ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফজলুল হক খান

শান্তিতে নোবেল এবং একজন শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

শান্তিতে নোবেল এবং একজন শেখ হাসিনা

প্রায় দুই মাস ধরে নতুন করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্মম বর্বরতায় রোহিঙ্গা সমস্যা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও থামেনি সেনাবাহিনীর বর্বরতা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধনমুখী অপতৎপরতার ফলে প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যেভাবে প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে তাতে অতিশীঘ্রই শরণার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে ঢাকায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর। মৃত্যুর সংখ্যাও থেমে নেই, অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সীমান্তমুখী রোহিঙ্গারা একদিকে প্রাণ হারাচ্ছে বর্বর সেনাবাহিনীর গুলিতে, স্থল মাইন বিস্ফোরণে, অন্যদিকে ডুবে মরছে নাফ নদীতে কিংবা বঙ্গোপসাগরে। তারপরও দুর্ভোগ তাদের পিছু ছাড়েনি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। খোলা আকাশের নিচে, মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই, পর্যাপ্ত খাবার নেই, চিকিৎসার ওষুধ নেই- এমনই এক পরিবেশে অতিবাহিত হচ্ছে তাদের জীবন। বেঁচে থাকার সম্বল একমাত্র ত্রাণসামগ্রী। তারও বিতরণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা পুরোপুরি স্থাপিত হয়নি। চিকিৎসা চলছে হাসপাতালের বারান্দা কিংবা খোলা মাঠে। বিশেষ করে দু’থেকে আড়াই লাখ শিশুর পরিচর্যা এখন বিশেষ প্রয়োজন। এতসব প্রতিকূল অবস্থা এবং সমস্যার মধ্যেও শরণার্থীদের একটাই সান্ত¡না তারা মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসে পেয়েছে একটু নিরাপদ আশ্রয়। নাফ নদীর ওপারে নির্মম বর্বরতা, এপারে মানবতা। মানবতা এবং বর্বরতার মধ্যেই চলছে লড়াই। এ লড়াইয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন এক সাহসী পদক্ষেপ। মানবিক মূল্যবোধ থেকেই তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন আশ্রয়হীন বুভুক্ষু, নির্যাতিত, অসহায় মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব। মাতৃস্নেহে বুকে তুলে নিয়েছেন অসহায় শিশুদের। এ অসহায় শিশুদের নির্যাতনের কাহিনী শুনে নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। মাতৃমমতায় তিনি নিজেও কেঁদেছেন শিশুদের সঙ্গে। বোনের স্নেহে আগলে ধরেছেন অসহায় নর-নারীদের। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এই নির্মম বর্বরতার। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরেছেন বর্বরতার চিত্র, দাবি জানিয়েছেন এই বর্বরতা বন্ধের জন্য পদক্ষেপ নিতে। দশম জাতীয় সংসদের সপ্তদশ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, আমাদের কষ্ট হলেও মানবিক কারণেই মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খাওয়া হবে। কিন্তু তাদের কোন কষ্ট হতে দেয়া হবে না। কেননা তারা আমাদের কাছে আশ্রয়ের জন্য এসেছে। তাদের আমরা ফেলে দিতে পারি না। মিয়ানমারের মতো নাফ নদীতে কিংবা বঙ্গোপসাগরে ঠেলেও দিতে পারি না। একজন মানুষ কতটা মানবতাবাদী হলে, কতটা মানবিক গুণের অধিকারী হলে এমন কথা বলতে পারেন, এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে আমি সমগ্র মানবজাতি নিয়েই ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়।’ জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ দেখে মনে হয় তিনি ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক সীমারেখা নিয়ে ভাবেননি, রোহিঙ্গাদের মানবজাতির অংশ হিসেবেই ভেবেছেন। প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত পদক্ষেপ বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। তারই ফলে ব্রিটিশ মিডিয়া চ্যানেল ফোর আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে মাদার অব হিউম্যানিটি অর্থাৎ মানবতার জননী বলে আখ্যায়িত করেছে। বিশ্বশান্তি ও মানবতায় আগামীতে নোবেল প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বলে বিশ্ব মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দের ধারণা। যে হারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে তাতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি সমস্যার সম্মুখীন হবে। প্রথমত, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে। এত মানুষের বাসস্থান নির্মাণ করতে গেলে বনায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গাছপালা কাটার পাশাপাশি পাহাড় কেটেও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। একদিকে বৃক্ষ নিধন অন্যদিকে পাহাড় কাটা দুটোই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সুষ্ঠু স্যানিটেশনের অভাবে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে রোগব্যাধি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতির ওপর একটা বিরূপ প্রভাব পড়বে। শরণার্থীদের জন্য বাসস্থান নির্মাণ, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ সরবরাহের জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি বাড়তি চাপ বহন করতে হবে। এবার এমনিতেই অতি বৃষ্টিজনিত বন্যায় হাওড় এলাকার ফসলাদি নষ্ট হয়ে গেছে। আগস্টের বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪টি জেলার কৃষি ফসলাদি। ফলে চাল, ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম উর্ধমুখী। খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ইতোমধ্যে ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তৃতীয়ত, পর্যটন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি। এমতাবস্থায় দেশী-বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যেতে পারে। চতুর্থত, সন্ত্রাসী কর্মকা- ছড়িয়ে পড়তে পারে। অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই মিয়ানমারে হত্যা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। ঘটনা সত্য হলে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর খুনী, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘেষিত জঙ্গীগোষ্ঠীর জঙ্গীরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব জেনেশুনেও শুধু মানবিক কারণে এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাঁর এ পদক্ষেপকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। শরণার্থীদের জীবন বাঁচাতে ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার বর্বরতা চালানো হয়েছে, দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের। যাদের অনেকেই এখনও দেশে ফিরে যেতে পারেনি, শরণার্থী ক্যাম্পেই রয়ে গেছে। ২০১৬ সালের মতো এবার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে। কমিশন চলতি বছরের শেষ নাগাদ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা। এর মধ্যে কমিশন একটি অন্তর্বর্তী বা প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করেছে। পাঁচটি ক্যাটাগরিতে কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রস্তাবনা দিয়েছে। প্রধানত দ্বন্দ্ব নিরসন, মানবিক সহায়তা দান, সৌহার্দ্য স্থাপন করার মাধ্যমে রাখাইনের উন্নয়ন। রাখাইনের সব এলাকায় মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর অনুমতি, সহিংসতার শিকার কোন সম্প্রদায়কে পর্যাপ্ত ত্রাণ থেকে বঞ্চিত না করা, সহিংসতায় আক্রান্ত সব এলাকায় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে প্রবেশাধিকার দেয়া, মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কমিশনের এই প্রস্তাবনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় সেখানকার পরিস্থিতি কত গুরুতর। মানবাধিকার রক্ষার কোন বালাই নেই সেখানে। নেই কোন মানবাধিকার কর্মী। বাস্তুচ্যুত মানুষকে কিভাবে পুনর্বাসন করা যায় সে সম্পর্কে পরামর্শ রেখেছে কমিশন। বাড়িঘর থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে দেয়া কতটা অন্যায়, তাদের পুনর্বাসন কতটা জরুরী এবং কিভাবে কর্মগুলো সম্পাদন করা যায় সে বিষয়ে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে শরণার্থীরা ফিরে এলে তারা নিজেদের যেন ঝুঁকিমুক্ত দেখতে পায়। যাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে তাদের জন্য নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করা। মিয়ামারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে নিজের নাগরিকদের অস্বীকার করা, শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা। কমিশন বলছে নাগরিক হিসেবে যাদের পরিচয় সন্দেহাতীত তাদের সব সুযোগ-সুবিধা, অধিকার ও স্বাধীনতার আয়োজন রাখা উচিত। অন্যদিকে যাদের নাগরিকত্ব যাচাই করতে হবে তাদের জন্য জরুরী ভিত্তিতে সময়সীমা বেঁধে কৌশল নির্ধারণ করা উচিত। এ কৌশল হওয়া উচিত স্বচ্ছ, দক্ষ এবং সেখানে বসবাসকারী হিসেবে সঠিক তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করে। এ কৌশল নির্ধারণে রাখাইন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে এ কাজটি করতে হবে, যাতে সবার কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য পৌঁছে। শিশু এবং উত্তরাধিকারের ব্যাপারে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত নয়। শত শত বছর ধরে একটি এলাকায় বসবাসকারীদের যদি নাগরিকত্ব যাচাইয়ের আওতায় নেয়া হয়, সেটা কোনভাবেই ন্যায়সঙ্গত হবে না। বিষয়টি মাথায় রেখে আনান কমিশন কথাগুলো তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ গ্র্যান্ডি সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে এ অঞ্চল সফর করেছেন। দুটি গুরুত্বপূর্ণ মনোভাব ওই সফরের সময় তিনি পেশ করেছেন। তার মতে এই সমস্যার সৃষ্টি মিয়ানমারের, সমাধানও দেশটির অভ্যন্তরের। তাড়িয়ে দেয়া জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে পুনর্বাসনই এ সমস্যার সমাধান। তার অন্য বক্তব্যটি হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের যদি উন্নত ভবিষ্যত দেয়া না যায় তাহলে সেটা এ অঞ্চলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তিনি জঙ্গীবাদের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, কিছু দুষ্টলোক রয়েছে তারা রোহিঙ্গাদের সে পথে টেনে নিয়ে যাবে। শরণার্থীরা যাতে জঙ্গীবাদের জ্বরে আক্রান্ত হয়ে না পড়ে সে জন্য সমস্যাটির সমাধান হওয়া প্রয়োজন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর শান্তিতে নোবেল প্রাপ্ত আউং সান সুচি নিজেই রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। কমিশন প্রতিবেদন দেয়ার পর তা বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু তিনি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পরিবর্তে বেছে নিলেন রোহিঙ্গা নিধনের মতো এক নিষ্ঠুর বর্বরতাকে। তার এই বর্বরতা, এই নিষ্ঠুরতা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এই অপরাধের দায়ে আউং সান সুচির শান্তিতে প্রাপ্ত নোবেল কেড়ে নেয়া যেমন যুক্তিসঙ্গত তেমনি এই গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। লেখক : বীমা ব্যক্তিত্ব, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
×