ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের শাপলাবিল

পাতার ফাঁকে সূর্যেরআভা, অবারিতসৌন্দর্য

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

পাতার ফাঁকে সূর্যেরআভা, অবারিতসৌন্দর্য

খোকন আহম্মেদ হীরা লাল শাপলা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অহঙ্কার। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই লাল শাপলার সমারোহ দেখতে কার না ভাল লাগে। কিন্ত এই ভাল লাগা-ভালবাসায় পরিণত হলে আপনাকে বরিশালের মায়ায় জড়াতে হবে। রূপসী বাংলার এই রূপের খোঁজে শহর ছাড়িয়ে উজিরপুর উপজেলার সাতলা নামকস্থানে প্রাকৃতিকভাবে শাপলার অবারিত রঙিন রূপ আপনাকে শুধু মুগ্ধ নয়, স্তম্ভিত করে দেবে। সাতলা বিলের ফুটন্ত শাপলা দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে সকালে। এ জায়গাটি ‘শাপলা বিল’ নামেই বেশি পরিচিত। চারপাশে গাঢ় সবুজের পটভূমিতে এ যেন বাংলাদেশের এক ‘লাল স্বর্গ’। একসময় বর্ষাকালে সস্পূর্ণ ডুবে যেত সাতলার বিল। স্বাধীনতার পর তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত প্রথমে সাতলায় বাঁধ দেয়ার কাজ শুরু করেন। এরপর থেকেই বিলের বিশাল এলাকা মনোরম এলাকায় পরিণত হয়। এই বিলে প্রাকৃতিকভাবেই শাপলা ফোটে। সাধারণত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে এই বিলে লাল শাপলা ফুল ফোটে। তখন নৌকা নিয়ে এই বিলে যাওয়া আরেক প্রাপ্তি। এ বিলে শুধু শাপলাই ফোটে না, শীতের মৌসুমে যখন পানি কমে যায় তখন সব শাপলা মরে যায়। ওই সময় কৃষকরা এখানে ধান চাষ করেন। একই সঙ্গে ধান ও শাপলার এই সহাবস্থান আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। সাতলার এ বিল তাই অনন্য। দূর থেকে সবুজের মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র লাল ও সাদা বৃত্ত দেখে দুরূহ হয়ে ওঠার মতো, আসলে জিনিসগুলো কি? দূরত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে একসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ফুলের অস্তিত্ব। আগাছা আর লতাপাতায় ভরা বিলের পানিতে সহ¯্র লাল ও সাদা শাপলা। সূর্যের সোনালি আভা শাপলা পাতার ফাঁকে ফাঁকে পানিতে প্রতিফলিত হয়ে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় এর সৌন্দর্য। বিলের লাল শাপলার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে আপনা থেকে চোখ জুড়িয়ে যায়। মনোমুগ্ধকর এ বিলের শাপলা দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্নস্থান থেকে ছুটে আসছেন ভ্রমণপিপাসু প্রকৃতিপ্রেমীরা। এ বিলের শাপলাকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে বিজ্ঞাপন চিত্র। ফলে দিন দিন দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠছে ‘শাপলার বিল’। বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের উত্তর সাতলা, পার্শ্ববর্তী আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা ও খাজুরিয়া গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে এ বিল এখন স্থানীয়দের কাছে শাপলার বিল নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। বিলের মোট আয়তন সম্পর্কে জানা নেই স্থানীয় কারুরই। কেউ বলেছেন কয়েক শ’ হেক্টর, আবার কেউ দাবি করেন কয়েক হাজার বিঘা নিয়ে এ বিল। শাপলার বিলে ঠিক কত বছর আগ থেকে এভাবে শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে সে তথ্যও দিতে পারেননি কেউ। তবে আশপাশের গ্রামের ষাটোর্ধ কয়েক ব্যক্তি বলেন, তাদের জন্মের পর থেকেই এ বিলে এভাবে শাপলা ফুটতে দেখছেন তারা। বছরের অধিকাংশ সময় জলমগ্ন এ বিলে লাল,সাদা ও বেগুনি রঙের তিন ধরনের শাপলা জন্মালেও লাল শাপলার আধিক্য চোখে পড়বার মতো। বিলের যত ভেতরে এগুতে যাবেন ততই লালের আধিক্য। একসময় মনে হবে শাপলার রাজ্যে বন্দী হয়ে আছেন আপনি। আশপাশ দিয়েই একটু পরপরই শাপলা গাছ ও আগাছা ঠেলে নৌকা নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এদের অনেকেই বিল থেকে শাপলা তুলে জমা করছেন নৌকায়। এ বিলের শাপলা তুলে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ওই এলাকার অসংখ্য পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন। স্থানীয়রা জানান, বাজারে সাদা শাপলার কদর বেশি। লাল শাপলার কদর থাকলেও এটি রান্না করতে অতিরিক্ত ঝামেলা পোহাতে হয়। লাল শাপলা সরাসরি রান্না করার পরও কিছুটা কালচে রং থাকে। তাই রান্নার আগে এটিকে সিদ্ধ করে নিতে হয়। বিল সংলগ্ন গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন, বছরের ছয় মাস তারা অনেকেই এই বিলের শাপলার ওপর নির্ভরশীল। এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছেন এলাকার কয়েক শ’ পরিবার। এদের কেউ শাপলা তুলে, কেউবা বিল থেকে মাছ শিকার করে বাজারে বিক্রি করেন। বিল সংলগ্ন পশ্চিম খাজুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা রমেশ ঘরামী ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে প্রতিদিনই বিলের পানিতে মাছ শিকার করেন। শাপলার বিল হওয়ায় এখানে খাদ্যের বেশ যোগান থাকায় দেশী প্রজাতির মাছও ধরা পড়ে প্রচুর। দক্ষিণ বাগধা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর জব্বার জানান, তিনি মূলত অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করেন। তবে বছরের ছয়মাস এ বিলে পানি থাকায় চাষাবাদের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ওই সময় তিনি বিল থেকে শাপলা তুলে বাজারে বিক্রি করে সাত সদস্যের সংসার পরিচালনা করছেন। তিনি জানান, ১৫ থেকে ২০টি শাপলা একত্রে আঁটি বেঁধে পাঁচ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। তিনি প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় শ’ টাকা আয় করেন। এ বিলের শাপলা বরিশাল, পিরোজপুর, ফরিদপুর জেলার বিভিন্নস্থানের হাট ও বাজারে সরবরাহ করা হয়। স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন দেশের বিভিন্নস্থান থেকে ভ্রমণপিপাসুরা শাপলার বিলে এসে এখানকার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে ক্যামেরাবন্দী করে নিচ্ছেন। সম্প্রতি এ শাপলার বিলে একটি নামী-দামী কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনের কাজও করেছেন।
×