ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হোসাইন ইমরান

হল জীবনের মধুর গল্প

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

হল জীবনের মধুর গল্প

জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী জীবন সম্পর্কে এক একজনের চিন্তা-ভাবনা, অভিব্যক্তি এক এক রকম। কারও কাছে জীবন মানে যুদ্ধ, জীবন মানে লক্ষ্য অর্জন, জীবন মানে বার বার আশাহত হয়েও আশায় বুক বাধা। আবার কারও কাছে জীবন মানে হাসি-কান্না, জীবন মানে আড্ডা, জীবন মানে স্বাধীনভবে বেঁচে থাকা। মানব মনে জীবন সম্পর্কে এমন ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করার পেছনে সরাসরি প্রভাব ফেলে ব্যক্তির বয়স ও চারপাশের পরিবেশ। আর এজন্য দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ুয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের মনে জীবন সম্পর্কে এমন ব্যতিক্রম চিন্তা-ভাবনার ঘোরপাক প্রতিনিয়তই খেতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হলের আবাসকি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের হল জীবনের হাসি-কান্নামাখা জীবনের গল্প। কেউ বললেন তাদের হল জীবনের গল্প-আড্ডা-গানে মেতে থাকার আনন্দঘন মুহূর্তের কথা, সিনিয়র-জুনিয়র মিলে একসঙ্গে রাত জেগে আড্ডা দেয়া, ছাদে বৃষ্টিতে ভেজা, রাতের জ্যোৎস্না উপভোগ করা, বন্ধুরা মিলে হঠাৎ ঘুরতে যাওয়ার গল্প। আবার কেউ বললেন বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিজ জীবনের লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনার কথা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শোয়েব আহমেদ। পড়ছেন বাংলা বিভাগে। তিনি বলেন, পরিবারে একটি গ-িরেখার মধ্যেই জীবনযাপন করতে হয়। হলে স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে থাকা যায়। যেখানে নিয়ম করে ঘুম থেকে উঠতে হয় না, রুমে ফেরারও নেই কোন বাধ্যবাদকতা। সারারাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া, কার্ড খেলা আর দলবেঁধে গান গাওয়ার মাধ্যমে আনন্দঘন সময় পার করা যায় হল জীবনেই। তার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে হলে না থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অপূর্ণই থেকে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সাজিদ মাহমুদ বলেন, হল জীবনের পরিবেশটাই এ রকম যেখানে দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকেত হয়। তিনি বলেন, পার্সোনাল লাইফ বলতে কিছু নেই, জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হয়, আর এটা হল লাইফের মাধ্যমেই সম্ভব হয়ে ওঠে। এছাড়া সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যক্তির জীবনে যে প্রভাব ফেলে তা পরিবার থেকে পাওয়া সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। হল জীবন কী রকম কাটাচ্ছেন জানতে চাওয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যাালয়ের বিজয় একাত্তর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রিদওয়ান আহমেদের কাছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকার ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের হলে একসঙ্গে বসবাস করার সুযোগ হয়। যার ফলে পরস্পরের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হয়ে থাকে। অন্য এলাকার না জানা অনেক বিষয় রুমমেটের গল্পের মাধ্যমেই জেনে নেয়া সম্ভব। তাই বইয়ের পাতার ওপর নির্ভর না করেই গল্প-গুজবের মাধ্যমেই অভিজ্ঞতার পাল্লা ভারি করা যায়। তিনি বলেন, শুধু গল্প-গুজব আর আড্ডার মাধ্যমে হল জীবন পার করলেই হবে না; জীবনের একটি লক্ষ্য স্থির করে সেই লক্ষ্য পূরণে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। তা না হলে হল জীবন তথা ক্যাম্পাস জীবন পুরোটাই বৃথায় পরিণত হবে। হলে প্রথমে উঠার পর সকলেরই মনে থাকে এক ধরনের আতঙ্ক। একদিকে থাকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়ার চিন্তা অন্যদিকে থাকে রাগিং এর ভয়। সবমিলিয়ে হলে উঠার পর মনের মধ্যে উঁকি দেয় নতুন জল্পনা-কল্পনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী তৌহিদ এলাহী বলেন, হলে থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে সব ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। বড়ভাইদের ¯েœহ আর বন্ধুদের ভালবাসায় সিক্ত যেন অন্যরকম এক জীবন। প্রথম যখন হলে পদার্পণ করেছিলাম, এত অপরিচিত মুখ দেখে ভেবেছিলাম, হয়ত কখনও এদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে পারব না। কিন্তু হলের জীবন এমনই অসাধারণ যে, খুব অল্প সময়েই সবার সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠল। তারপর কাটতে থাকল দিন, ভারি হতে থাকল স্মৃতির পাতা আনন্দ-বেদনা আর নতুন নতুন অভিজ্ঞতায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হলের শিক্ষার্থী পূজা দে। বাড়ি নরসিংদী। মা-বাবার খুব আদরের মেয়ে। শুরুর দিকে মনটা কেমন ছটফট করত বাড়ি যেতে। হলে একদম ভাল লাগত না। প্রথমদিকে বৃহস্পতিবার এলেই কোনরকমে ব্যাগটা গুছিয়ে রওনা হতেন বাড়ির উদ্দেশে। বাড়ি গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদতেন। মা সান্ত¦না দিতেন, মাত্র তো কয়েক বছর। তারপরই আবার একসঙ্গে থাকব আমরা। এখন দুদিকে লেক বেষ্টিত পেয়ারা আম, নারকেল, সুপারি ও বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ শোভিত এই মায়াবী হলটির মায়ায় পড়েছেন পূজা। এখন বছরে দুই বার যান বাড়িতে। হলের স্বাধীন পরিবেশ রেখে বদ্ধ বাড়িতে বেশি যেতে ভাললাগে না তার। অনেকেই বাড়িতে রান্না করেন না। হলের ডাইনিং এর খাবার খেতে না পেরে অনেক ছাত্রীদের বাধ্য হয়ে রান্না করতে হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থী মণিকা দেবী বলেন, আগে কখনই রান্না করিনি। মা প্রায়ই বকাঝকা করতেন। এখন ভালই লাগে রান্না করতে। সব বান্ধবীরা মিলে প্রায়ই একসঙ্গে রান্না করে গোল করে মেঝেতে বসে খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয়। মাঝেমাঝে হলে রান্না করে ক্যাম্পাসে এনে খাওয়া হয় নানা আইটেমের খাবার। এতে অংশগ্রহণ করে ছেলেবন্ধুরাও। হল নামটি শোনার পরই আমাদের চিন্তায় ‘গণরুম’ ধারণাটি স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। দেশের প্রায় বেশিরভাগ সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসন সঙ্কটের কারণে ‘গণরুম’ গড়ে উঠতে দেখা যায়। বিশেষ করে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর এই সমস্যা প্রকট হয়ে পড়ে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহনারা ইমাম হলের গণরুমে থাকা শিক্ষার্থী সানজিদা রহমান বলেন, গণরুমে একসঙ্গে ১৫-১৬ জন করে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। ফলে প্রতিনিয়তই পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। পরীক্ষা আসলে এ সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করে। অন্যদের চিল্লা-চিৎকার আর হৈহুলোড়ের কারণে লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়া যায় না। তবে সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো ভাল দিকও রয়েছে গণরুমের। আড্ডাপ্রেমীদের জন্য গণরুম উপযুক্ত স্থান হচ্ছে গণরুম। সবাই মিলে একসঙ্গে ডাইনিং এ খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা আর গল্প-গুজবের মাধ্যমে ভাল সময় কাটে তাদের। সঠিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও সুস্থ শরীর গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রশাসন থেকে বছরে একবার খেলাধুলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। এসব খেলাধুলায় অংশ নেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থীসহ হলের প্রভোস্ট, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। খেলায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কারও তুলে দেয়া হয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ মুজতবা আলী হলে প্রতিবছর এ রকম খেলাধুলার আয়োজন করা হয় বলে জানান ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী তৌফিক শাওন। তিনি বলেন, আমাদের হলের সবাই মিলে অন্য হলের শিক্ষর্থীদের সঙ্গে অবসর সময়ে খেলাধুলার আয়োজন করে থাকি। এতে সবার মধ্যে একধরনের পারস্পরিক বন্ধন তৈরি হয়। তবে হল জীবনের এত এত প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে কিছু অপ্রাপ্তির দিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে পর্যাপ্ত রিডিং রুম, গেস্ট রুম, টিভিরুম, ওয়াইফাই সুবিধা, ডাইনিং না থাকায় শিক্ষার্থীদের পোহাতে হয় ভোগান্তি। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে হলগুলোতে ঘটে যায় নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। যা ছাত্রজীবনকে বিষিয়ে তুলে। নেমে আসে জীবনে ঘোর অন্ধকারের ছায়া।
×