ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

পারমাণবিক বিদ্যুতকন্দ্র নিয়ে সচেতনতা কেন প্রয়োজন?

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

পারমাণবিক বিদ্যুতকন্দ্র নিয়ে সচেতনতা কেন প্রয়োজন?

বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে এটা তো অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। তাই এর জন্য জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম কেন প্রয়োজন? বস্তুত এ ধরনের প্রশ্ন আসতেই পারে। কিন্তু পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের বিষয়টি যে একেবারে ভিন্ন, তা কি আমরা জানি? আর নবাগত দেশের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা, তাও সম্যক উপলব্ধির বিষয়। এর জন্য লেখার শুরুতে একটি দৃষ্টান্তের অবতারণা করতে চাই। ১৯৬০ সালে অস্ট্রিয়া ৬টি নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এর বাস্তবায়নে ১৯৭২ সালে সাতশ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি রিএ্যাক্টরের নির্মাণ কাজও শুরু করে। কিন্তু ওই রিএ্যাক্টরের নির্মাণকাজ সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিউক্লিয়ারবিরোধী আন্দোলনের কারণে অস্ট্রিয়ান পার্লামেন্ট রিএ্যাক্টর ব্যবহার নিষিদ্ধের পক্ষে ভোট দেয়। উল্লেখ্য, অস্ট্রিয়ান পার্লামেন্ট সর্বসম্মতভাবে এই নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখতে একটি আইনও প্রণয়ন করে। উপর্যুক্ত ঘটনায় দেখা যায়, পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ ও সেখান থেকে বিদ্যুত উৎপাদন উচ্চতর প্রযুক্তিঘন তথা বিজ্ঞান বিশেষত, নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানের বিষয়-আশয় হলেও নির্মিত প্ল্যান্ট ব্যবহার নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তটি যারা দিয়েছেন, তারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাও আবার কোনরকম টেকনিক্যাল বা সায়েন্টিফিক গবেষণা ব্যতিরেকেই। এটি অলঙ্ঘনীয় এক বাস্তবতা। বস্তুত পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্তটি যেহেতু জাতীয় একটি নীতিনির্ধারণের বিষয়, তাই এখানে জনমতের প্রতিফলন ঘটে থাকে বৈকি। আর এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন স্বপ্নদর্শী কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অবশ্যই কোন বিজ্ঞানী এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র’ নির্মাণযজ্ঞের সিদ্ধান্তও বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নদর্শী নেতৃত্বের অনিবার্য ফল। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে। বিশেষত, বাঙালী জাতির পঞ্চাশ বছরের লালিত স্বপ্ন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ সফলভাবে শুরু করা, তাও আবার রাশিয়ার সহযোগিতায়, সেটা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বঙ্গবন্ধুকন্যার অভাবনীয় সাফল্য। এর কারণ বিশ্ববাস্তবতায় সত্য হলো, পারমাণবিক বোমা বানানোর আশঙ্কায় কোন মুসলিম দেশকে শান্তিপূর্ণ কাজেও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। যেমন ইরান। কিন্তু গণতন্ত্রের মানসকন্যা ও বিশ্বশান্তির দূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল এই বাধা অতিক্রম করে শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিদ্যুত উৎপাদনে নন-নিউক্লিয়ার থেকে নিউক্লিয়ারে পদার্পণ নিশ্চিত করেছেন। রূপপুর বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণকে ঘিরে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রূপপুরের পদ্মাপাড়ে চলছে মহাকর্মযজ্ঞ। সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতাধীন পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রটির সার্বিক কার্যক্রম সরাসরি তদারক করছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি নির্মাণে বাংলাদেশের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগী হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধুরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, আজকের রুশ ফেডারেশন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ-বিরোধিতায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মিশেলে চলছে এক ধরনের মিডিয়াওয়ার। একে আবার জনমতের প্রলেপ দেয়ার অপপ্রয়াসও চলছে। ওই ওয়ারের একটি হাতিয়ার হলো, পারমাণবিক বর্জ্য। যদিও গত ৩০ আগস্ট রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য বা স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেয়া-সংক্রান্ত একটি চুক্তিতে সই করেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা। এর আগে ১৫ মার্চ ঢাকায় এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া চুক্তি অনুস্বাক্ষরিত হয়। যা ৫ জুন মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করে। এদিকে ভবিষ্যতে আরেকটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, যেখানে স্পেন্ট ফুয়েল পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিশোধন-ব্যয়ের বিষয়টি উল্লেখ থাকবে। স্পেন্ট ফুয়েল ফেরত নেয়ার আইনী প্রক্রিয়াসমূহ এভাবে ধাপে-ধাপে সম্পন্ন হবেÑ এই মর্মে তথ্য-উপাত্ত প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের থেকে অবহিত হয়ে আমার একাধিক নিবন্ধেও উল্লেখ করেছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণবিরোধীরা এই স্পেন্ট ফুয়েল নিয়ে প্রপাগান্ডা অব্যাহত রাখল। এতে তারা সফলও হলো। এদের প্রপাগান্ডা প্রচারণার ধরন অনেকটা এ-রকম ছিল, ‘রাশিয়া পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নেবে না। আবার বলছে, বাংলাদেশকে হাইলি রেডিওএ্যাকটিভ পারমাণবিক বর্জ্য সংরক্ষণ করতে হবে, যার অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতাÑকোনটিই বাংলাদেশের নেই। ফলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের মাধ্যম দেশের পরিবেশ, মাটি, নদীনালা, খালবিলÑ সবকিছু তেজস্ক্রিয়তায় দূষিত হয়ে যাবে। কখনও বা প্রচার করেছে, রাশিয়া তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছে। মানে পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নেয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখন তারা বলছে বর্জ্য ফেরত নেবে না।’ বস্তুত এভাবে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে, নিবন্ধ ছেপে, এমনকি জনসচেতনতার কথা বলে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের বিরুদ্ধে গোয়েবলসীয় প্রচারণা চালানো হয়। এরফলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ কী বাধাগ্রস্ত হচ্ছে? জনগণকে কী সচেতনতার আড়ালে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে ওই মহল? প্রথমত, প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা হয়ত বলবেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে এর কোন প্রভাব পড়েনি। সবকিছু তো ঠিকঠাকই আছে। না এই জবাব যে সঠিক নয়, তা-ই বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে দিতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, সমুদ্রবিজ্ঞান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের মাঝে দেশে নিউক্লিয়ার সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন’ সংকলনগ্রন্থ বিতরণ ও মতবিনিময় করতে গিয়ে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র সম্পর্কে নানা নেতিবাচক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমায়। অবশ্য ইতিবাচক অভিজ্ঞতাও অনেক ছিল। কিন্তু নেতিবাচক পরিস্থিতি ছিল সত্যিই উদ্বেগজনক। এর যথার্থ জবাব না-দিয়ে কিংবা এগিয়ে গিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক আছেÑ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এ রকম আত্মতুষ্টিতে থাকা হবে চরমভাবে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। যার ফলে সুদূরপ্রসারী আবহে বিদ্যুত উৎপাদনে বাংলাদেশের নন-নিউক্লিয়ার থেকে নিউক্লিয়ারে পদার্পণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। যা হয়ত প্রকল্পের টেকনিক্যাল ব্যক্তিগণ উপলব্ধি করতে পারছেন না। যেমন কেউ বলছে পদ্মায় পানি নেই, কেউবা বলছে মাছ মরে যাবে এমনকি ঘনবসতি এলাকায় রেডিয়েশন ছড়াবে রূপপুর প্রকল্প। এ ধরনের প্রসঙ্গ উদ্ভট শোনালেও বিশেষভাবে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণায় সাধারণ মানষের মধ্যে এমনকি উচ্চশিক্ষিতজনে এসব ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে। এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা এড়িয়ে জনসচেতনতার সংক্ষিপ্ত কোন পথ আছে কি? মিডিয়াওয়ারের জবাবে ইতিবাচক প্রচারের অনুপস্থিতিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নিয়ে মানুষের উৎকণ্ঠাই শেষ পর্যন্ত পাকাপোক্ত হবে। এর একটি হচ্ছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের মতো বাঙালির অর্ধশতকের স্বপ্নপূরণের ইতিবাচক কাজটি-ই নেতিবাচক তথা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ হিসেবে পরিগণিত হবে। তাই পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে বাংলাদেশকে নবাগত দেশ হিসেবে এবং সেইসঙ্গে নন-নিউক্লিয়ার থেকে নিউক্লিয়ারে পদার্পণের শুভলগ্নে অবশ্যই নিউক্লিয়ার সচেতনতার কাজটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে হবে। এটি এক ধরনের অবকাঠামোও বৈকি। এদিকে পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনে বাংলাদেশের নন-নিউক্লিয়ার থেকে নিউক্লিয়ারে পদার্পণের মানে শুধু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকও নয় বরং কয়েকটি পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে দেশের মোট বিদ্যুত চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ নিউক্লিয়ার উৎস থেকে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আরেকটি পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। তাই দেশে নিউক্লিয়ার সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন আগেভাগেই করা উচিত। এ বিষয়টি দেশে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন-সংশ্লিষ্টরা মানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। এবং তা বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিলম্ব করা হবে চরম দায়িত্বহীনতা। লেখক : বিজ্ঞানলেখক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা
×