ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বস্তি পরিষদের বৈঠকে সাবেক মহাসচিবের আহ্বান

রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে চাপ দিন ॥ কোফি আনান

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারকে চাপ দিন ॥ কোফি আনান

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য মিয়ানমারকে চাপ দিতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে মিয়ানমার সরকার গঠিত কমিশনের প্রধান কোফি আনান দেশটির আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিক স্বীকৃতি দেয়ার ওপরও জোর দিয়েছেন। শুক্রবার মধ্যরাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ সদর দফতরে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের এক বৈঠকে অংশ নেন কোফি আনান। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের উদ্যোগে আয়োজিত বৈঠকে ‘এ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট’র চেয়ারম্যান কোফি আনান ছাড়াও জাতিসংঘে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য রাখেন। বৈঠকে চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সঙ্কট নিরসনে কোন প্রস্তাব আনার ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া বৈঠকে অংশ নেয়া কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়ে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। বৈঠক শেষে কোফি আনান সাংবাদিকদের বলেন, রাখাইন প্রদেশে স্থিতিশীলতা ফেরাতে তার নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশ মিয়ানমার সরকার বাস্তবায়ন করবে বলে তিনি আশাবাদী। তিনি আশা করেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নিয়ে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে পুনর্বাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশের মধ্যে রাশিয়া ও চীন দৃশ্যত মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিপরীতে তৎপর যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা নির্যাতনের নিন্দা জানাচ্ছে। কোফি আনান মিয়ানমারের আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। কোফি আনান বলেন, সীমান্ত নিরাপত্তা ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতায় উভয় দেশই লাভবান হবে। বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী শুক্রবার মধ্যরাতের এই বৈঠকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে মিয়ানমারের সরকারী বক্তব্য ও বাস্তব চিত্রের ফারাক তুলে ধরে তিনি বলেন, মিয়ানমারের দিক থেকে উপর্যুপরি উস্কানি এবং আকাশসীমা লঙ্ঘন সত্ত্বেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সহিষ্ণুতা দেখিয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে দুই দেশের মধ্যে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে আরও বিশদ আলোচনার প্রয়োজন বলে মনে করেন মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের অংশগ্রহণ ও তদারকি ছাড়া মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদী ও অর্থপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল সমস্যা সমাধান করা কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈঠকে অংশ নেয়া অন্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের নিন্দা জানিয়ে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। বৈঠকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত ছাড়াও অফিস অব দ্য হাইকমিশন অব হিউম্যান রাইটস, অফিস ফর দ্যা কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান এ্যাফেয়ার্স, ইউএনএইচসিআর, ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও সভায় বক্তব্য রাখেন। গত ২৮ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর তিনবার আলোচনায় বসে। ১৩ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা শুরুর পর ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে থেকে বাংলাদেশে রয়েছে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। রাখাইন সঙ্কট নিয়ে আনান কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের দিনই সহিংসতার শুরু হয়। ওই কমিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে নাগরিকত্বহীন অবস্থায় থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার সুপারিশের পাশাপাশি বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের পুনর্বাসনের কথাও বলা হয়। এরপর সহিংসতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা ফের বাস্তুচ্যুত হলে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কাড়ে। তার ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর এই বৈঠক হয়। চীন-রাশিয়ার বিরোধিতা নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে তিনটি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন প্রস্তাব আনার ব্যাপারে ইতিবাচক আলোচনা হয়নি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন চীন আর রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সঙ্কট নিরসনে কোন প্রস্তাব আনার ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। জাপানের জাতীয় জনসম্প্রচার সংস্থা এনএইচকে জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূত ম্যাথু রিক্রফটকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, পরিষদের সদস্যরা কিছু অভিন্ন বিষয়ে একমত হয়েছে। এগুলো হলো সহিংসতা নিরসন, মানবিক সহায়তার শর্তহীন অবাধ প্রবেশাধিকার এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন। ম্যাথু রিক্রফটের বরাতে এনএইচকে জানিয়েছে, সঙ্কট উত্তরণের পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে আরও কাজ করবে নিরাপত্তা পরিষদ। থাইল্যান্ডভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য নেশন জানিয়েছে, বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে কথা হয়েছে। তবে চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার মুখে সেই পদক্ষেপের ব্যাপারে কোন ইতিবাচক অগ্রগতি সম্ভব হয়নি। একইভাবে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা আইএএনএন জানিয়েছে, ফ্রান্স আর যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপের পক্ষে থাকলেও চীন আর রাশিয়ার বাধায় তা হয়ে ওঠেনি। চ্যানেল নিউজ এশিয়াও জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন বন্ধে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব আনার চেষ্টায় ছিল, তবে চীন আর রাশিয়া তার বিরোধিতা করেছে। চীনকে মিয়ানমারের সাবেক জান্তা সরকারের সমর্থক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
×