ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা’ আজ এলো হেমন্ত

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

‘হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা’ আজ এলো হেমন্ত

মোরসালিন মিজান ॥ সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন্ পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে ...। প্রকৃতির আন্তরিক আহ্বানে আবারও এসেছে হেমন্ত। আজ সোমবার ১ কার্তিক, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ। প্রিয় ঋতু শুরুর দিন। নতুন ঋতুর আগমনে এরই মাঝে রূপ বদলেছে প্রকৃতি। হেমন্তের রঙে সেজেছে। কবিগুরুর ভাষায়Ñ হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা-/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধুমল রঙে আঁকা।/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।/ ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে...। ষড়ঋতুর বাংলাদেশ। এখানে দুই মাস পর পর রূপ বদলায় প্রকৃতি। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছে কার্তিক। নতুন মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হলো হেমন্ত। শীতের বাহন বলা হয় হেমন্তকে। শনিবার দিবাগত রাতে কিন্তু অনুভূত হয়েছে শীত। যারা গভীর রাত পর্যন্ত জেগেছিলেন তারা জানেন হঠাৎ কী সুন্দর বৃষ্টি নেমেছিল! কবিতার ছন্দের মতো, প্রিয় গানের সুরের মতো ঝরেছে বৃষ্টি। ঝিরিঝিরি হাওয়া মনে করে দিয়েছিল শীতের কথা। শীতের আগে একটা শীত শীত অনুভূতি। আবহাওয়াবিদদের মতে, এখন থেকে যত দিন যাবে ততই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত কমবে তত শীত বাড়তে থাকবে। নবেম্বর পুরোটা এভাবে যাবে। ডিসেম্বর থেকে বইতে শুরু করবে শীতের হাওয়া। তারও আগে থেকে ঝরতে শুরু করবে শিশির। হেমন্তকে সবচেয়ে বেশি চেনা যায় ভোরের শিশির দেখে। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দু হেমন্তের আগমনী ঘোষণা করে। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়- লিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি/নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;/শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...। কার্তিক অগ্রহায়ণ- দু’মাস হেমন্তের কাল। অগ্রহায়ণের শেষ দিনটি পর্যন্ত বহাল থাকবে এই ঋতুর আধিপত্য। প্রথম মাসটির এক রূপ। পরেরটির অন্য। এক সময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এ সময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও আভাস পাওয়া যায় সময়টির। কবিগুরু লিখেছেন- ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’ অগ্রহায়ণে আবার উল্টো চিত্র। এই মাস সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালি ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ ধান শুকোতে ব্যস্ত। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। অবশ্য যত দিন যাচ্ছে ততই বদলাচ্ছে হিসাব-নিকাশ। এখন আগের সে অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই রিষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। ঠিক এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে আগাম আমন ধান কাটার উৎসব। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মহাধুমধামে চলছে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। বগুরা, রংপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকরা যারপরনাই ব্যস্ত। কৃষকরা বাড়তি লোক নিয়ে ফসলের মাঠে যাচ্ছেন। দিনভর চলছে ধান কাটা। তারপর ফসল কাঁধে বাড়ি ফিরছেন। এত যে দেখা, তবু চোখ সরানো যায় না! অদ্ভুত ছন্দ তুলে সরু আইল মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফেরেন কৃষক। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ কৃষাণী। ধান মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় খুশি মনেই অংশ নিতে দেখা যায় তাদের। এর পর অগ্রহায়ণ। এ মাসের পুরোটাজুড়ে সারা বাংলায় চলবে নবান্ন উৎসব। বাঙালীর প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। এ সময় আমন ধান কাটা শুরু হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল উৎপাদনের সময় এটি। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমন উৎপাদন হয় এ সময়। নতুন ধানে চলে নবান্ন উৎসব। আমন ধানের চালে প্রথম রান্না হয়। এ উপলক্ষে চলে আনন্দঘন উদ্যাপন। কোন কোন অঞ্চলে ফসল কাটার আগে বিজোড় সংখ্যক ধানের ছড়া কেটে ঘরের চালে বেঁধে রাখা হয়। বাকি অংশ চাল করে সে চালে চলে পায়েস রান্না। এভাবে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় নবান্ন উৎসব। শুধু গ্রামে নয়, এখন শহরেও থাকে নানা আয়েজন। গ্রামের মতো না হলেও প্রতিবছর ১ অগ্রহায়ণ রাজধানী ঢাকায় প্রতীকী উৎসবের আয়োজন করা হয়।
×