ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অধিদফতরের হাতে ১৮৪ গডফাদার ও দু’হাজার ব্যবসায়ীর তালিকা

আস্তানায় নবেম্বরে একযোগে অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

আস্তানায় নবেম্বরে একযোগে অভিযান

সারাদেশে ১১শ’ মাদক আজাদ সুলায়মান ॥ এক যোগে সারাদেশে শুরু হচ্ছে মাদকবিরোধী অভিযান। পুলিশ, আনসার ও এপিবিএনের সহায়তায় এ যৌথ অভিযানের নেতৃত্বে থাকবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ১১শ’ মাদক আস্তানায় ১৮৪ গডফাদার ও ২ হাজার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর একটি তালিকা হাতে নিয়ে আগামী মাসের মাঝামাঝি মাঠে নামছে এ বাহিনী। অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, এটাই হবে এক যোগে চালানো প্রথমবারের মতো যৌথ অভিযান। আশা করা হচ্ছে দেশের শীর্ষ মাদকব্যবসায়ীরা ধরা পড়বে। আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। জানা গেছে, বর্তমানের রাজধানীসহ সারাদেশে মোট ১১শ’ মাদক আস্তানা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে সীমান্তবর্তী কক্সবাজার টেকনাফ, সাতক্ষীরা, বেনাপোল, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হালুয়াঘাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া ও কুমিল্লা সীমান্তে। মাদকদ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য সৃষ্টিকারী হচ্ছে ইয়াবা। তারপরই ফেনসিডিল ও গাঁজার অবস্থান। সূত্র জানায়, দেশে বছরব্যাপীই ছিটে-ফুটো মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও ব্যবসায়ী আটক হলেও মাদকসেবীর সংখ্যা ও ব্যবসা কোনটাই হ্রাস পাচ্ছে না। বরং দেশে ইয়াবার আগ্রাসন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইয়াবা উৎপাদনকারী দেশ মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরুর পর থেকে ইয়াবার চালানে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। কিন্তু হঠাৎ আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় মাদক বিভাগের বর্তমান মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন দায়িত্ব নেয়ার পর পরই সারাদেশের মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী সম্পর্কে তৃণমূল পর্যায়ে নানা ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে মাদকের আগ্রাসন দেখে তিনি রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। ওই তালিকা হাতে নিয়েই তিনি দেশব্যাপী একযোগে অভিযান চালানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন একযোগে যৌথ অভিযান চালানোর। জামাল উদ্দিন বলেন, এটা আরও আগেই করা উচিত ছিল। শুধু রাজধানীতেই মাদকবিরোধী কর্মকা- জোরদার করা হলে চলবে না। মনে রাখতে হবে রাজধানীতে কোন ধরনের মাদক উৎপন্ন বা তৈরি হয় না। এগুলো আসে মিয়ানমার ও ভারত থেকে। কাজেই এগুলো রোখার কৌশলটাও হবে উৎপত্তিস্থলকে সামনে রেখে। সীমান্ত এলাকায় মাদকবিরোধী কর্মকা- জোরদারের পাশাপাশি চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের আটক করে দীর্ঘমেয়াদী কারাগারে বন্দী রাখা গেলে পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি নিশ্চিত। হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে সারাদেশে দেড় শতাধিক ভয়ঙ্কর মাদকের গডফাদার রয়েছে। এ সম্পর্কে একটি সূত্র জানায়, এসব গডফাদারের অনেকেই সমাজপতি, কেউ কেউ আবার মাঠপর্যায়ের রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য পরিবহন ব্যবসায়ী। রয়েছেন কক্সবাজারের এক বিতর্কিত সাংসদ। এদের বিষয়ে গত এক যুগ আগে-পরের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও খোঁজখবর নিয়েছে মাদকদ্রব্য বিভাগ। জড়িত রয়েছে একডজন নারীও। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২০ মাদকস্পটে বেপরোয়া চলছে মাদক ব্যবসা। এখানকার পরিদর্শক এসএম শামসুল কবির মাদকবিরোধী অভিযানে সফলতার দরুণ তিনবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত। মাসতিনেক আগে তিনি চট্টগ্রামে যোগ দেয়ার পরই শুরু করেন অভিযান। এ কদিনেই তিনি লক্ষাধিক ইয়াবা জব্দ করেন। তিনি জানান, গত মাসেও রেকর্ড সংখ্যক মাদকদ্রব্য জব্দ ও ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মাদকের ট্রানজিট রুট হিসেবে চিহ্নিত। এখান থেকে সারাদেশে মাদক ছড়াছে। এক যোগে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে এসব আস্তানায় ভাটা পড়বে। মাদকের দ্বিতীয় বৃহত্তম আস্তানা হিসেবে পরিচিত যশোর। এখানে রয়েছে বড় চারটি এন্ট্রি পয়েন্ট। মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩ শতাধিক। এখানকার সহকারী পরিচালক নাজমুল কবীর জনকণ্ঠকে জানান, চলতি বছরেই এখানকার বড় ৫ গডফাদার ক্রসফায়ারে প্রাণ হারিয়েছে। আছে আর ৭ জন। তাদের বেশিরভাগই ভারতে আত্মগোপনে। তারপরও মাঝে মাঝে এলাকায় হানা দেয় তারেক, বেবী ও কামাল নামে তিনজন। ক্রসফায়ারে কয়েক গডফাদার নিহত হলেও এখন তাদের হেলপাররাই আবার নতুন করে দায়িত্ব নিয়ে ফেনসিডিল আমদানি করছে। মূলত ভারত থেকে আসে ফেনসিডিল ও গাঁজা। তাছাড়া আসছে ভারতীয় বাংলা মদ। তারা ধরাও পড়ছে। গত এক বছরের প্রায় তিন শতাধিক মাদকব্যবসায়ী আটক করে মামলা দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে যৌথ অভিযানের। ইতোমধ্যে একটি তালিকাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। তাদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। একযোগে এই অভিযান চালানো হলে অনেক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসবে। এদিকে রাজধানীতে কোন ধরনের মাদকদ্রব্য উৎপন্ন বা তৈরি না হলেও দেশের বৃহত্তম ঘাঁটি বা কনজিউম স্পট হিসেবে রূপ নিয়েছে। ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জানান, প্রতিদিনই রাজধানীতে ইয়াবার চাহিদা বাড়ছে। মোট আমদানির মাত্র ৩০ শতাংশ ধরা পড়ছে। বাকিগুলো থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাদক নিয়ন্ত্রণ বিভাগ ছাড়াও অন্যান্য সরকারী এজেন্সির অভিযানে এসব ইয়াবা ধরা পড়ছে। ইয়াবা ব্যবসার ধরনও বাড়ছে। আগে আস্তানায় চলত। এখন দেয়া হচ্ছে হোম ডেলিভারি সার্ভিস। মাদকসেবী মোবাইল ফোনে বলে, আমার আজ একটা লাগবে। সঙ্গে সঙ্গেই হোন্ডায় করে পাঠিয়ে দেয়া হয় বাসায়। ফলে আস্তানা বা বস্তিকেন্দ্রিক মাদক আস্তানা কমে আসছে। এক প্রশ্নের জবাবে জ্যোতি মুকুল চাকমা জানান, দুই কোটি মানুষের রাজধানীতে মাদকবিরোধী অভিযান চালানোর আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের অধীনে মাত্র একটি জীপ, একটি মাইক্রো ও একটি পিকআপ। এ তিনটি যানবাহন দিয়ে সারা রাজধানীতে অপারেশন চালানো খুবই কঠিন। গুটিকয়েক জনবল আর এ তিনটি গাড়ি দিয়েই কাজ চালাতে হয় সারাবছর। কাজেই বিষয়টির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত কর্তৃপক্ষের। জানা যায়, জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুরের চলন্তিকা বস্তি, তেজগাঁও রেল লাইন বস্তি ও কড়াইল বস্তিতে এখনও চলে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। সম্প্রতি রমনা জোনের পরিদর্শক কামরুল ইসলাম বেশ কয়েকটি স্পটে হানা দিয়ে আটক করেন ৭৬ মাদক ব্যবসায়ীকে। জব্দ করেন বেশ কিছু মাদকদ্রব্য। গত বুধবার গুলশান জোনের পরিদর্শক মোজাম্মেল হককে সঙ্গে নিয়ে তিনি অভিযান চালিয়ে আটক করেন মাদক সম্রাট মাসুদকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে রাজধানীর মাদক বাণিজ্যের অজানা তথ্য। জানা যায়, এ অভিযানে যারা ধরা পড়বে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনেই শাস্তির আওতায় আনা হবে। মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন বলেছেন, মাদকের বর্তমান আইন সেই মান্ধান্তা আমলের। এটাকে যুগোপযোগী করে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
×