ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

নীল তিমির ফাঁদে

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

নীল তিমির ফাঁদে

ব্লু হোয়েল গেম বা ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ এখন ফেসবুকে ভাইরাল। ভাইরাল না হয়ে উপায় কী বলুন, এ তো শুধু গেম নয়, গোলকধাঁধা। রোমানিয়ান ডাক্তার জন পি টেন্স এই খেলার নাম দিয়েছেন ‘টেরিফিক হোক্স’, যা কিনা সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ঝড় তুলেছে। পিটার টেন্স একে ধাঁধা বলেছেন, কারণ তিনি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, মানুষ কেন এই এই ক্ষতিকর খেলাটি ডাউনলোড করে মিছে নিজের বিপদ ডেকে আনছে! কী আছে এতে! কেনই বা মানুষ বিশেষত কিশোর-কিশোরীরা নীল তিমির ফাঁদে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে পা রাখছে! গুগলসূত্রে জানা যায়, এপ্রিল ২০১৩তে রাশিয়ার এক যুবক যার নাম ফিলিপ বুদেকিন প্রথম ব্লু হোয়েল নামক গেমটি উদ্ভাবন করে। অন্তত দুটো সূত্র বলছে মাত্র বছরখানেক আগে তার নিজ দেশে প্রথম এই ভয়ঙ্কর খেলা শুরু হয়। এফ-৫৭ নামের একটি ক্লোজড গ্রুপের ছেলেমেয়েরা নীল তিমির ব্যাপারে ক্রমশ উৎসাহী হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে খোদ রাশিয়ায় প্রায় দু’শতাধিক নীল তিমি খেলুড়ের মৃত্যু ঘটেছে, আর পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে মৃতের সংখ্যা ১৩১। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা এই মৃত্যুর মিছিলে ইতোমধ্যে যোগ দিয়েছি। ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এটি খেলতে গেলে মূলত পঞ্চাশটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ধারাবাহিকভাবে পঞ্চাশ দিনেই খেলা সমাপ্ত হয়। সর্বশেষ ধাপে আছে আত্মহনন। সুউচ্চ ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে হোক দেশে গ্রেফতার হয়েছে একাধিক তরুণ বা গলায় ফাঁস লাগিয়ে! সেক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, যিনি এই খেলার উদ্গাতা তার উদ্দেশ্য আসলে কী! শুরুতে বলা হতো, ব্লু হোয়েল গেম খেললে নাকি মনের জোর বাড়ে। এক একটি ধাপ অতিক্রম করতে গিয়ে খেলুড়েরা নাকি ক্রমশ আত্মবিশ^াসী হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোন ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। বরং যারাই একবার ভয়ঙ্কর এই নীল তিমির ফাঁদে পা রেখেছে, তাদের হয় নিশ্চিত মৃত্যু ঘটেছে বা মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে পার করছে দিন। ফলে ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ এখন আর কোন গেম নয়, মরণনেশা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে বিশ^ময়। প্রশ্ন উঠতে পারে, কারা এই খেলুড়ে? এদের কি কোন শ্রেণীবিভাজন আছে! আছে বৈকি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, টিনেজ অর্থাৎ পনেরো থেকে একুশ- এই বয়সের ছেলেমেয়েরা ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত। সবাই যে এই ভয়ঙ্কর গেম পুরোপুরি শেষ করতে পারে এমন নয়। যাদের আবেগের চেয়ে মস্তিষ্কের জোর বেশি, তারা হয়ত আগেভাগে ভয়ঙ্কর প্রভাব অনুমান করতে পারে এবং সরে আসে। অনেকেই পারে না। কারণ এই খেলার মুখ্য বৈশিষ্ট্যই হলো ব্ল্যাকমেল বা ভয় দেখিয়ে খেলুড়েকে সর্বশেষ ধাপ অবধি টেনে নিয়ে যাওয়া। যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সাক্ষাত মৃত্যু। এখানে বলে রাখা ভাল, ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জের জন্য কিন্তু ইন্টারনেট বা ফেসবুককে দায়ী করার অবকাশ নেই। কারণ যারা নেটে কাজ করেন বা ফেসবুকে অভ্যস্ত, তাদের সকলে এই খেলায় আগ্রহী হয়নি। অনেকটা যেন ইয়াবা বা এই জাতীয় আসক্তির মতো তরুণরা ব্লু হোয়েল গেমের দিকে ধাবিত হয়। এক রকম প্রবল ঔৎসুক্য থেকেই ওরা গেম ডাউনলোড করে। শুরুর দিকে যেসব এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়, তা অনেকটা কিশোর মননের পক্ষে উত্তেজনাকর। এই যেমন মাঝরাতে নিকষ অন্ধকারে কবরখানা বা শ্মশানঘাট ঘুরে আসা। বন্ধুকে অকারণ বোকা বানানো বা লেগপুল করা। শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে হিরো বনে যাওয়া। তারপর অন্যের বান্ধবীকে ভাগিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া। প্রথমে অপেক্ষাকৃত কম চ্যালেঞ্জিং ও মজাদার টাস্ক দিলেও ক্রমশ এর উত্তাপ বাড়ে। কচুপাতা কেটে কেটে যেমন ডাকাত হয়, তেমনি চুনোপুঁটি ধরে যখন খেলুড়েদের হাত পেকে যায়। তারপর শুরু হয় আসল ব্লু হোয়েল গেম। তারা নীল তিমি শিকারেও উদ্যোগী হয়। একটা সাইট থেকে জানা যায়, ভারতের এক স্কুলছাত্রকে বলা হলো তুমি মাঝরাতে স্ট্রিপডান্স বা ন্যাংটোনাচ দেখাও। কাকে দেখাবে! ঘাবড়াও মাত। নিজের ঘরেই দরজা বন্ধ করে তেলাপোকা টিকটিকি ধরে এনে নাচ দেখাও, তার ছবি তোলো, পাঠিয়ে দাও আমাদের কাছে। এই গেমসের যে বা যারা এ্যাডমিনিস্ট্রেটর, তারা এভাবেই খেলুড়েদের এক রকম সম্মোহিত করে ফেলে বা বলা যায় জালে আটকায়। একের পর এক রুচিগর্হিত ও ভয়ঙ্কর কাজ করিয়ে নিয়ে তার ডকুমেন্ট নিজেদের কাছে রেখে দেয়। পরে আর তাদের এ্যাসাইনমেন্টে রাজি না হয়ে উপায় থাকে না। এরপর শুরু করে ব্ল্যাকমেল। অতীতের সব অপকর্মের ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেবে বা নিকটাত্মীয়ের কাছে পাঠাবে বলে শাসায়। এভাবেই শুরু হয় কিশোর মননের টানাপোড়েন। শাঁখের করাতে রক্তাক্ত হতে থাকে অসহায় তারুণ্য। একপর্যায়ে দিশেহারা হয়ে যা নয় তাই করে বসে। ত্রিশতম ধাপের পরেই থাকে নিজেকে শেষ করে দেয়ার উস্কানি। ওরা বলে সুউচ্চ ভবনের ছাদে গিয়ে কিনারা বরাবর হাঁটো, চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাস্তা পার হও, নিজের ডান হাতের চামড়া কেটে নীল তিমির ছবি আঁকো ধারালো কোন ক্ষুর বা ব্লেড দিয়ে। দেখ, তিমিটা দেখতে যেন সুন্দর হয়। ভুলে যেও না যে এটা একটা শিল্পকর্ম। এসব বলে আসল উদ্দেশ্য গোপন করে ব্লু হোয়েল গেমসের নীল-নকশাকারী। প্রসঙ্গত, অস্ট্রিয়ার মনোবিজ্ঞানী টমাস টর্চ মনে করেন, যারা এই ধাঁধার ¯্র্রষ্টা তারা অত্যন্ত নিচু মনের মানুষ। মানবতার ক্ষতি করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। ওরা বিশ^ তারুণ্যকে ভুল পথে পরিচালিত করতে চায়। বস্তুত ওরা ভয়ঙ্কর মনোবৈকল্যের শিকার। এমন নয় যে খেলুড়েরা স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নেয়। খেলার শেষদিকে এসে তারা চরম আস্থাহীনতা ও সঙ্কোচে ভুগতে থাকে। বিবেক জাগ্রত হয়, আবেগ আর যুক্তির মাঝে ঠোকাঠুকি শুরু হয়। কিন্তু ততদিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। পূর্বের সকল অন্যায় ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে আত্মহনন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এও সত্যি যে, নীল তিমির ফাঁদ যতটা না ভয়াল, তারচেয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বেশি। ভাল হোক বা মন্দ, কোন বিষয় জানা থাকা ভাল। তবে তাই নিয়ে প্রচুর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে আতঙ্কিত বা বিভ্রান্ত করা ঠিক নয়। কথায় বলে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তাই আসুন, আমরা আরও বেশি বেশি আমাদের ছেলেমেয়েদের কাছে থাকি, ভাল রাখি। ওদের দিকে নজর দেই। সময় নিয়ে ছেলেমেয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি। টিকটিকির মতো পেছনে না লেগে রাত জেগে সে কী করে বন্ধুর মতো জেনে নিই। তাদের সময়টাকে আনন্দময় করে তুলি। তাহলে আর নীল তিমি বা অন্য কোন ফাঁদে ওরা জড়াবে না। লেখক : কথাসাহিত্যিক
×