহিংসতা হ্রাস ও ব্যাপকভাবে মানবিক সহায়তার প্রবেশে সাড়া দিতে আমরা দেশটিকে উৎসাহিত করে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত ও পালিয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের বাসস্থানে ফিরিয়ে আনার পথ প্রস্তত করার বিষয়ে আমরা গুরুত্বারোপ করছি।
বিশ্বব্যাংক আরও জানায়, শারণার্থী, তাদের আশ্রয়দাতা দেশের সমর্থনে কর্মসূচী দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।
এদিকে চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত একটি দৈনিক জানায়, ভারত ও চীন যৌথভাবে মানবিক সহায়তার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনের উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে পারে। গ্লোবাল টাইমস নামের ওই দৈনিকটি জানায়, মিয়ানমারের সঙ্গে বেজিং ও দিল্লীর স্বার্থের জন্যই রাখাইনে মানবিক সহায়তায় তাদের এগিয়ে আসা দরকার। মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশকেও সাহায্য করা উচিত।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এক বৈঠকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাইং রোহিঙ্গা মুসলিমরা মিয়ানমারের স্থানীয় বাসিন্দা নন বলে দাবি করেছেন।
বৈঠকে হ্লাইং উত্তর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর তার বাহিনীর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ সম্পর্কে কিছু বলেননি এবং বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়িয়ে বলার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা আছে বলে অভিযোগ করেছেন।।