ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালানি তেলে ভেজাল দেয় খোদ পদ্মা অয়েল

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

জ্বালানি তেলে ভেজাল দেয় খোদ পদ্মা অয়েল

রশিদ মামুন ॥ এবার জ্বালানি তেলে ভেজালের অভিযোগ উঠল খোদ সরকারী কোম্পানি পদ্মা অয়েলের বিরুদ্ধে। এতদিন বেসরকারী ফ্রাকশনেশন প্লান্টের বিরুদ্ধে সারাদেশের জ্বালানি তেলে ভেজালের অভিযোগ ছিল। কিন্তু সবার আড়ালে পদ্মা অয়েল দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি তেলে ভেজাল মিশিয়ে আসছিল। বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির বৈঠকে পদ্মা অয়েলের বিরুদ্ধে জ্বালানিতে ভেজাল মেশানোয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি সূত্র বলছে, বৈঠকে সম্প্রতি পদ্মা অয়েলের বিরুদ্ধে সদস্যরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কমিটির সভাপতি জানতে চান প্রক্রিয়াকরণ কারখানা না থাকার পরও কেন পদ্মা অয়েলকে কনডেনসেট সরবরাহ করা হলো। সূত্র জানায়, জ্বালানি তেলে বিশেষ করে বেশি মূল্যের পেট্রোল এবং অকটেনেই সারাদেশে ভেজাল মেশানো হয়। ভেজাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় গ্যাস ক্ষেত্রের উপজাত কনডেনসেট। এই কনডেনসেটের লিটার প্রতি মূল্য ৪২ টাকা। অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি লিটার পেট্রোল বিক্রি হয় ৮৪ টাকায়, আর অকটেনের দর লিটার প্রতি ৮৯ টাকা। নিয়মানুযায়ী গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর কাছ থেকে কনডেনসেট কিনে তা ফ্রাকশনেশন করে আবার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিক্রি করতে হবে। কারণ দেশে একক তেল সরবরাহকারী বিপিসি। এরপর বিপিসি সরকারী কোম্পানিকে দিয়ে সারাদেশে তেল বিপণন করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে বিপিসি সরাসরি কনডেনসেট সংগ্রহ করে পেট্রোল এবং অকটেনে ভেজাল দিয়ে বিক্রি করেছে বলে প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি। কমিটি বৈঠকে সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, সরকারী কোম্পানি পদ্মা অয়েলই জ্বালানি তেলে ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করে। তাদের নিজেদের কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্ট না থাকার পরও কেন তারা কনডেনসেট কিনল এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। সভাপতি বলেন, এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিটির কথা উল্লেখ করে বলেন তদন্ত প্রতিবেদন বলছে পেট্রোল এবং অকটেনে পাঁচ ভাগ কনডেনসেট মিশিয়ে বিক্রি করলে ইঞ্জিনের কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিপিসি কোন পেট্রোল এবং অকটেন আমদানিই করেনি। তা হলে কেন কনডেনসেট নেয়া হলো, কিসের সঙ্গে মেশানো হলো। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য তাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। কনডেনসেট প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন পেট্রোল এবং অকটেন এমনিতে লো গ্রেডের। আন্তর্জাতিক বাজারে যে পেট্রোল এবং অকটেন বিক্রি হয় তার থেকে নিম্নমানের হওয়ায় বাংলদেশ পেট্রোল এবং অকটেন রফতানি করতে পারে না। এর আগে একটি প্রতিবেশী দেশে পেট্রোল এবং অকটেন রফতানি করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু দেশটি জ্বালানি দুটি রফতানির জন্য নির্দিষ্ট গ্রেড নির্ধারণ করে দেয়ায় তা সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এমনিতে কম দামের জ্বালানির উচ্চমূল্য এর মধ্যে নিম্নমান আর ভেজালে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর মাঝামাঝি সময়ে জ্বালানি তেলের ভেজাল প্রতিরোধে জ্বালানি বিভাগ কঠোর হয়। কিন্তু আকস্মিকভাবে এমন কি হলো যে তাদের বিষয়ে আবার নমনীয় হতে হবে। জ্বালানি তেলে সারাদেশে ভেজাল দেয়ায় সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে প্রক্রিয়া না করে সরাসরি কোন গাড়ি কনডেনসেটে চললে ভয়াবহভাবে পরিবেশ দূষিত হয়। এর মধ্যে পদ্মার বিরুদ্ধে জ্বালানি তেলে ভেজাল দেয়ার এ অভিযোগ উঠল। বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রি বৃদ্ধির বদলে ২০১৪ সাল থেকে কমতে শুরু করে। এর পরের বছর বিপিসির জ্বালানি তেল বিক্রি আরও কমে গেলে বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্টের অনুমোদন নিয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ী অবৈধ এ বাণিজ্য করছে। জ্বালানি বিভাগ এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হলেও কিভাবে সেই বিভাগের কোম্পানি ভেজাল তেল বিক্রি করে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বৈঠকে কনডেনসেটের নানা বাণিজ্যিক অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সদস্যরা। তবে জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন যারা কনডেনসেট কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যদিও বছরের মাঝামাঝি সময়ে অভিযুক্ত চারটি প্রক্রিয়াকরণ কারখানার বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় জ্বালানি বিভাগ থেকে। কমিটির সদস্য আবু জাহির এমপি বৈঠকে বলেন, কনডেনসেটের অপব্যবহার নিয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট উপস্থাপন করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। তিনি বলেন ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬টি কোম্পানি কনডেনসেট ব্যবহারে ব্যাপক অনিয়ম করেছে। কালোবাজারির মাধ্যমে পেট্রোল, অকটেনের কনডেনসেট মিশিয়ে বিক্রি করে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার গাড়ির ইঞ্জিন ধ্বংস করেছে। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। বছরে কনডেনসেট উত্তোলনের পরিমাণ ৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিকটন। ভেজাল মিশ্রিত তেল ব্যবহারের ফলে গাড়ির ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ঘন ঘন বিকল হয়ে পড়ছে। এতে করে গ্রাহক অসন্তোষ বেড়ে চলেছে। সচেতন গ্রাহকদের অভিযোগ জানানোর যায়গাও নেই।
×