ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোপাল মজুমদার

লালন সাঁইজির দর্শন এবং আমাদের দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

লালন সাঁইজির দর্শন এবং আমাদের দায়বদ্ধতা

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ লেখার শিরোনামটি চোখে পড়লেই এক বিশুদ্ধ অনুভূতি, আধ্যাত্মিক চিন্তা ও প্রেমে পাঠকদের হৃদয়-মন পুলকিত হয়ে ওঠে। হৃদয়-মন পুলকিত করা দশ হাজারেরও বেশি গান রচনা করে গেছেন মহাত্মা লালন সাঁই (১৭ অক্টোবর, ১৭৭৪-১৭ অক্টোবর, ১৮৯০)। লালন সাঁইজির প্রকৃত নাম ললিত নারায়ণ কর, ডাকনাম লালু। পিতা মাধব কর, মাতা পদ্মাবতী। তাঁর গানগুলোর মধ্যে আছে দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, ভক্তিতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব; আছে নবীজি, কৃষ্ণ, যীশু, বেদ, কোরান, বাইবেল প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত জিজ্ঞাসা, মতামত, উত্তর এবং নির্দেশনা। এ সঙ্গীতনির্ভর চিরন্তন দর্শনই লালনকে ফকির লালন থেকে মহাত্মা লালনে উন্নীত করেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে সুফিবাদী দর্শনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছেন লালন সাঁই। লালন দর্শনের মূল কথা হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার ওপর মানুষ; এ বিশ্বব্রহ্মা-ের যিনি স্রষ্টা তিনি বিরাজ করেন এ মানুষের অন্তরে। তাই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-কালো-সাদা বৈচিত্র্যে মানুষকে আলাদা না করে মানুষে মানুষে প্রেম ও ভালবাসার মাধ্যমেই পরম আরাধ্য স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা সম্ভব। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান-জৈন প্রভৃতি আকৃতিতে বিচার করলে সমাজে শান্তি কখনোই আসবে না বলে তাঁর বিশ্বাস। শুধু তাঁরই নয়, আধুনিক সভ্যতার সকলেরই বিশ্বাস যে, মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করে ভালবাসার মধ্যেই বিশ্ব শান্তি নিহিত। তাই প্রায় দেড় শতাব্দী পূর্বে লালন সাঁই যে ভাব-চিন্তার পত্তন করে গেছেন তা আজও পৃথিবীর প্রেমিক, ভাবুক, রসিক, শিক্ষিত, বিদ্বৎ সমাজকে প্রাণিত করছে এবং করে যাবে আরও সুদীর্ঘকাল। কারণ, হিংসা-বিদ্বেষ-বিভেদমুক্ত সমাজ-রাষ্ট্র তথা পৃথিবী বিনির্মাণে লালন দর্শন এক অনন্য আলোকবর্তিকা। ড. আনোয়ারুল করীমের মতানুসারে বাউল শব্দের উৎসভূমি পারস্য। তিনি বলেছেন, ‘মরুভূমিতে এখানে-সেখানে বিচরণকারী সংসারত্যাগী একশ্রেণীর সঙ্গীতাশ্রয়ী সুফি সাধক ‘আল’ অথবা ‘বউল’ নামে পরিচিত ছিল। এরা অধ্যাত্মবাদী এবং এদের সাধন পদ্ধতি ছিল গুপ্ত ও যৌনাচারভিত্তিক। আমাদের আলোচ্য বাউল সম্প্রদায় পারস্যের এই ‘আল’ বা ‘বউল’ সম্প্রদায়ের উত্তরসূরি’ (করীম, পৃ:-৩০)। বাউল শব্দের বাংলায় প্রথম ব্যবহার বিষয়েও তিনি ভিন্ন মত পোষণ করে বলেছেন, ‘চতুর্দশ শতকে শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জোলেখা’ গ্রন্থে সর্বপ্রথম এই ধর্মীয় সাধকদের ‘বাউল’ এবং ‘বাউর’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে’ (প্রাগুক্ত)। বাউল শব্দের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস যাই হোক সবক্ষেত্রেই এটা একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এ ব্যাপারে কারও কোন দ্বিমত নেই। অর্থাৎ বাউল বলতে এমন এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টিকে বোঝায় সমাজের চোখে যারা অত্যন্ত নিচ, নিঃস্ব এবং পাগল। তাদের কোন সামাজিক মর্যাদা নেই, বিষয় সম্পত্তি বা সামাজিক প্রতিপত্তি বলতে কোন কিছুই নেই। তাদের কোন স্থায়ী বসতবাড়ি নেই। তারা এক স্থান হতে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং পরান্নে জীবনধারণ করে বেঁচে থাকে। বাউল যে সমাজেরই হোক তার বৈশিষ্ট্য, জীবনযাপন প্রণালী, সমাজে তার সামাজিক অবস্থান একই। ড. আনোয়ারুল করীম তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার বাউল’ গ্রন্থে বলেন, ‘একশ্রেণীর সাধক যারা ‘ফকির’ বলে পরিচিত এবং পেশায় ভিক্ষাজীবী, সাধনসঙ্গিনী নিয়ে এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে গান গেয়ে ফেরে, সমাজে যাদের পরিচয় অতি সাধারণ, অর্থাৎ যারা অন্ত্যজ, তাদের বাউল বলা হয়ে থাকে। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেখানে তারা সামাজিকভাবে নিন্দিত’। দুই ধরনের বাউলের কথা গবেষকদের কাছ থেকে জানা যায় সংসারী বাউল ও গৃহী বাউল। উৎপত্তিগতভাবে বাউল শব্দ দিয়ে যে সংসারত্যাগী, উদাসীন, ভাবোন্মাদ, ক্ষ্যাপা বাউলকে বোঝানো হয়েছে, সমাজে যাদের সামাজিক অবস্থান, প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বিন্দুমাত্র ছিল না; যারা সাধনসঙ্গিনী নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াত ও গান গেয়ে পরান্নে জীবন ধারণ করত। তাদের জীবনাচরণের সঙ্গে লালন সাঁইজির জীবনাচরণের বিস্তর ফারাক। সাঁইজি পুরোদস্তুর সংসারী লোক ছিলেন। তাঁর পানের বরজ, আমের বাগান, বসতবাড়ি, নগদ টাকা, চলাচলের বাহন হিসেবে দুটি ঘোড়া এবং স্ত্রী, সন্তান (পালক কন্যা) ছিল, যা পুরোপুরি বাউল জীবনের সঙ্গে বেমানান। সমাজে লালন শাহের সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিপত্তি প্রায় মধ্যবিত্ত পর্যায়ের ছিল। এ প্রসঙ্গে সুবোধ চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘লালন ফকির নাম শুনিয়াই হয়ত অনেকে মনে করিতে পারেন ইনি বিষয়হীন ফকির ছিলেন; বস্তুত তাহা নহে; ইনি সংসারী ছিলেন, সামান্য জোতজমা আছে; বাটিঘরও মন্দ নহে। জিনিসপত্র মধ্যবর্তী গৃহস্থের মতো, নগদ টাকা প্রায় ২ হাজার রাখিয়া মারা যান’। কোন বাউলের তো নয়ই, সাধারণ গ্রাম্য কৃষকের হাতে এত নগদ টাকা থাকাটা তখনকার সময় অসম্ভব। লালন শাহ জীবিত থাকাকালীন ঘোড়ায় চড়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচল করতেন। লালন সাঁইয়ের সময় গ্রামবাংলায় ঘোড়া ও পালকি অভিজাত বাহন হিসেবে গণ্য হতো। গ্রামীণ সমাজের সাধারণ কোন গ্রামবাসীর পক্ষে ঘোড়ায় চড়ে চলাফেরার বিলাসিতা করার কোন নজির নেই। কোন বাউলের ঘোড়ায় চড়ার নজির তো নেই-ই। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লালন গবেষক মোঃ সোলায়মান আলী সরকার তার ‘লালন শাহের মরমী দর্শন’ গ্রন্থে বলেন, ‘যিনি ঘোড়ায় চড়ে দেশ-বিদেশে ধর্ম প্রচার করেন, তিনি বাউল নন। বাউলরা একতারা হাতে হেঁটে গান গেয়ে বেড়ান। দীর্ঘকাল অনুসন্ধান করে কোন বাউলকে ঘোড়ায় চড়ে ধর্ম প্রচার করতে দেখা যায়নি।’ লালন সাঁই তাঁর পালক পিতা মওলানা মলম শাহ সূত্রে পাঁচ একর বসতবাড়ির ভিটা লাভ করেন, যেখানে লালন শাহ তাঁর আখড়াবাড়ি স্থাপন করেন এবং বর্তমানে যেখানে তাঁর মাজার অবস্থিত। এ ছাড়াও তিনি তাঁর জীবদ্দশায় পাঁচ বিঘা জমি কিনেছিলেন। ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে শৈলকুপা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে লালন শাহের অনুকূলে দুটি দলিল সম্পাদিত হয়। যাতে তাঁকে ‘মান্যবান ও সম্ভ্রান্ত মনুষ্য’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশিষ্ট লালন গবেষক মুহম্মদ আবু তালিবের নিকট দলিল দুটির নকল কপি রক্ষিত আছে। তাঁর ঘরবাড়ির অবস্থাও গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ছিল। লালন শাহ সমাজে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সমাজের অনেক গণ্যমান্য ও প-িত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল এবং তারা লালন শাহের সঙ্গে মতবিনিময় করে নিজেদের উৎকর্ষিত করে তুলেছেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন ভারতের ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা ও বিশিষ্ট প-িত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি তার জমিদারিতে লালন সাঁইজিকে ডেকে নিয়ে ধর্মালাপে তৃপ্ত হতেন। এ প্রসঙ্গে মোঃ সোলাইমান আলী সরকার তার ‘লালন শাহের মরমী দর্শন’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘বঙ্গের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এমনকি ব্রাহ্মধর্ম রচয়িতা, সমাজ সংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক, রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁকে নিমন্ত্রণ করে শিলাইদহে নৌকায় নিয়ে ধর্মালাপে পরিতৃপ্ত হন’। এসব দিক বিশ্লেষণ করলে সমাজের চোখে তিনি অন্ত্যজ, বাতুল এবং ক্ষ্যাপা হিসেবে পরিগণিত হওয়ার কথা নয়। সুতরাং বাউল শব্দের শাব্দিক অর্থে এবং সামাজিকভাবে বাউল বলতে আমরা যা বুঝি না কেন লালন শাহ অবশ্যই সেই অর্থে বাউল ছিলেন না। শ্রী সনৎকুমার মিত্র সম্পাদিত ‘বাউল লালন রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে ‘গ্রাম্য সাহিত্য’ প্রবন্ধে সুবোধ চন্দ্র মজুমদার লালন সাঁইজির ধর্মবিশ্বাস ও সামাজিক জীবনের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেন, ‘ফকির লালনের ধর্মজীবন বিলক্ষণ উন্নত ছিল। মিথ্যা জুয়াচুরিকে লালন ফকির বড়ই ঘৃণা করিতেন’ (মিত্র; পৃ:-১০১)। লালন শাহের গানেও মিথ্যা ও জুয়াচুরি এবং পর রমণীর প্রতি লোভকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়েছে। লালন বলেন, ‘সত্য বল, সুপথে চল ওরে আমার মন/সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন/পরের দ্রব্য পরের নারী/হরণ করো না পারে যেতে পারবা না/যতবার করিবে হরণ/ততবারই হবে জনম’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনকে শুধু কবি বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি লালনের কবিতাকে (গান) বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলির কবিতার সমতুল্য বলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি লালনকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁকে উপনিষদের ঋষিদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘The village poet evidently agrees with our sage of Upaneshad who says that our mind comes back baffled in its attempt to reach the unknown Being; and yet this poet like the ancient sage does not give up adventure of the infinite thus implying that there is a way to its realisation. (লোককবি লালন-তপন কুমার বিশ্বাস; পৃ:-৪৮)। লালন দর্শনে বিমোহিত কবিগুরু তাই বলছেন-‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত’। অনেক সাধক সাধনার নামে ঘর ছেড়ে সংসারত্যাগী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। লালন তাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘ঘরে কি হয় না ফকিরী/কেন রে নিমাই হলি দেশান্তরি/বলে এই কথা কান্দে শচী মাতা/লালন বলে লীলের বলিহারি’। সাধন-ভজনের পথে অনেকে নারীকে বাধা মনে করে নারীসঙ্গ ত্যাগ করার পক্ষপাতী হয়েও সংসার বিবাগী হয়। তাদের উদ্দেশ করে লালনের প্রতিবাদ, ‘কেউ নারী ছেড়ে জঙ্গলে যায়/স্বপ্নদোষ কি হয় না সেথায়/আপন মনের বাঘে যারে খায়/কে ঠেকায় রে’। সুতরাং লালন ব্যক্তি জীবনে ও আদর্শগতভাবে কোন প্রকারেই সংসার বিবাগী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না; বরং তিনি একজন সচেতন সমাজকর্মী ছিলেন। সমাজের উন্নয়নের জন্য, সমাজের মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তাই তাঁর দর্শনজুড়ে কেবলই মানুষের জয়গান, মানবমুক্তির আকুতি। তিনি এই মানুষের বাইরে আর কিছুই বুঝতেন না। তাঁর ধর্মকর্ম, ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল মানুষকেন্দ্রিক। তাঁর মতে ঈশ্বর যদি থেকেই থাকে তবে এই মানুষের মধ্যেই আছে। তাই লালন বলেন, ‘এই মানুষে আছেরে মন/যারে বলে মানুষ রতন।’ তিনি যেমন একজন দায়িত্বশীল স্বামী ছিলেন, তেমনি একজন স্নেহপরায়ণ বাবা ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তাঁর রেখে যাওয়া সম্পত্তির কিছু অংশ তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকার (পালক কন্যা) পেরিন্নেসার নামে উইল করে যান। এ তো গেল তাঁর সাংসারিক দায়বদ্ধতার কথা। একজন তীক্ষè সমাজসচেতন সামাজিক আন্দোলনের প্রতিবাদী নেতাও ছিলেন তিনি। সমাজে কোথাও কারও দ্বারা কোন অন্যায় সংঘটিত হলে লালন তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর ভাবশিষ্য ও কাঙাল হরিনাথকে বাঁচানোর কথা তো এখন ইতিহাস। এমন সমাজসচেতন, সংসারী, সামাজিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি যাঁকে বিনা দ্বিধায় সমাজ সংস্কারক বলা যায়, যাঁর সামাজিক আন্দোলন সমাজে এক অপরিহার্য প্রভাব বিস্তার করে সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। লালন সাঁইজিকে প্রথমবারের মতো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ সংবাদপত্রের সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ। ১৮৭২ সালের আগস্ট মাসে তার ‘সাপ্তাহিক গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় ‘জাতি’ নামক এক নিবন্ধে লালন সাঁই এবং তাঁর প্রচারিত ধর্মমতের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে এভাবেই উল্লেখ করা হয়, ‘লালন শা নামে এক কায়স্থ আর এক ধর্ম আবিষ্কার করিয়াছে। হিন্দু-মুসলমান সকলেই এই সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা মাসিক পত্রিকায় ইহার বিশেষ বিবরণ প্রকাশ করিব। ৩/৪ বৎসরের মধ্যে এই সম্প্রদায় অতিশয় প্রবল হইয়াছে।’ (যুক্তবঙ্গে লালন চর্চার ক্রমবিকাশ; সৈয়দ মনসুর আহমদ; পৃঃ-৩৩)। কাঙাল হরিনাথের এই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, লালন সাঁইজি তৎকালীন ঘুণেধরা সমাজকাঠামোতে জোর ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তৎকালীন সমাজব্যবস্থা স্বভাবতই লালনের এই সামাজিক আন্দোলন দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। সামাজিক আন্দোলনের নেতা হিসেবে তৎকালীন সমাজে লালন শাহের একটি অপরিহার্য অবস্থান তৈরি হয়েছিল। লালন প্রভাব তাই ঘুণেধরা সমাজের মৌলবাদী সমাজপতিদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। লালন চর্চার ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর লালন সাঁইজির দেহত্যাগের ১৪ দিন পর মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত পাক্ষিক ‘হিতকরী’ পত্রিকায়। বর্ণিত পাক্ষিক ‘হিতকরী’ পত্রিকায় পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ও এজেন্ট রাইচরণ দাস (মতান্তরে বিশ্বাস) ‘মহাত্মা লালন ফকির’ নামে এক নিবন্ধে লালন সাঁইজির জীবন ও কর্মের ওপর আলোকপাত করেন। উক্ত নিবন্ধে তিনি সাঁইজি সম্পর্কে আমাদের জানান, ‘লালন ফকিরের নাম এ অঞ্চলে কাহারও শুনিতে বাকী নাই। শুধু এ অঞ্চল কেন, পূর্বে চট্টগ্রাম, উত্তরে রঙ্গপুর, দক্ষিণে যশোহর এবং পশ্চিমে অনেকদূর পর্যন্ত বঙ্গদেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বহুসংখ্যক লোক এই লালন ফকিরের শিষ্য। ইহাকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, আলাপ করিয়া বড়ই প্রীত হইয়াছি।’ (লোককবি লালন- তপন কুমার বিশ্বাস; পৃঃ-১৩৬)। এরপর লালন সাঁইজির সামাজিক অবস্থান ও সমাজে তাঁর ব্যক্তি প্রভাব এবং সামাজিক প্রতিপত্তি নিয়ে আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না। লালন শ্রেণী বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিরলস যে সাধনা করে গেছেন তার নিদর্শন হাজারো গানের মধ্যে নিহিত আছে। আমাদের সমাজে উঁচু-নীচু, ধনী-গরিব, নমশূদ্র, সিয়া-সুন্নী প্রভৃতির মধ্যে যে বিভেদ তা দেখে তিনি বলেছেন ‘জাত গেল জাত গেল বলে/একি আজব কারখানা/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/সবই দেখি তানা নানা’। অন্য আর একটি গানে বলছেন- ‘কেউ মালা কেউ তজবী গলায়/তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়/ যাওয়া কিংবা আসার বেলায়/ জাতের চিহ্ন রয় কার রে’? বহুল পরিচিত জাত বিষয়ক আরেকটি গানে লালন বলছেন- ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়/তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়/ লালন বলে জাত কারে কয়/ এ ভ্রম তো গেল না’। লালন বলেছেন দিব্যজ্ঞানী না হলে কেউ তার স্রষ্টা সম্পর্কে সম্যকভাবে জানতে পারে না। মানুষ ভজনা ও মানবসেবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে দিব্যজ্ঞান। কারণ, নিরাকার বিধাতাই যে মানুষের মাঝে সাকার হয়ে ধরা দেয় সাঁইজি তা তুলে ধরলেন এভাবে- ‘সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার/মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/নদী কিংবা বিল বাঁওড় খাল/সর্বস্থলে একই একজন/দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায়/কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার’। লালন সাঁইজির এ গান যেন এক অসীম শক্তির আধার, যার কেন্দ্রে আছে শুধুই মানুষ। মানবতাবোধ যার একমাত্র উপজীব্য। কিন্তু মানবতাবোধে কতজন আমরা নিজেদের উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছি? নাকি নানান ফন্দি-ফিকিরে আমরা মানবতাবোধকে দলিত-মথিত করে চলেছি প্রতিনিয়ত। সমাজ পরিম-লে কি আমরা এমন কোন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছি যেখানে মানবতাবোধকে লালন-পালন করা হয়ে থাকে? এর প্রকৃত উত্তর আমরা নিজেরাই ভালভাবে জানি। আমরা শ্রেণীহীন, শোষণহীন, বৈষম্যহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি বলেই হয়ত সাঁইজির ভাষায় তা ‘কানার হাট-বাজার’। তাই, কানার এ হাট-বাজারে লালনের পরামর্শ ভাবনার জগতে ঢেউ তোলে। সাঁইজি তাই বলছেন ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি’। আবার বলেছেন ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে/পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে’। অনেক পরে হলেও লালন এখন অভিজাত শ্রেণীর আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। বাউলদের শ্রেষ্ঠ ধন লালনকে এখন বিদেশ বিভুঁইয়ের মানুষও জানতে চায়। লালন দর্শনের রস আস্বাদন করতে চায়। বাউল সঙ্গীতের অমৃত সুধা পান করে মানবিক সমাজ বিনির্মাণে প্রয়াসী হতে চায়। পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতিতে লালন দর্শন তাই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে প্রতিটি মানবতাবাদী মানুষের হৃদয়ে। ভেদাভেদ নয়, অভেদ দর্শনই পারে হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে শান্তিময় পৃথিবী বিনির্মাণ করতে, সেটাই লালন ফকিরের গানে ফুটে উঠেছে। তাই লালন দর্শনের প্রচার, প্রসার ও অনুসরণের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম যেন বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয় সেই প্রত্যাশা রইল। ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে আমরা লালনের দেখানো পথ অনুসরণ করলে লোভ-হিংসা-দ্বেষ এবং জাতিগত শ্রেণী বিভেদ ভুলে গিয়ে বাসযোগ্য শান্তিময় পৃথিবী নির্মাণ করতে সক্ষম হবো। লেখক : সাংবাদিক ইমেইল : [email protected]
×