ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভেজাল সর্বত্র

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

ভেজাল সর্বত্র

জাল আর ভেজাল মিলেমিশে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর এই দেশে। ভেজালে ভেজালে সয়লাব হয়ে আছে বুঝি সবকিছু। খাদ্য, পানি শুধু নয়, ওষুধ, এমনকি প্রসাধনীও আজ ভেজাল-আক্রান্ত। জীবনের সঙ্গে খাদ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য যেখানে হওয়া উচিত ভেজালমুক্ত, নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর, সেখানে তা খুঁজে পাওয়া মনে হচ্ছে আর সহজসাধ্য নয়। বাস্তবতা আজ এমন যে, ভেজালমুক্ত খাদ্য পাওয়াই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি রং ও নানা রকমের রাসায়নিক মিশিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে চালও। সাধারণ মোটা চাল বিশেষ পলিশিং মেশিনে কেটে চিকন ও চকচকে করা হয় এবং এসব চাল বিভিন্ন নামে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। এছাড়া ওজন বৃদ্ধির জন্য চালে কাঁচের গুঁড়া, পাথরের গুঁড়া, ইটের গুঁড়া ও কাঁকর ইত্যাদি মিশিয়ে বিক্রির খবরও শোনা যায়। শুধু চাল নয়, পাইকারি ও খুচরা গুঁড়া মরিচ হলুদেও এসব মেশানো হয়। আবার বাজারে চড়া দামে যে প্যাকেটজাত লবণ বিক্রি হচ্ছে আয়োডিনযুক্ত বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে পরিমাণমতো তাতে আয়োডিন নেই। এমনকি আয়োডিনমুক্ত অধিকাংশ লবণ। বাজারে যে মাছ বিক্রি হচ্ছে তাতে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে ৬০ শতাংশ চরম বিষাক্ত, ৩০ শতাংশ অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত আর মাত্র বাকি ১০ শতাংশ বিষমুক্ত। ভোজ্যতেলে নানান উপায়ে ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। সয়াবিন তেলে পাটের উজ্জ্বলতা বাড়াতে পাটকলগুলোতে ব্যবহৃত ‘জুট ব্যাচিং অয়েল’ মেশানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিকর রাসায়নিক আর পেঁয়াজের রস মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে খাঁটি সরিষার তেল। বিভিন্ন ধরনের ফল পাকাতে ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইডসহ বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এভাবে বিস্কুট, রুটি, সেমাই, নুডলসসহ মানুষের নিত্যদিনের প্রায় সব খাদ্যেই ভেজাল মেশানো হচ্ছে নানাভাবে। বোতলজাত বা মিনারেল পানির হালহকিকত তো আরও ভয়াবহ। বোতলজাত পানির বাণিজ্য বেশ রমরমা। কোনরকম পরিশোধন ছাড়াই নলকূপ থেকে প্লাস্টিকের জারে পানি ভর্তি করে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বাসাবাড়িতে বিক্রি চলছে দেদার। উৎপাদক অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কারখানায় পানি বিশুদ্ধকরণের কোন উপকরণ ও রসায়নবিদ নেই। এদের অধিকাংশেরই নেই বিএসটিআই’র অনুমোদন। এসব ভেজাল খাবার খেয়ে বর্তমানে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ পেটের পীড়া, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, চর্মরোগ, হাঁপানি, লিভার ও কিডনিজনিত সমস্যার পাশাপাশি মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান হারে। আর এ কারণে দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো ক্লিনিক বাড়ছে। সেখানেও ভেজালের কমতি নেই। চিকিৎসার নামে প্রতারণার জাল বিস্তৃত হয়ে আছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতিবছর প্রায় তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলে ফাও তথ্য দিয়েছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম অর্থাৎ শিশুরাও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তা হ্রাসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। গর্ভজাত শিশুও ঝুঁকিমুক্ত নয়। ভেজাল শনাক্ত করার নানা পদক্ষেপ নেয়া হয় বলে দাবি করেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি চরম ঝুঁকি বা হুমকির মুখে পড়লেও কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা নির্বিকার। এসব দেখার জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। ভেজাল খাদ্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও বিক্রয়কারীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে বিপদ ক্রমশ বাড়বে। এসব রোধ করা জরুরী।
×